ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সরকারী ওষুধ পান মাত্র ৩ শতাংশ রোগী

সরকারী হাসপাতালে পরীক্ষার সুযোগ পান মাত্র ১৪.৯ শতাংশ

প্রকাশিত: ২২:১০, ২২ নভেম্বর ২০২১

সরকারী হাসপাতালে পরীক্ষার সুযোগ পান মাত্র ১৪.৯ শতাংশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অসংক্রামক রোগসহ অন্যান্য দূরারোগ্য চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে অনেকেই দিন পার করছেন আর্থিক সঙ্কটে। বেসরকারী হাসপাতালের উচ্চ ব্যয় বহন করতে না পেরে যেসব রোগী সরকারী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন তাদেরও কমতি নেই চিকিৎসা ব্যয়ে। সরকারী হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও মাত্র ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ রোগী এসবের সুবিধা নিতে পারছেন। আর মাত্র ৩ শতাংশ রোগী পাচ্ছেন সরকারী ওষুধ। এতে কমমূল্যে চিকিৎসা করাতে আসা ব্যক্তিদেরও খরচ করতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। ফলে চিকিৎসাসেবায় সাধারণ মানুষের আর্থিক অসঙ্গতি থাকছেই। ‘ডিসমিনেশন অন পাথওয়েজ টু রিডিউস হাউসহোল্ড আউট-অব-পকেট এক্সপেন্ডিচার’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রবন্ধ থেকে এসব কথা জানা যায়। এতে বলা হয়, সরকারী হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণকারী অধিকাংশ রোগীকে ফার্মেসি থেকে ওষুধ ক্রয় এবং ডায়াগনস্টিক ল্যাব থেকে সেবা গ্রহণ করতে হয়। ফলে রোগীর ব্যয় বেড়ে যায় এবং প্রায়ই রোগী আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন। গবেষণা প্রবন্ধে আরও বলা হয়, প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য দেশে ১৪ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থ্যসেবায় উন্নতির ফলে সূচকে দেখা গেছে অভাবনীয় সাফল্য, মিলেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কিন্তু তৃতীয় ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন থেকে বাংলাদেশ বহুদূর পিছিয়ে রয়েছে। গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয়, ২০১২ সালে বাংলাদেশে রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় ছিল ৬৪ ভাগ, যা ২০৩২ এর মধ্যে তা ৩২ ভাগে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশল : ২০১২-২০৩২ প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ২০১৫ সালে এ খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ ভাগ। তাই বলা চলে, সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে বাংলাদেশের প্রধান অন্তরায় হচ্ছে উচ্চ হারে রোগীর পকেট থেকে ব্যয়। বলা হচ্ছে, ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এন্টিবায়োটিকসহ প্রায় সব ধরনের ওষুধ ক্রয়ের সুযোগ থাকায় এবং ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর মাত্রাতিরিক্ত বিপণনের ফলে স্বীকৃত ডাক্তারদের পাশাপাশি পল্লী ও হাতুড়ে ডাক্তাররাও ব্যবস্থাপত্রে অতিমাত্রায় ওষুধ লিখে থাকেন। যার কারণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ সেবন করা হয় এবং একজন রোগীর ব্যয় বেড়ে যায়। এছাড়া বেসরকারী হাসপাতাল এ্যাক্রিডিটেশন পদ্ধতি না থাকা এবং সেবা মান ও মূল্যের বিষয়ে প্রয়োজনীয় নজরদারি না থাকায় সেবাগ্রহণকারী জনগণ প্রতিনিয়ত বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সেবা বিষয়ে রোগীদের অসন্তুষ্টি ও কখনও কখনও আস্থার ঘাটতি তাদের দেশের পরিবর্তে বিদেশ থেকে সেবাগ্রহণে উৎসাহিত করে। এভাবে চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে অনেক মানুষ ভিটে-জমি হারিয়ে সর্বস্ব^ান্ত হয়ে পড়েন। এই গবেষণা প্রবন্ধ নিয়ে রবিবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক সেমিনারের আয়োজন করে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট। এতে গবেষণার বিষয়বস্তু তুলে ধরেন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহাদৎ হোসেন। এ সময় তিনি বলেন, রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয়ের প্রধান উৎস হলো ওষুধ খাতে ব্যয়, যা প্রায় ৬৪ ভাগ। হাসপাতালে আন্তঃবিভাগ ও বহির্বিভাগ থেকে সেবা নেয়ার মাধ্যমে যথাক্রমে ১২ ও ১১ ভাগ ব্যয় হয়। এছাড়া রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা খাতে ব্যয় হয় ৮ ভাগ। গ্রামপর্যায়ে বিস্তৃত সরকারী প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যথাযথ কার্যকর না হওয়ায় এবং শহর এলাকায় পর্যাপ্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা না থাকায় রোগী সেরকারী হাসপাতাল থেকে গ্রামপর্যায়ে যেতে বাধ্য হন। তাছাড়া সরকারী হাসপাতাল থেকে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সম্পূর্ণ ওষুধ দেয়া হয় না এবং রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগও থাকে না। ড. মোহাম্মদ শাহাদৎ হোসেন বলেন, তবে জরুরী ওষুধের তালিকা সংশোধন ও সম্প্রসারণ এবং ব্যবস্থাপত্রে প্রটোকল অনুসরণ করে কোম্পানির ওষুধের ‘ব্র্যান্ড নাম ব্যবহারের পরিবর্তে’ জেনেরিক নাম ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে এ ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা খাতের যোগানের দিক শক্তিশালী করার পাশাপাশি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচী (এসএসকে) বা সামাজিক স্বাস্থ্যবীমা চালু ও সম্প্রসারণের মাধ্যমেও রোগীর নিজ পকেট থেকে ব্যয় কমানো সম্ভব। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ লোকমান হোসেন মিয়া, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু। এ সময় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ক্যান্সার, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগের (এনসিডিসি) কারণেই বর্তমানে দেশের মানুষের ‘আউট অব পকেট’ খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই রোগগুলোতে প্রতিবছর দেশে সর্বাধিক মৃত্যুসহ অনেক পরিবার প্রায় নিঃস্ব হয়ে যায়। তাই এসব রোগের চিকিৎসায় নির্মাণ করা হচ্ছে ৮টি ১৫তলা বিশিষ্ট ক্যান্সার, কিডনি, লিভার হাসপাতাল বলে জানান মন্ত্রী। তিনি জানান, এসব হাসপাতাল নির্মাণ কাজ একেবারেই শেষ পর্যায়ে আছে। এসব হাসপাতালে হাজারও রোগী বিনা খরচে এ রকম নন-কমিউনিকেবল ডিজিজগুলোর চিকিৎসা লাভ করবে। এতে করে দেশের মানুষের আউট অব পকেট এক্সপেনডিচার অনেকাংশেই কমে যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকায় দেশে করোনায় গত প্রায় ৬শ’ দিনের মধ্যে ১ম মৃত্যু শূন্য হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দেশবাসীকে অভিবাদন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, রাশিয়াসহ বিশ্বের বহু দেশেই মৃত্যুহার এখনও উর্ধমুখী। অনেক দেশ লকডাউনে যাচ্ছে। সে সময় বাংলাদেশ করোনায় মৃত্যু শূন্য হলো। এটি স্বাস্থ্যখাতের সফল পরিকল্পনা। পরিশ্রম এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগের ফসল। তবে আমাদের কোনভাবেই আত্মতুষ্টিতে ভোগা যাবে না। কারণ এটি যাতে আবারও বড় কোন আঘাত হানতে না পারে সেজন্য কাজ করতে হবে। এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমাদের হাসপাতালগুলোতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় ৬০ ভাগ টাকা রোগীর পকেট থেকে খরচ করতে হচ্ছে। এরমধ্যে ওষুধের খরচই বেশি। তবে দেশে রোগীদের দিয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরীক্ষা করানো হচ্ছে। এতে রোগীদের খরচ বাড়ছে। তাই চিকিৎসকদের প্রতি অনুরোধ, রোগীদের অযথা পরীক্ষা দেবেন না। তিনি বলেন, দেশে সরকারী হাসপাতালগুলোতে রোগীরা বিনামূল্যে সেবা পান। তবুও দেশ থেকে অনেকেই বিদেশে চিকিৎসার জন্য যান। সেক্ষেত্রে দেশের তুলনায় ১০ গুণ বেশি খরচ হয়। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন অনেক ভালো। হার্টের বাইপাস অপারেশন কোন না কোন হাসপাতালে হচ্ছে। কিডনি ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা হচ্ছে। তবে, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও উন্নত হওয়া দরকার। ক্যান্সার, কিডনি ও হার্টের চিকিৎসায় আরও উন্নতি দরকার। দেশের হাসপাতালগুলোতে খরচ আরও কমানো যেতে পারে বলে মনে করেন জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালগুলোতে যে পরিমাণ রিসোর্স থাকুক না কেন, ফান্ডিং, মেশিনারিজসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবহার যদি হয় তাহলে মনে করি খরচ অনেকাংশেই কমে আসবে।
×