ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অদ্বৈত মল্লবর্মণের ছোটগল্প

প্রকাশিত: ০০:৪৩, ২৯ অক্টোবর ২০২১

অদ্বৈত মল্লবর্মণের ছোটগল্প

বাংলা ছোটগল্পের সুদীর্ঘ পথ চলায় একটি অনন্য নাম অদ্বৈত মল্লবর্মণ। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামক কালজয়ী উপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁর এ উপন্যাসটি ছাড়াও রচনা করেছেন ‘শাদা হাওয়া’ ও ‘রাঙামাটি’ শিরোনামের আরো দুটি উপন্যাস। উপন্যাস এবং কবিতার পাশাপাশি অদ্বৈত গল্পও লিখেছেন। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর গল্প ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে তাঁর অনেক গল্প খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে অদ্বৈত গবেষকদের অনেকে উল্লেখ করেছেন। বিদগ্ধ গবেষকগণের প্রকাশিত গ্রন্থে অদ্বৈত‘র গল্পসংখ্যা বিভিন্ন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। ২০০০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত অদ্বৈত গবেষক অচিন্ত্য বিশ^াসের সম্পাদনায় ‘অদ্বৈত মল্লবর্মন রচনা সমগ্র’-তে অদ্বৈত’র গল্প সংখ্যা ৪টি বলে উল্লেখ করেছেন। সেগুলো- ১. বন্দী বিহঙ্গ, ২. সন্তানিকা, ৩. কান্না ও ৪. স্পর্শদোষ। অদ্বৈত মল্লবর্মণ রবীন্দ্র-উত্তরকালের ছোটগল্পকার। বিশ শতকের কুড়ি, ত্রিশ ও চল্লিশ এই তিনটি দশককেই রবীন্দ্র-উত্তরকাল ধরা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর সময়কালের কিছুটা সময় এবং পরবর্তী উক্ত দু-চার দশকে বাংলা সাহিত্যে বিশ^মানের ঋদ্ধ ছোটগল্পের একটি ঐতিহ্যিক ভুবন যাঁরা নির্মাণ করে গেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ তাঁদেরই একজন। তাঁর জন্ম পরিবেশ, বংশকৌলীন্য বা অকৌলীন্য বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা গল্পের সংখ্যা বিচারে এ গৌরবের কোন হেরফের হয় না। জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোকে অবলম্বন করেই তিনি গল্প লিখেছেন। অদ্বৈত ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। উচ্চাকাক্সক্ষী নিরীক্ষাপ্রবণ গল্পলেখকের ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়ে থাকে, গল্পের মুখোশ তৈরি করতে গিয়ে অনেক সময় মুখশ্রী ঢাকা পড়ে যায়। গল্পের বিন্যাসভঙ্গিতে অধরা থেকে যায় জীবনের মাধুর্য-সুষমা-অভিঘাত। অদ্বৈত’র গল্পে সেই মুখোশ তৈরির প্রবণতা নেই। আত্মিক সৌন্দর্যেই তাঁর গল্পের কাঠামো নির্মিত হয়েছে। জীবনের গভীর চৈতন্যে ঘা দিতে গেলে যে-আত্মলগ্ন নিঃশব্দ অনুসন্ধান প্রয়োজন, অদ্বৈতর গল্পে তার দেখা পাওয়া যায়। তাঁর রচনাশৈলীর ইঙ্গিতময় অভীপ্সা ও প্রসাদগুণ তারই সাক্ষ্য দেয়। একজন প্রকৃত শিল্পীর সংবেদনশীল মন অদ্বৈতর ছিল। আর তাই মাত্র ৩৭ বছরের জীবন সময়ের মধ্যেই উপন্যাস, কবিতা ও অন্যান্য রচনা ছাড়াও গল্পে তাঁর শিল্পমানস পরিপূর্ণতা লাভ করতে পেরেছিল। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ছোটগল্পে সমকালীন পটভূমির গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাঁর প্রায় সকল গল্পেই স্বকালের সমাজবাস্তবতা, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘনঘটা, মানবিক ও মানসিক দন্ত-সংঘাত ইত্যাদি ফুটে উঠেছে। হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত জীবন-প্রয়াসই অদ্বৈতর তিতাস পারের জন-জীবন। তাঁর শৈশবের তিতাস পারের স্মৃতির অনুরণন, কলকাতার জীবন-বাস্তবতা, পেশাগত-কর্মপরিধির ভেতর মানসিক, মানবিক ও মান-সম্মানগত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, অর্থনৈতিক টানপোড়েন, সাংসারিক আশা-হতাশা ইত্যাদি বিষয়াবলি গল্পের নায়ক আবু মিয়ার ছায়া-চিত্রে অদ্বৈত নিজের জীবনের একটি রেখা-চিত্র তিনি নিটোল বর্ণনায় তুলে ধরেছেন তাঁর বন্দী-বিহঙ্গ গল্পের শরীরে। গল্পটি ১৩৫২ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। আবু মিয়া কলকাতার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। তার প্রবাস জীবনের গÐি মেস-পত্রিকা অফিস-মেস। