ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গুড বাই ‘মিঃ থ্রি সিক্সটি’ ডিগ্রী

প্রকাশিত: ০০:১১, ২৪ নভেম্বর ২০২১

গুড বাই ‘মিঃ থ্রি সিক্সটি’ ডিগ্রী

ব্যাটিংয়ে ব্যাকরণই যার শেষ কথা সেই রাহুল দ্রাবিড় একবার বলেছিলেন, ‘এবি ডি ভিলিয়ার্স ক্রিকেটের নিয়মই বদলে দিচ্ছে!’ মাইকেল ভনের চোখে, ‘জিনিয়াস বলতে যা বোঝায়, এবি হলো এমন একজন।’ অনেকের কাছে তিনি সুপারম্যান। তবে যে খেতাব এবি ডি ভিলিয়ার্সকে সবার চেয়ে আলাদা করেছে সেটি ‘মিঃ ৩৬০ ডিগ্রী’। নিয়মের বাইরে গিয়ে এমন সব শট খেলতেন অন্যরা যা কল্পনাও করতে পারেননি। চোখ ছানাবড়া গ্রেট রাহুলের তাই অমন মন্তব্য। ইনোভেটিভ স্ট্রোক প্লে, ক্লিন হিটিং এবিলিটি, ভয়ডরহীন মানসিকতা এবং আগ্রাসনের সঙ্গে টেম্পারমেন্টের নিখুঁত কম্বিনেশন তাঁকে করেছিল অনন্য, অসাধারণ। বিধ্বংসী ১৪২-১৪৫ কিলো মিটার গতির বলে শুয়ে, বসে অবলীলায় পাঠিয়ে দিতেন গ্যালারিতে। রিভার্স-সুইপ বা হাঁটু গেড়ে ফাইন লেগের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকানোর মতো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজটা তার জন্য ছিল দুধভাত! ক্রিকেটের সব গ্রামারকে ¯্রফে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে খেলেছেন উদ্ভাবনী সব শট। অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, দলকে জিতিয়েছেন বহুবার। ২০১৮ সালে ফর্মের তুঙ্গে থাকা অবস্থায় ৩৪ বছর বয়সে অনেকটা আচমকা দক্ষিণ আফ্রিকা জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে এতদিন ফ্র্যাঞ্চাইজি টি২০ খেলছিলেন। এবার পুরোপুরি ব্যাট-প্যাড তুলে রাখলেন ‘মিঃ ৩৬০ ডিগ্রী’। শেষ হলো ক্রিকেটের রোমাঞ্চকর এক অধ্যায়ের। ইনফর্ম এবিডি ২০১৮ সালে অনেকটা আচমকাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। ভক্ত-সমর্থকদের মাঝে একটা হাঁহাকার ওঠে। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ^কাপের ঠিক আগে নিজে থেকেই ফেরার আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। তবে দলীয় পরিকল্পনা ও সংহতিতে ব্যঘাত সৃষ্টি হতে পারে, এমন ভাবনায় সাউথ আফ্রিকান বোর্ড (সিএসএ) তাতে সাড়া দেয়নি। গুঞ্জন ছিল এবারের টি২০ বিশ^কাপে ফিরবেন, সেটিও হয়নি। অবশেষে একেবারে সকল ধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানালেন আধুনিক দক্ষিণ আফ্রিকার সফল এবং অন্যতম জনপ্রিয় এ উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান। ৩৬০ ডিগ্রী খ্যাত ৩৭ বছর বয়সী সুপার এবির শেষের কথা উঠলে তাই আইপিএলের কথাই বেশি মনে পড়বে। শারজায় গত ১১ অক্টোবরে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালুরুর হয়ে কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিপক্ষে ম্যাচটি হয়ে রইল তার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ। এক বিবৃতিতে ডি ভিলিয়ার্স বলেন,‘এটা ছিল অবিশ্বাস্য এক পথচলা, তবে আমি সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বড় ভাইদের সঙ্গে বাড়ির পেছনে খেলা শুরুর পর থেকে আমি ক্রিকেটকে নিখাঁদভাবে উপভোগ করেছি এবং প্রবল উদ্দীপনার সঙ্গে খেলেছি। এখন ৩৭ বছর বয়সে এসে ওই চাওয়া আর আগের মতো নেই। আমি যতগুলো ম্যাচ খেলেছি, সবই খেলেছি বিশুদ্ধ আনন্দ ও সীমাহীন উৎসাহ নিয়ে। এই বয়সে এসে, অগ্নিশিখা আর ততটা উজ্জ্বল নেই। এটাই বস্তবতা, যা আমাকে মেনে নিতে হবে এবং এটা হঠাৎ করে মনে হতে পারে, সে কারণে আজ আমি এই ঘোষণা দিচ্ছি।’ আন্তর্জাতিক ও ফ্র্যাঞ্চাইজি মিলিয়ে ক্যারিয়ারে ৩৪০টি টি২০ খেলেছেন ডি ভিলিয়ার্স। ১৫০.১৩ স্ট্রাইক রেটে ৪ সেঞ্চুরি ও ৬৯ হাফ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৯৪২৪ রান। আইপিএল ছাড়াও খেলেছেন বিগ ব্যাশ, পিএসএল, ভাইটালিটি ব্লাস্ট, বিপিএল ও এমএসএলেÑ এর মধ্যে আইপিএলেই সবচেয়ে বেশি খেলেছেন ডি ভিলিয়ার্স। যেখানে ১৮৪ ম্যাচে ৩ সেঞ্চুরি ও ৪০ হাফ সেঞ্চুরিতে করেছেন ৫১৬২ রান। ভারতের ঘরোয় এই টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের তালিকায় আছেন ছয় নম্বরে। ২০১১ সালে বিরাট কোহলির সতীর্থ হিসেবে যোগ দিয়ে ১৫৭ ম্যাচে ১৫৮.