ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পী সুলতান একজন শিশুমনের মানুষ ত‚য়া নূর

প্রকাশিত: ০০:৫৬, ২৯ অক্টোবর ২০২১

শিল্পী সুলতান একজন শিশুমনের মানুষ ত‚য়া নূর

একদিন সকালবেলা মাহবুব জামাল শামীম ভাই এসে বললেন, কাকু যশোরে এসেছেন, থাকবেন এখানে ও আর্টের স্কুল শুরু করবেন। আঁকা ছবি সঙ্গে করে নাও! দেখা করে আসি। কাকু খুব খুশি হবেন। শামীম ভাই তখন আমার প্রতিবেশী। এক সঙ্গে দলবেঁধে আমরা ছবি আঁকতে বের হতাম। কখনও যশোর পার্কে, কখনও কোন গ্রামে, কখনও ভৈরব নদীর পাড়ে। এস এম সুলতানকে আমরা কাকু বলে ডাকতাম। সবেমাত্র শেষ হওয়া ঢাকার চিত্রকলা একাডেমিতে তার চিত্রপ্রদর্শনী সারাদেশে সাড়া জাগিয়েছে। তিনি এখন যশোরে। খবরটা ছিল সত্যি শিহরণ জাগানোর মতো। স্কুলের নাম ঠিক করেছেন ‘স্কুল অফ ফাইন আর্টস’। ছবি আঁকার পাশাপাশি দেশজ শিল্প যেন মাটি, বুনন ইত্যাদি বিষয়েও ক্লাস হবে। এস এম সুলতান উঠেছিলেন যশোর এম এম কলেজের পুরনো ভবনটাতে। দোতলা এই ভবনটা প্রায় পরিত্যক্ত পড়েছিল। রায়বাহাদুর শ্রী কেশবলাল রায় চৌধুরী এবং পূর্ণগোপাল বসু, তাদের চল্লিশ হাজার টাকার সম্পত্তি একটা একতলা ও একটা দ্বিতল ভবনসহ ১৯৪১ সালে কলেজকে দান করেন। আগে অনেকবার এসেছি এই ভবনের কারুকাজ দেখতে। একটা ঘোরানো সিঁড়ি ছিল ভবনের পেছনে। দোতালার ছাদে ওঠা যেত। ছাদের চারদিকে উঁচু করে কারুকাজ করা পোড়ানো মাটির পাত্র দিয়ে রেলিং দেয়া। কাকু বসেছিলেন দোতলায় শোবার ঘরে খাটের ওপর। শোবার ঘরটা শীতপ্রধান দেশের আদলে তৈরি। ঘর গরম করার ফায়ারপ্লেস ছিল সেখানে। এস এম সুলতানের সঙ্গে সেই প্রথম দেখা। কালো গাউন পরা। পাশে মোটা বাঁশি। লম্বা চুলের শিশুমনের একজন মানুষ। আমার আঁকা ছবিগুলো দেখছেন। আর বলছেন, বাহ! আমি একটা ছড়ার খাতা বানিয়েছিলাম, বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে পাতায় পাতায় রঙিন ছবি। সবশেষে দেখলেন সেই খাতাটা খুব আগ্রহ নিয়ে। তিনি সবটাই দেখেছিলেন ও পড়েছিলেন। কয়েকদিনের ভেতর তার স্কুল শুরু হয়ে গেলো। স্কুলের উদ্বোধন হয় একটু পরে। এই স্কুলটা ছিল ছোট বড় সবার জন্য। দোতলায় পূর্বদিকের রুম ও হলরুমে হতো ক্লাস। রুমগুলো ছিল খুব খোলামেলা আর আসতো প্রচুর আলো-বাতাস। ঢাকার প্রদর্শনীর ঢাউস সাইজের চিত্রকলাগুলো দেয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা একটার পর একটা। তার ছবিগুলো ছিল ভিন্ন রকমের। মানুষের শরীরের পেশির কাজ ছিল অনন্য। পূর্বের ঘরটাতে বসত আমাদের ক্লাস। সেই ক্লাসে আমাদের স্কুলের দুজন শিক্ষকও আসতেন ছাত্র হয়ে। ক্লাস হতো বিকেলে। আমি ছবি আঁকছিলাম মাঝের বেঞ্চে বসে। একটা নদীর ছবি আঁকছিলাম, তাতে একটা মাছ ধরার নৌকা। আর একজন জেলে জাল ছুড়ে মাছ ধরছে। কিন্তু জেলের শরীরের এক্সপ্রেশনটা আসছিল না। কাকু এগিয়ে এলেন। পেন্সিল হাতে নিয়ে জেলের পিঠ, হাত ও পায়ের পেশিতে কয়েকটা টান দিয়ে দিলেন। জেলের মাছ ধরার এক্সপ্রেশনটা তাতে জীবন্ত হয়ে