ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাথমিকে আবার পরীক্ষা!

প্রকাশিত: ২১:২১, ২৫ নভেম্বর ২০২১

প্রাথমিকে আবার পরীক্ষা!

আবারও প্রাথমিকে পরীক্ষা? ঠিক বুঝতে পারলাম না। এ বিষয়ে বহুবার লিখেছি। আমি ছাড়াও অনেক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদ অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলো তুলে দেয়ার পক্ষে বহুবার বক্তব্য, পরামর্শ দিয়েছেন। এ কথাও স্মরণ করা দরকার যে, অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিল রেখে কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের শিক্ষা নীতি অনুসরণে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা স্তর ক্লাস এইট পর্যন্ত গণ্য করা এবং বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত বহু আগেই গৃহীত হয়েছে। এ লক্ষ্যে এনসিটিবির শিক্ষাক্রম শাখায় বেশ কিছু কাজও করা হয়েছিল; যাতে হাই স্কুলের ষষ্ঠ থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত তিনটি শ্রেণীকে প্রাথমিক পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ উদ্দেশে নির্দিষ্ট কিছু প্রাথমিক স্কুলে অবকাঠামো উন্নয়ন করে ক্লাস এইট পর্যন্ত পাঠদানের ব্যবস্থা করার উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছিল। এটি করা হয়েছিল পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের প্রাথমিক পর্যায়ের শ্রেণী বা গ্রেডের সঙ্গে মিল রাখার জন্য। যাতে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা অব্যাহতভাবে আট বছর যাবত শিশুদের গুণগত মানসম্পন্ন মৌলিক শিক্ষার শক্ত ভিত অর্জন করতে সহযোগিতা করে। মনে রাখতে হবে, পরীক্ষা নয়, শিখনের অনুশীলন শিশুকে শিক্ষার শক্ত ভিত দিতে সক্ষম। আরও মনে রাখতে হবে, পরীক্ষা শিক্ষার্থীর শিক্ষার মান যাচাইয়েও সক্ষম নয়। পরীক্ষা যদি সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীর শিক্ষার মান যাচাইয়ে সহায়ক হতো, তা হলে দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষা অন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পরীক্ষায় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষায় জিপিএ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর অধিকাংশ পাস মার্কও লাভ করে না কেন? বিষয়টি বহুল আলোচিত শুধু নয়, এটি আমাদের মনোবেদনার একটি বড় কারণ। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম, যাদের সুশিক্ষা ও সুস্বাস্থ্য জাতিকে প্রকৃত অর্থে উন্নত করার প্রধান চাবিকাঠি, সেক্ষেত্রে শিক্ষাক্ষেত্রে এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীর অকৃতকার্যতায় যে অপচয় সাধিত হয়, তা বহু বছর যাবত শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে আছে। তা ছাড়া, পরীক্ষার প্রশ্ন যার কমন পড়েছে, সে ভিন্ন না জানা প্রশ্নের উত্তর কেমন দিত, তা যে এক রকম ফল দিত না, তা তো বলা বাহুল্য। এমনকি একই প্রশ্নের পরীক্ষা পরদিন দিলে, শিক্ষার্থীর ফল ভিন্ন হবে। সে জন্য দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ বহু শিক্ষার্থীর উচ্চ শিক্ষায় অন্যদের ছাড়িয়ে খুব ভাল করতে দেখা যায়। মনে রাখতে হবে, শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রধান রোগটি হচ্ছে, এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর উচ্চ শিক্ষা প্রবেশে অকৃতকার্য হওয়া, যা প্রমাণ করে- পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া আর গুণগত মানসম্পন্ন মৌলিক শিক্ষা অর্জন এক কথা নয়। তার ওপর এই দুটির মাঝখানে রয়েছে দূরত্বের এক মহাসমুদ্রÑযেটি পার হতে স্কুল, শিক্ষকের শিক্ষার ও পাঠদানের মান, শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা-দক্ষতা অর্জনের সক্ষমতার মান তাদের সাহায্য করতে পারেনি। এই বছরের, ২০২১-এর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার মোটামুটি