ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মনিরা মিতা

শীত ও শালুকেরগল্প

প্রকাশিত: ২০:৪১, ২০ নভেম্বর ২০২১

শীত ও শালুকেরগল্প

‘এই বয়সে এতো শীত কি সহ্য হয়? মানুষের উপরে আল্লাহ গজব পড়ছে। বুড়ো মরা শীত পইড়াছে। ও কমলা, আঙ্গুর...বুজানরা কি ঘুমাইছো?’ ‘বুবুরা...আইসো তো গতরের লগে গতর মিলায় শোও। তুমগো গায়ে ওম বেশি। কচি রক্ত বলে কতা।’ ‘উহু...বুড়ি জ্বালাইও না তো। এতো কতা কও ক্যান। রাত হইছে ম্যালা, ঘুম ধরে না তুমার চোক্ষে!’ ‘বুড়ো হইলে বুঝবা গো বুজান।’ কয় কি বুড়ি! তুমার মতন বয়স পাইলে তো বুঝুম? তার আগেই মইরা ভূত...হি হি হি। ‘বালাই ষাট, কুলক্ষণের কতা কতি হয় না বুজান। আমার মাতায় যত চুল আছে তুমাগের হায়াত তত হইক। অকালে তুমাগো বাপ-মা গেছে, তুমাগো মুখ চাই বাঁচি আছি।’ আজ আমার জোয়ান পোলা-বউ বাঁচি থাকলি কি আমার এতো কষ্ট করোন লাগে? ও রে আমার মানিকরে... তুই কই গেলিরে’ ছেলের কথা মনে করে বিলোপ করা শুরু করল মাজু বুড়ি। ‘ও বুড়ি এতো রাইতে আবার তুমার প্যানোর প্যানোর শুরু করলা। আরেকবার কান্দন শুরু করলি কলাম খেতার মধ্যি থোন বাইর কইরে দিবানি।’ এগারো বছরের নাতনি কমলার ধমক খাইয়ে বেলুনের মতো চুপসে গেল মাজু বুড়ি। গেন্দাকালে মাইয়াডা এতিম হইছে। ওর বয়স তহন আট বছর আর ছোডডার কেবল ছয়। গাড়ি উল্টে বাপ-মা যাওয়নের পর থোন মাজু বুড়িই মানষের বাড়ি কাম কইরে নাতনি দুইডারে খাওয়াইছে। কিন্তু গেল বছর মাঞ্জার ব্যথায় বিছানা ধরছে সে। উপায় না পাইয়ে কমলা বানু মানষের বাড়ির হাত আওরানো কাম করে। এর বাড়ির উঠান ঝাড়ু দিলে এক থাল পান্তা দেয়। ওর বাড়ির গোবরের লাঠি বানালে এক সের চাল দেয়। তার বাড়ির ধান ভানলে খুদ-কুঁড়ো দেয়। এসব দিয়ে কোন মতে বাঁইচে আছে লিকলিকে তিনটে জীবন। মাঝেমধ্যে কাম কাজ না থাকলি কঁচু-ঘেচু সিদ্ধ করে প্যাট বাঁচায় ওরা। তয় প্রতি বছর গ্যাঞ্জাম বাঁধায় শীত। হাড় কাঁপানো শীতে দাঁতে দাঁতে বাড়ি খায় মাজু বুড়ি। তার বুড়ো হাড়ে শীত সহ্য হয় না। এইবারও বেজায় শীত নামছে, সন্ধ্যা হতেই টুপটাপ কুয়াশা পড়ে। মাজু বুড়ির ভাঙা ঘরে তীব্র দাপটে খেলা করে উত্তরে হাওয়া। ছেঁড়া কাঁথা গায়ে জড়িয়ে শীতে কাঁপে বৃদ্ধা। এমনই এক তীব্র শীতেই মরছিলো তার হতদরিদ্র স্বামী। শীতে গায়ে দেওনের মতো লেপ কম্বল কিছুই জোটে নাই মৃত্যুপথযাত্রী সেই লোকটার। মাজু বুড়ি ভাবে তারেও কি এই শীতেই দুনিয়ার মায়া কাটায়ে চইলে যাইতে হয়? ‘ও কমলা...ওলো ও আঙ্গুল ঘুমায় গেছোস? পেসাবে চাপ দিছে, যাওয়ন দরকার। তোরা যাবি আমার লগে? আমার অঁন্ধারে ডর করে।’ ‘সকালে হয়ে আইলো। চুপ মাইরে শুয়ে থাহো।’ ‘জব্বর শীত করতাছে বুজান। চেয়ারম্যান কতজনরে বিলাতি কম্বল দেয়, খালি আমাগের ফুটো ভাগ্যি কিছুই জোডে না।’ ও কমলা, তুই একবার চেয়ারম্যান বাড়ি যাবি কম্বলের কতা কতি? আমার তো নড়নচড়ন করণের খেমতা নাই। ‘দেখুম নে। এহন ঘুমাও তো বুড়ি।’ সকালে উঠে কলমা আর আঙ্গুর কয়লা দিয়ে দাঁত মাজে। আঙ্গুরের গাল বেয়ে পড়ে কয়লার কালি। বড়ই অদ্ভুত দেখায় ওকে। মাজু বুড়ি উঠনে বসে রোদ গায়ে মাখে। সকালের ভেজা তুলোর মতো নরম রোদ খুব ভাল লাগে বুড়ির। কিন্তু খিদের চোটে তার পেটের নাড়িভুঁড়ি যুদ্ধ বাঁধায়। ‘ওলো নাতনি, ঘরে মুড়ি টুড়ি কিছু থাকলি এক মুট দে। আর তো সহ্য গয় না।’ ‘কিচ্ছু নাই। আজ কেউ কামেও ডাকে নাই। সারাদিন কি না খায়ে থাকতি হয় সেই চিন্তাই করতেছি।’ ‘বুবু, ও বুবু...বিলে যাবা? ম্যালা নাইল হইছে। চলো নাইল তুলে সিদ্ধ করবানি।’ ‘নাইলের গোড়ায় শালুক থাহে বুজান। খাতি বেজায় স্বাদ। শালুক পাইলে নিয়া আইসো সিদ্ধ করে দিমুনে।’ ‘আইচ্ছা বুজান আনমুনে।’ ‘খালি নাইল সিদ্ধ খায়ে কি দিন কাটব? তুই বিলে যা, আমি দেহি কেউ কামে নেয় নাহি।’ ‘আমার একা যাইতে ডর লাগে বুবু। বিলের কালা পানি বরফের নাহাল ঠান্ডা।’ ‘ধূর বলদ, কিসের ডর? আর দ্যাখ কেমুন চকচকা রোদ ড্যাবড্যাপ কইরে তর দিক চাইয়া আছে। জারের বংশ শুদ্ধা পালাইবে।’ বুবুর কথায় ভরসা পেয়ে আঙ্গুর নাইল তুলতে বিলে গেল। আর কমলা বাহির হলো গ্রামে। ‘বুজানরা তততড়ি ফিরা আইয়ো। আমার কলাম খিদে সহ্য হয় না।’ কমলা বাড়ি বাড়ি ঘুরতে লাগল যদি কেউ ডাক দেয় সেই আশায়। অন্যদিকে বিলের কনকনে ঠান্ডা পানিতে নামতেই আঙ্গুরের শরীর কাটা দিয়ে উঠল। তবুও সে সাঁতারে মাঝ বিলে চলে গেল। তার বুজান শালুক নিতে কইছে। দম আটকে ডুব দিয়ে শালুক তুলতে লাগল আঙ্গুর। খিদে পেটে নয় বছরের ছোট আঙ্গুর ডুবের পর ডুব দিতে লাগলো। ঠান্ডায় তার আঙুলগুলো নীল হয়ে গেল তবুও সে থামছে না। তার কাছে শীতের কষ্টের চেয়ে খিদের কষ্ট আরও বড়। বেশ কিছু শালুক তুলে আঙ্গুর ভাবে এটাই শেষ তারপর বাড়ি ফিরে যাবে। আঙ্গুর বড় দম নিয়ে ডুব দেয় কিন্তু আর ওঠে না। ওদিকে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে হলো, কমলা এক সের খুদ হাতে বাড়ি এসে দেখে আঙ্গুর ফিরে আসে নাই। বোনকে না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিলে ছুটে যায় কমলা। ‘আঙ্গুর... ও আঙ্গুর। কই গেলিরে বইন’ বলে চিৎকার করতে থাকে কমলা। এক সময় মাঝ বিলে শাপলার ভেতর কিছু ভাসতে দেখে কলমা। ভাল করে খেয়াল করে দেখে এতো তার আদরের আঙ্গুর! ‘আল্লাহরে! এইডা তুমি কি করলা!’ কমলা চিলের মতো উড়ে আঙ্গুরের কাছে যায় কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। আঙ্গুরের শরীর ভয়ঙ্কর ঠা-া। একটা নাইল তার গলা পেঁচিয়ে আছে।
×