উঠল। কয়েকদিন পর কাকু গেলেন ঢাকাতে। ফিরে এলো এক ট্রাক ভর্তি নানা রকমের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে। এ সময় ক্লাস থেমে থাকেনি। কাকুর কয়েকজন ছাত্র ও শামীম ভাই ক্লাস চালিয়ে গেছেন। ঢাকা থেকে ফেরার পর চলল স্কুল উদ্বোধনের কাজ। তার ছবিগুলো, বাদ্যযন্ত্রগুলো সাজানো মাঝখানের হলঘরটাতে। জেলা প্রশাসক আসবেন উদ্বোধন করতে। আমি গেলাম তাকে আনতে। খবর পেয়ে তিনি নেমে এলেন। আমি পথ চিনিয়ে তাকে নিয়ে এলাম। কাকু ঢাকা যাবার আগে যাদের উপর স্কুল চালানোর ভার দিয়েছিলেন তাদের ভেতর একজন ছিলেন বিমানেশ দা। তিনি ছিলেন খুলনা আর্ট কলেজের টিচার। তার আসতে দেরি হচ্ছিল। অনুষ্ঠানও শুরু হচ্ছে না। ভাবলাম বিমানেশ দা’র জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। হলঘরটার সামনে খোলা বারান্দা। সেই বারান্দা পার হলে উত্তরে ছিল ছাদহীন বিশাল বারান্দা। বারান্দা থেকে দেখলাম বিমানেশ দা রিক্সা থেকে নামছে। আমি ভেতরে এসে কাকুকে খুব খুশি হয়ে বললাম, বিমানেশ দা আসছেন! কাকু দাঁড়ায়ে হাত নাড়ায়ে বললেন, বেশতো! আমি কী তোমার বিমানেশ দা’র স্ট্যাচু বানায়ে রাখব! বলা যায় এই সময়টাতে যশোর শহরে একটা উৎসবের সূচনা হয়েছিল। চলছিল সারাদেশজুড়ে বিজ্ঞানমেলা। যশোরে বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করেছিল সরকারী এম এম কলেজ। আসর বসেছে বিজ্ঞান অনুষদ ভবনে। কলেজের অধ্যক্ষ তখন আব্দুল হাই। তিনি বললেন, চিত্রকলা কেন বাদ যাবে? আয়োজন হলো চিত্র-প্রদর্শনীর। সেই চিত্র-প্রদর্শনী হয়েছিল কলা অনুষদের ভবনে। উদ্বোধন করেছিলেন এস এম সুলতান ও অধ্যক্ষ আব্দুল হাই। মাছিমদিয়া গ্রাম ছিল প্রাণের সঙ্গে বাঁধা। কী আন্তরিকতা দিয়ে উচ্চারণ করতেন ‘মাছিমদিয়া’ নামটা। বারবার ফিরে এসেছেন এই মাছিমদিয়ায়। যশোর ছেড়ে তিনি চলে আসেন নড়াইলে। শুরু করলেন ‘শিশু স্বর্গ’। ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল অনির্দিষ্টকালের জন্য। বাড়িতে এলাম। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কোন নাম নেই। সেবার ছয় মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। শামীম ভাই চারুকলার ছাত্র। বলল, চলো বসে না থেকে ছবি আঁকার স্কুল শুরু করি। স্কুল হবে এস এম সুলতানের ফেলে রেখে যাওয়া পুরনো স্কুল ভবনে। শুরুও হয়ে গেল ক্লাস। অনেকগুলো নাম ঠিক করা হলো। ঠিক হলো কাকু যে নামটা পছন্দ করবেন সেটাই রাখা হবে। কাকু তখন নড়াইলে। চিত্রা নদীর পাড়ে তার নতুন বাড়ি। আর্টের স্কুল করেছেন। নৌযান আছে। তাতে করে শিশুদের ক্লাস নেন। একদিন সকালে যশোর থেকে রওনা দিলাম নড়াইলের উদ্দেশ্যে। গ্রীষ্মকাল তখন। আম কাঁঠালে ভরা। গাছ থেকে শুধু আম না কাঁঠালও ঝুপ করে পড়ে। কাকু আমাদের স্কুলের নাম পছন্দ করে দিলেন। ‘চারুপীঠ’ হলো নাম। বললেন, স্কুল অফ ফাইন আর্টস নামটা তার পছন্দ, তবে নতুন স্কুল নতুন নামেই শুরু হোক। কাকুর বাসার ঢোকার পথেই ছিল একটা চারা নারিকেল গাছ। আমরা