সফলতার চিত্র থেকে দেখা যায়, প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়েই সব বিভাগে ১০% শিক্ষার্থী মাত্র কৃতকার্য হয়েছে। অর্থাৎ, প্রায় ৯০% শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে। যাদের মধ্যে অবশ্যই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকÑদুই পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী রয়েছে। তাহলে, নীতিনির্ধারকরা নিজেদের নিজেরাই প্রশ্ন করুন- মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা শিক্ষার্থীরা দশ বছর ও বারো বছর যাবত যে পড়াশোনা করেছে, তা কেন তাদের উচ্চ শিক্ষা স্তরে ৩৩% নম্বর পেতে সক্ষম করল না? এর অর্থ একটাই- শিক্ষার্থীরা মুখস্থ করেছে অধিকাংশ বিষয়ের পাঠ, যা তাদের পরীক্ষা পাসে সাহায্য করেছে, এমনকি ভাল গ্রেড পেতে সাহায্য করেছে। কিন্তু উচ্চ শিক্ষার ভর্তি পরীক্ষার ‘অপরিচিত প্রশ্ন’-এর মুখোমুখি হয়ে দুর্বল মৌলিক দক্ষতা তাদের বোকা বানিয়ে দিয়েছে। জানা প্রশ্নের জানা মুখস্থ করা উত্তর ট্র্যাডিশনাল রীতির প্রশ্নপত্রে গৃহীত পরীক্ষার ফল ভাল হওয়া স্বাভাবিক এবং সেটাই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার বেলায় ঘটছে। এতে বিস্মিত হওয়ার কোন কারণ নেই। শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকে প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করতে শিখেছে। হঠাৎ অচেনা, অজানা প্রশ্নের উত্তর তারা দিতে পারে না। কেননা, তাদের মৌলিক বাংলা ভাষার দক্ষতা, ইংরেজী ভাষার দক্ষতা ও গণিতের দক্ষতা অর্জনের মধ্যে ঘাটতি থেকে গেছে। নতুবা, উক্ত দুই ভাষার দক্ষতা এবং গণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতির দক্ষতা ভালভাবে আরও করা থাকলে পৃথিবীর যে কোন দেশের একই পর্যায়ের প্রশ্নের উত্তর তারা সহজে দিতে পারত। সে জন্য বারবার আমরা একটা ‘বাধা’র কথা উল্লেখ করি। সেটি হলো- প্রতি শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের কিছু না কিছু ‘শিখন ঘাটতি’ থেকে যায়, যা পূরণ করতে স্কুল শিক্ষক পরিকল্পিতভাবে মোটা দাগের একটি শ্রেণীর অধিকাংশ শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতির বিষয়ভিত্তিক তালিকা তৈরি করে বছরের প্রথম ২-৩ মাস এই ঘাটতিগুলো পূরণে আন্তরিকভাবে পাঠদানের কাজটি করলে অধিকাংশ স্বাভাবিক, সুস্থ শিক্ষার্থীরা গুণগত মানের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জনে যে সক্ষম হবে, তাতে সন্দেহ নেই। পৃথিবীর এবং সব দেশের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাবিদদের মাথাব্যথা হলো- অধিকাংশ শিক্ষার্থীর গুণগত মানসম্মত শিক্ষা অর্জন। এখন কথা হলোÑ প্রাথমিক শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পৃথিবীজুড়ে একটি- তা হলো শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মৌলিক দক্ষতাগুলো- পড়া, লেখা, মাতৃভাষা ও দ্বিতীয় ভাষায় ভাবপ্রকাশ করতে পারা এবং হিসাব করার দক্ষতা- সংখ্যা গণনা, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ, শতাংশ, ভগ্নাংশ শেখা। আর, মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো- প্রাথমিক স্তরে অর্জিত দক্ষতাগুলোর উন্নতি সাধন দ্বারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে অগ্রসর যোগ্যতাগুলো অর্জন করা। এখন একটা কথা না বললেই নয়। উপরোক্ত দক্ষতাগুলো মানসম্মতভাবে অর্জন করা সত্যিকার অর্থে খুবই কঠিন কাজ। কাজটি প্রকৃত অর্থে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সবার জন্যই খুব চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং এ কাজের গতি থাকতে হবে অব্যাহত, বাধামুক্ত। অর্থাৎ, অপ্রয়োজনীয় দেশব্যাপী পরীক্ষা গ্রহণের দ্বারা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনাবশ্যক দীর্ঘদিন যাবত তাদের পরীক্ষা পাসের প্রস্তুতির দিকে ঠেলে না দিয়ে, পরীক্ষাগুলো তুলে দিয়ে শ্রেণীর নিয়মিত পাঠ পর্যাপ্ত