ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেজাউল করিম খোকন

জলবায়ু সম্মেলন ও বৈশ্বিক অর্থনীতি

প্রকাশিত: ০১:১৮, ৭ নভেম্বর ২০২১

জলবায়ু সম্মেলন ও বৈশ্বিক অর্থনীতি

স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ৩১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। জাতিসংঘের কনফারেন্স অব দ্য পার্টিঁজ (কপ) এর ২৬তম আয়োজনে বিশ্বের ১২০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বা তাদের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়েছেন। সম্মেলন শেষ হবে ১২ নবেম্বর। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর এটিই সবচেয়ে বড় জলবায়ু সম্মেলন, যেখানে প্রায় ২০০ দেশের আড়াই হাজার প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছেন। বিশ্বনেতা, নীতিনির্ধারক, জলবায়ুবিজ্ঞানী, আর্থিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, বিনিয়োগকারী, জলবায়ু আন্দোলনকর্মী ও তরুণ সমাজের প্রতিনিধিরা কপ ২৬ নামের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে তাদের পরিকল্পনার ঝাঁপি খুলে বসেছেন। তারা সিদ্ধান্ত নেবেন কীভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির গতি হ্রাস করে জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলা করা যায়। এই সম্মেলনের সাফল্যের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে জলবায়ুজনিত বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টা কতটা কাজ করবে। বন্যা, খরা ও দাবানলের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ক্ষতির জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো। অথচ এই দেশগুলোর মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ উন্নত দেশগুলোর চেয়ে ঢের কম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাদেরই সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে। ফলে গøাসগোতে জলবায়ু সম্মেলনে কম ধনী এবং ছোট দেশগুলোর চাহিদার বিষয়ে একটি সমাধানে পৌঁছানো জরুরী। ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ বলছে, চীন, ভারত, আমেরিকাসহ ১০ শতাংশ দেশ বিশ্বের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ৩৬ থেকে ৪৫ শতাংশের জন্য দায়ী। তারা একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে ঢুকেও সেই নির্গমনের পরিমাণে লাগাম পরাতে পারেনি। অর্থনীতি এগিয়ে চলার গতি বাড়াতে সব দেশই প্রচুর পরিমাণে কার্বন রয়েছে এমন সব জ্বালানির যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। তাতে পরিবেশ বিষিয়ে উঠছে উত্তরোত্তর। উষ্ণায়নের গতি বাড়ছে। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে এসব দেশ রাজি হয় যে শিল্পবিপ্লব পূর্ববর্তী যে তাপমাত্রা পৃথিবীর ছিল তার চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রী বা বড়জোর ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি যাতে না বাড়তে পারে, তা নিশ্চিত করতে সবাই চেষ্টা করবে। সব দেশই মেনে নেয় যে, এটা না করতে পারলে পৃথিবী এবং মানবসভ্যতা মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এই বোঝাপড়া প্যারিস চুক্তি নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে অঙ্গীকার করা হয় ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। বিশ্বের ২০০টি দেশ পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ কমাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত তাদের কর্মপরিকল্পনা কী, তা গøাসগোর সম্মেলনে জানাতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে। ধনী দেশগুলো প্রতিশ্রæতি দিয়েছিল যে, তারা ২০২০ সালের মধ্যে দরিদ্র দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার দেবে যাতে তাদের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা সহজ হয়। কিন্তু জাতিসংঘ সম্প্রতি বলেছে, এই প্রতিশ্রæতি রক্ষা হয়নি। ফলে এই প্রতিশ্রæতির মাত্রা বাড়ানোর জন্য ধনী দেশগুলোর ওপর চাপ রয়েছে। বিশ্বকে বাঁচাতে চলমান জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক দূষণে বাংলাদেশের অবদান মাত্র দশমিক ৪৭ শতাংশ, অথচ জলবায়ু বিপর্যয়ের পরিণতিতে সর্বাধিক ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, ২০০৯ সালেই ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ গঠন করা হয়। গত সাত বছরে জলবায়ু মোকাবেলা সংক্রান্ত খাতে ব্যয় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এ মুহূর্তে একটি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চলছে। তিনি জানান, সম্প্রতি আমরা একটি উচ্চাভিলাষী ও সময়োপযোগী এনডিসি জমা দিয়েছি। আমাদের অভ্যন্তরীণ সৌর জ্বালানি কর্মসূচী বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ একটি কর্মসূচী। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের মোট জ্বালানির ৪০ শতাংশ আসবে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। ১২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প বাতিল করেছি। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ থেকে জলবায়ু সমৃদ্ধির দেশ হয়ে ওঠার পথে আমরা ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। বলপ্রয়োগে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয়দানের ফলে পরিবেশের ওপর যে বিরূপ প্রভাব তৈরি হচ্ছে, আমরা তা মোকাবেলার চেষ্টা করছি। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) এবং ভি-২০ এর চেয়ার হিসেবে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় বিশেষ করে দরিদ্রতম যে ৪৮টি দেশ সবচেয়ে বেশি পর্যদস্তু অথচ বিশ্বে কার্বন নিঃসরণে যাদের অবদান মাত্র শতকরা ৫ ভাগ, তাদের স্বার্থ তুলে ধরছি। তাদের অর্থায়ন চাহিদার জন্য ধনী দেশগুলোর কাছে স্বীকৃতির দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি ঢাকায় গেøাবাল সেন্টার ফর এ্যাডাপ্টেশন এর দক্ষিণ এশীয় কার্যালয়ের মাধ্যমে আমরা সেরা অনুশীলন ও জ্ঞান বিনিময়ের কাজ করছি। সিবিএফের পক্ষ থেকে একটি জরুরী জলবায়ু চুক্তি গঠনের জন্য তাগিদ দিচ্ছে বাংলাদেশ। সম্মেলনে জলবায়ু বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে চার দফা প্রস্তাব পেশ করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রস্তাব চারটি হলো- ১. গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনকারী বড় দেশগুলোকে উচ্চাভিলাষী এনডিসি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ২. অভিযোজন ও প্রশমনের জন্য ৫০ : ৫০ অনুপাতের ভিত্তিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বছরে এক হাজার কোটি ডলার দেয়ার যে অঙ্গীকার করেছে উন্নত দেশগুলো, তা প্রতিপালন করতে হবে। ৩. সর্বাধিক ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর সাশ্রয়ী মূল্যে বিশুদ্ধ ও সবুজ প্রযুক্তি সরবরাহ করতে হবে। সিভিএফ দেশগুলোর উন্নয়ন-চাহিদাও বিবেচনায় রাখতে হবে। ৪. ক্ষয়ক্ষতির বিষয়সমূহ বিবেচনায় নিতে হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা ও খরার কারণে জলবায়ু অভিবাসী যারা, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য টেকসই, সবুজ এবং প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান অর্জনে আমাদের মধ্যে জ্ঞান ভাগ করে নেয়া, গবেষণা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থা বা ডবিøউএমওর নতুন একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সাল ছিল এশিয়ার সবচেয়ে উষ্ণ বছর। ১৯৮১-২০১০ সময়কালীন গড় যে তাপমাত্রা এশিয়ায় ছিল, তার চেয়ে ২০২০ সালের তাপমাত্রা ছিল ১ দশমিক ৩৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি। আর এর ফলে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ এবং অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে শত শত কোটি ডলারের। অন্যদিকে জাতিসংঘের আরেকটি রিপোর্ট বলছে, পৃথিবীর দেশগুলো স্বল্প এবং মধ্যমেয়াদে কার্বন নিঃসরণ কমানোর যে পরিকল্পনা করেছে তাতে ২০৪০ সাল নাগাদ বর্তমানের তুলনায় নিঃসরণ বাড়বে ১৬ শতাংশ। ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা ১৮৫০ সালের তুলনায় ২ দশমিক ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়বে, যার অর্থ মানব সভ্যতা মহাবিপর্যয়ে পড়বে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই কার্বন নির্গমন হ্রাস করতে হবে। এ জন্য প্রধান নির্গমনকারীদের জাতীয়ভাবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা (এনডিসি) পেশ এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। উন্নত দেশগুলোকেও সাশ্রয়ী মূল্যে সবুজ ও পরিছন্ন প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে দুর্বল দেশগুলোকে সহায়তা করতে হবে। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্তে¡ও বাংলাদেশ অভিযোজন ও প্রশমন উদ্যোগ এবং স্থিতিস্থাপকতার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী অগ্রগামী। এ ছাড়া বাংলাদেশ এ বছর তিন কোটি চারা রোপণ করছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনকারী দেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন বিশ্ব নেতারা। জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলায় কার্বন গ্যাস নির্গমন কমানোর কোন উদ্যোগই সফল হবে না, যদি এই দুটো দেশকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করা না যায়। তাই এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমনকারী এই দুটি দেশকে গ্যাস নির্গমন কমানো এবং ক্ষতির আনুপাতিক হারে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়ে চাপ দেয়া প্রয়োজন। একই সঙ্গে জি৭ সম্মেলনের ঘোষণা অনুযায়ী ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ‘নিট জিরো’-তে নামিয়ে আনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে এবারের সম্মেলনে। ভয়াল করোনা মহামারী বিশ্বজুড়ে ৫০ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, তাও মানুষের আচরণে কোন মৌলিক বদল আনতে পারেনি। জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপারটা দুর্বোধ্য, খুব তাড়াতাড়ি তার ফলাফলও দেখা যায় না। এসব ঘটনা কেবল শিক্ষিত ও পরিবেশসচেতন মানুষকেই উদ্বেল করে। জনসাধারণ চিন্তিত নন, যদি না তার নিজের বাড়িতে আঘাত আসে। যেমন, এ বছরের দাবানল, প্রবল গ্রীষ্ম, বন্যা ও অভ‚তপূর্ব বৃষ্টি। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যারা এতটুকুও ভাবিত ছিলেন না, এই প্রথমবার তারা একটু একটু জানার চেষ্টা করছেন। আইপিসিসির প্রণেতারা দেখাচ্ছেন যে, সব রাষ্ট্র একসঙ্গে হাত মেলালে আসন্ন বিপর্যয় রুখে দেয়া যেতেও পারে। বিপদ কিন্তু একটি দেশকে কেবল আক্রমণ করে না, সব রাষ্ট্রকে একইভাবে করে। করোনা মহামারী তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। জলবায়ুজনিত বিপদও কোন দেশের একার নয়, তা সবার। সম্মিলিতভাবেই তা মোকাবেলা করতে হবে। জাতিসংঘের ২৬তম জলবায়ু সম্মেলন বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য কতটা সুফল আনবে? সেটাই হলো দেখার বিষয়।
×