মাটি খুঁড়ে সেটা তোলার ব্যবস্থা করলাম। কাকু কাউকে ঠিক করে রেখেছেন। সে এসে অন্যখানে লাগিয়ে দেবে। কাকুর বাড়ির বারান্দায় একটা মাঝারি সাইজের ক্যানভাসে অসমাপ্ত একটা ছবির কাজ পড়েছিল দেয়ালের গায়ে হেলান দেয়া। একটা টেবিলে রং তুলি। ছবিটা একটা চরের ছবি। নতুন চর জেগেছে। সেখানে বসতির আয়োজন। আমি ছবিটার সামনে সামনে দাঁড়িয়ে খুব খেয়াল করে দেখছি। কাকু কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়াল করিনি। তিনি বললেন, ছবিটা শেষ করা হলো না। মনটা ভেঙ্গে গেছে। আঁকার ইচ্ছাটা হারিয়ে ফেলেছি। এই ছবিটা আঁকতে গিয়ে উড়ির চরে ঘূর্ণিঝড় হলো। কত মানুষ মারা গেল। মনে হলো আমিই যেন উড়িরচরে ঘূর্ণিঝড় ডেকে এনেছি। পরে শামীম ভাইয়ের কাছে জেনেছি তিনি ছবিটা শেষ করেছিলেন। আমরা দল বেঁধে চিত্রা নদীতে নেমে ছিলাম গোসল করতে। এই নদীটার আমার অনেক চেনা। টলমলে ছিল তার পানি। জোয়ারের সময় তখন। নদীতে সাতারে মেতেছে সবাই। শামীম ভাইয়ের বোনের মেয়ে আমাদের সঙ্গে। হাতে পায়ে যতটা না বেড়েছে ততোটা বুদ্ধি হয়নি। আমি আগে ভাগে উঠে এলাম। দেখি কাকু দাঁড়ানো ঘাটের উপরে। হাতে একটা বড় টাওয়াল। কাকুর বাসার দুপুরে খেয়েছিলাম। তার ঘরে আমাদেরকে ডাকলেন তার ঘরে। তিনি গল্প করছেন। তার পোষা সাদা কাকাতুয়া ছিল। কথা শিখেছে সেই কাকাতুয়া। কাকু বললেন, ওর শরীরটা ভাল না। শরীর খারাপ থাকলে ওর মুখে কথা ফুটে না। কাকুর বাসায় সেদিন মাছ রান্না হয়েছিল। কে যেন বলল মাছ রান্না খুব ভাল হয়েছে। কাকু বলতে শুরু করলেন, পাকিস্তানে একটা মাছ খেয়েছিলাম। সেই মাছ খেলে বরফ ঠাÐা শীতের রাতে শরীরটা গরম হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী তিনি। তিনি মিশেছেন তার পছন্দের মানুষদের সঙ্গে সহজভাবে। কাকু কথা বলতেন পরিষ্কার উচ্চারণ করে ধীরে সুস্থে। তার কথা বলার ধরনটা এত প্রাঞ্জল ছিল যে চোখের সামনে চিত্রটা ভেসে উঠত। কাকু ভারতের কাশ্মীরের প্রাকৃতিক দৃশ্যের উপর অনেক ছবি এঁকেছিলেন। কাশ্মীর থেকে এসেছিলেন পাকিস্তানে। পাকিস্তানে এসেও প্রচুর ছবি এঁকেছেন। দেশে ফেরার সময় সে মূল্যবান ছবি সব ফেলে রেখে এসেছিলেন। সেই ছবিগুলো এখন ছবির বাজারে উচ্চমূল্যে নিলাম হয়। যাবার সময় হলো। কারু গেট পর্যন্ত এলেন বিদায় দিতে। কাকুর সবকিছু যিনি দেখাশেনা করেন যিনি আমাদের রান্না করে খাইয়েছিলেন, সেই দিদি দৌড়ে এলেন। এই দিদি হলো পদ্মা ও বাসন্তীর মা। মেয়ে দুটো যখন ছোট তখন তার স্বামী তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। কাকু তাকে আশ্রয় দেন। রঙ বানানোর কৌশল শিখেছিলেন। কাকু খুব আদর করে মেয়ে দুটোর নাম ধরে ডাকতেন। কাকুর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন কাকুর সঙ্গে। আমার হাতে বিশ টাকার নোট তুলে দিয়ে বললেন, তোমার টাকাটা নিয়ে যাও। দুপুরে বাজারের জন্য তিনি ধার নিয়েছিলেন। ফেরত দিতে ভুলেননি। আমাদের মতো তিনিও এস এম সুলতানকে কাকু বলে ডাকতেন।
×