সময় শেষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা দ্বারা তাদের শিখন অগ্রগতিতে নজর রাখা সম্ভব এবং তা সহজসাধ্য। সুতরাং শিক্ষার নীতিনির্ধারকবৃন্দ মাথা থেকে প্রাথমিক ও জুনিয়র মাধ্যমিক স্তর অন্তে অনাবশ্যক পরীক্ষা দুটি বাদ দিয়ে শিক্ষার্থী ও শিখনবান্ধব, পরীক্ষাহীন অব্যাহত শিখনের প্রতি নজর দেবেন বলে আশা করি। যে শিখন হবে গুণগত মানসম্পন্ন। তা হলে উচ্চ শিক্ষার প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতকার্যের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মুখে হাসি ফোটাবে। পরীক্ষাপ্রেমী নীতিনির্ধারকদের অনুরোধ করব, দেশের শিশুরা অন্য দেশের শিশুদের মত কি পরীক্ষাহীন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে না? তারা কি দোষ করেছে যে, শিক্ষার মৌলিক দক্ষতাগুলো শেখার আগেই তাদের পড়া মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতে হবে? সমস্যা হলো, শিশুদের নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যে বয়স্করা, তাদের যদি এখন চাকরির প্রমোশনের পরীক্ষা নেয়া হয়, তাহলে বোধ হয় তারা শিশুদের অবস্থা কিছুটা হলেও অনুধাবন করবে। কিন্তু মন্ত্রী-উপমন্ত্রীদের তো এমন কোন প্রমোশনের পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। প্রশাসক-আমলাদেরও নেই। বহুকাল আগে ফেলে আসা কান্নাকাটি করা, খেলা ছেড়ে স্কুলে যেতে না চাওয়া এবং সর্বোপরি পরীক্ষার নামে হাত-পা ঠা-া হওয়া ভীতিকর দিনগুলো অবশ্যই তারা এখন ভুলে গেছেন। কিন্তু যে কারণেই হোক, আমার মনে সেই প্রথম দিনের ভর্তি পরীক্ষার দিনের প্রবল কান্নাকাটি থেকে শুরু করে পরের ভালবাসার বন্ধু, নাচ, গান, নাটক, ছবি আঁকা, সেলাই করা, খেলাধুলা, হিন্দু বন্ধুদের হঠাৎ করে দেশ ছাড়ার সব খুঁটিনাটি মনে পড়ে। ‘পরীক্ষা’ নামের যমের ভয় ধরা দিনগুলো ভাল মনে পড়ে। বার্ষিক পরীক্ষার ফল দেয়ার ভয়ে-ঠা-া হাত-পা নিয়ে বসে থাকার দিন কখনও ভুলি না। পরীক্ষা আর ভয়- এ দুটো সমার্থক। এগুলোকে উৎসব করার প্রয়োজন নেই। থাকুক না মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দুটির ভয়যুক্ত দিনগুলো। ভাগ্যিস, আমাদের অর্থাৎ, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, গবেষক বা বিশেষজ্ঞ, অভিভাবক- তাদের আর কোন পরীক্ষা নেই। যেসব পরীক্ষা আছে, তা নিজেদের সঙ্গে নিজেদের। যদিও অনেক বাবা, মা, বলা ভাল অধিকাংশ বাবা-মা শিশুদের সঙ্গে যেন নিজেরাও পরীক্ষা দেয়। জিপিএ ৫ পেলে আনন্দে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে। অন্যদিকে জিপিএ-৫ পায়নিদের বাবা, মা, নিরানন্দে দিন কাটায়। শিশুকে অন্য শিশুর সঙ্গে তুলনা করে বকুনি দেয়। নিজেদের ছেলেবেলার পরীক্ষার ফল বেমালুম ভুলে যায়। তুলনা করলে অপমানে যে মরে যেতে ইচ্ছা হতো, তাও ভুলে যায়। শিক্ষা নীতিনির্ধারকরা- সময় এসেছে এবার জিপিএ-৫কে স্কুল থেকে বহিষ্কার করুন। ক, খ, গ-এর গুচ্ছ তৈরি করুন। দেখা গেছে যে শিশুরা খ, গ পেয়েছে, তারা ‘খ’ বা ‘ক’তে উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট হয়। ‘ক’ পাওয়ারা অহেতুক মাতামাতি করে না। মনে আছে কি, ইতালির প্রত্যন্ত বার্বিয়ানার নিরক্ষরের ছেলেরা তাদের স্যারকে লিখেছিল- ‘আমাদের একটা জিনিস শিখতে ২-৩ ঘণ্টা বেশি সময় লাগে, অনেক সময় ২-৩ দিন লাগে, যা আপনাদের ছেলেদের লাগে না। সে সময় আমাদের দিলে তবে আমরা শিখতে পারব।’ সে জন্য শ্রেণীর পাঠের সময় বাড়ান। স্মরণে রাখুন- অনেকেরই শিখতে সময় বেশি লাগে। সবাই সমান তালে শেখে না। তাই তো, প্রতি শ্রেণীর একদল শিশু থাকে, যারা দ্রুত শেখে। একদল থাকে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে শেখে। ছোট একটি দল থাকে যারা খুব ধীর গতিতে শেখে। তাদের দুই দলের যথেষ্ট পাঠ শেখার সময় দরকার। এখানে পরীক্ষা নামের বৈষম্য সৃষ্টিকারী কিছু থাকা অপরাধ। এটি করবেন না দয়া করে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×