৩৩ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৪৫২২ রান। রয়্যাল চ্যালেঞ্জাসং ব্যাঙ্গালুরুর সর্বকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এবি বলেন, ‘আরসিবির সঙ্গে স্মরণীয় একটি পথচলা ছিল। আজীবন লালন করার মতো অনেক স্মৃতি আছে। আমি চিরকালই একজন আরসিবান।’ ২০১৯ সালের শেষ দিকে সিএসএর ক্রিকেট পরিচালক হিসেবে গ্রায়েম স্মিথ ও দলের প্রধান কোচ হিসেবে মার্ক বাউচার দায়িত্ব নেয়ার পর আবার ডি ভিলিয়ার্সের ফেরার গুঞ্জন শুরু হয়। তখন মূলত ২০২০ সালে হওয়ার কথা থাকা টি২০ বিশ্বকাপকে ঘিরে চলতে থাকে ৭৮টি অন্তর্জাতিক টি২০ খেলা এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যানের ফেরার আলোচনা। তবে করোনার প্রকোপে বিশ্বকাপ পিছিয়ে গেলে তার ফেরার আলোচনাও থমকে যায়। শেষ পর্যন্ত গত মে মাসে সিএসএ জানিয়ে দেয়, সাবেক এই অধিনায়কের অবসরের সিদ্ধান্ত পাকাপাকিভাবেই থেকে যাচ্ছে। ফলে জাতীয় দলে আর ফেরা হয়নি ডি ভিলিয়ার্সের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলার পর ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে দাপটের সঙ্গেই খেলে যাচ্ছিলেন তিনি। আইপিএলের এবারের আসরেও তার ব্যাটে ছিল রান। দুই হাফ সেঞ্চুরিতে ১৪ ইনিংসে করেন ৩১৩। তবে ৩৮ ছু্ইঁ ছুঁই বয়সে এসে এখন আর আগের মতো তাকে টানছে না ক্রিকেট। সে কারণেই অবসরের সিদ্ধান্ত নেয়া বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ১৪ বছরে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ১১৪ টেস্ট ও ২২৮টি ওয়ানডে খেলা ডি ভিলিয়ার্স। ২২ সেঞ্চুরিতে টেস্টে তার মোট রান ৮৭৬৫। ১৫ সেঞ্চুরিতে ওয়ানডে রান ৯৫৭৭। প্রথম শ্রেণীতে ১৪১ ম্যাচে ডি ভিলিয়ার্সের রান ১০৬৮৯। নামের পাশে সেঞ্চুরি আছে ২৫টি, হাফ সেঞ্চুরি ৬০টি। ২৬৩ লিস্ট-এ ম্যাচে ২৯ সেঞ্চুরি ও ৬৩ হাফ সেঞ্চুরির সাহায্যে করেছেন ১১১২৩ রান। দারুণ সব ক্যাচ এবং চার-ছক্কা বাঁচানো নয়নাভিরাম সব ফিল্ডিং তাঁকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে টেস্টে ২২২, ওয়ানডে ১৭৬ ও টি২০তে ৬৫টিসহ মোট ক্যাচ ধরেন ৪৬৩টি। সবমিলিয়ে স্ট্যাম্পিং আউট করেন ১৭টি। ২০১৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে জোহানেসবার্গে এক টেস্টে ১১টি ডিসমিসাল করে ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটার জ্যাক রাসেলের বিশ^ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে ভাগ বসান। দ্বিতীয় ইনিংসে ১১৭ বলে ১০৩ রান করে ক্রিকেট ইতিহাসে একমাত্র উইকেট উইকেট রক্ষক হিসেবে ১০টি ডিসমিসাল ও অর্ধশতক করার অনন্য কীর্তি গড়েন ডি ভিলিয়ার্স। ক্যারিয়ার জুড়ে দারুণ ধারাবাহিকতার স্বীকৃতি ২০১০, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালসহ মোট তিনবার জিতেছেন আইসিসির ওয়াসডের বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার। ছিলেন ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত উইজডেনের গেল দশকের সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের তালিকায়। গ্রায়েম স্মিথ পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকাকে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে তুলেছিলেন ২০১৫ সালের আইসিসি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে! ওয়ানডেতে দ্রুততম সেঞ্চুরি, হাফ সেঞ্চুরি এবং দ্রুততম দেড় শ’ রানের ইনিংস খেলার রেকর্ডটি ডি ভিলিয়ার্সের দখলে। ইতিহাসে মাত্র তিনজন ক্রিকেটার এক সিরিজে তিনটি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন এবি তাদের একজন। সবচেয়ে বেশি টানা তিন ইনিংসে শতক হাঁকানো দুই ক্রিকেটারের একজনও তিনি। এমনকি ওয়ানডেতে সপ্তম দ্রুততম ছয় হাজার, তৃতীয় দ্রুততম সাত হাজার, তৃতীয় দ্রুততম আট হাজার ও দ্বিতীয় দ্রুততম নয় হাজার রানের রেকর্ডগুলোও তাঁর দখলে।
×