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য আবু মিয়ার মনে বিভিন্ন রকম চিন্তা বয়ে আনে। গায়ের আকাশ, পুকুর, গাছ-গাছালি, পরিবেশ প্রকৃতি ইত্যাদির সঙ্গে গ্রামে রেখে আসা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দিন-রাতের টুকরো টুকরো অসংখ্য স্মৃতি তার মনের পর্দায় ভেসে উঠে। যদিও অদ্বৈত মল্লবর্মণ অকৃতদার ছিলেন। তথাপি তিনি আবু মিয়ার জীবনের ভেতর দিয়ে নিজের একটা সাংসারিক জীবনের ছায়া-চিত্র অঙ্কন করেছেন। আবু মিয়ার স্ত্রী জমিলা পশুপতিপুর নামে এক নির্মল গ্রামে দুই ছেলে রুমু-জুমু এবং এক মেয়ে পান্নাকে নিয়ে পিত্রালয়ে থাকে। সেখান থেকে চিঠি লেখে জমিলা। জমিলার চিঠির বক্তব্য-অনুষঙ্গে ফুটে উঠে আবু মিয়া-জমিলার দাম্পত্যছবি, ছেলে-মেয়েদের জন্য তাদের উদ্বেগ-উচ্ছ¡াস, সংসার-বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণাকাতর চিত্র। অদ্বৈতর সন্তানিকা গল্পটি ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে ভারতবর্ষ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। গল্পের প্রধান চরিত্র উচ্চ প্রাইমারী স্কুলের সাবেক হেডমাস্টার নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ ধনঞ্জয় ঘোষাল। স্কুলটি উঠে যাওয়ায় তার কপাল পুড়েছে। পেটপুড়ে খাওয়া ও আশ্রয়ের জন্য কাকুতি মিনতি করে গৃহ শিক্ষক হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে সে কুলীন ব্রাহ্মণ বীরেশবাবুর গৃহে। গৃহকর্তার স্ত্রীকে গিন্নিমা হিসেবে সম্বোধন করে তার ¯েœহ-প্রবণ মনের স্পর্শ লাভ করে। কিন্তু বাড়ির কর্তাকে তার বড় ভয়। তাকে সে সর্বশক্তিমান বলেই মনে করে। সৃষ্টিকর্তার কোন একটা অংশই যেন সেই আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণ। ইচ্ছে করলেই যেন বীরেশবাবু ধনঞ্জয়ের মৃত্যুর ওপর কারিকুরি করতে পারেন। বেঘোরে মরাটাকে সে বড় ভয় করে। মরণকালে কারোর মুখ দেখতে পাবে না, পাশর্^বর্তী কারোর বেদনার্ত কণ্ঠস্বর বা ¯েœহময় হাতের পরশ পাবে না, ধনঞ্জয় ঘোষাল তা মানতে পারে না। তাই সে এ নিশ্চিত নিরাপদ আশ্রয়টা হারাতে নারাজ। তবু বৃদ্ধের দীর্ণ বুক যেন কেঁপে উঠে অনিশ্চিয়তায়: ‘কিন্তু ওই অটল শক্তিধর মুখখানার দিকে তাকাইলে সে ভরসা মোটেই থাকে না। বিধাতা কি কঠোর করিয়াই না ঐ মুখখানা সৃষ্টি করিয়াছেন! বিশে^র অর্ধেক কঠোরতা ওই মুখে ঢালিয়া দিয়াছেন। আর তাহা না হইবেই না কেন? ¯্রষ্টার প্রতিনিধি ত তিনি! সৃষ্টিকর্তার মুখই বা কোন কোমলতায় গড়া...’ গল্প সমগ্র: অদ্বৈত মল্লবর্মণ, গল্প-সন্তানিকা, পৃষ্ঠা-২৩। এরপরও বীরেশবাবুর ছেলে নরেশ পরীক্ষায় ফেল করলে তিনি বৃদ্ধকে বাড়ি থেকে বিদেয় করে দেন। বৃদ্ধ গিন্নীমার সদয় দৃষ্টি ও অনুকম্পা আকর্ষণেও ব্যর্থ হয়। তখন দীর্ঘ দিনের সেই জীর্ণ পুটলিটা আবার কক্ষে তুলিয়া লয়। কিন্তু সারাদিন অদূরের বটগাছের নিচে কাটিয়ে অভুক্ত অবস্থায় আবার ফিরে এসে গিন্নীমার অনুকম্পা আশা করে শত কষ্টে হাসবার চেষ্টা করে বলে-আবার এসে পড়েছি গিন্নীমা। সর্বহারা এ বুড়ো ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে গিন্নীমারও দরদ উথলে উঠে। অদ্বৈতর ‘কান্না’ গল্পের মূখ্য চরিত্র ‘গুরুদয়াল’। তার জীবন চরিত অদ্বৈত যেভাবে অঙ্কন করেছেন তাতে দেখা যায়-গুরুদয়াল সদ্য স্ত্রী বিয়োগের শোকে শোকাগ্রস্থ পিতা-মাতাহীন নিঃসঙ্গ এক ছন্নছাড়া মানুষ। কখন ঘর থেকে বের হয়ে যায় আর কখন ফিরে তার কোন হিসেব-নিকেশ নেই। তার সংসারে সে ছাড়া অন্য কোন সদস্য নেই। তবু সে তার বাড়ির একমাত্র অধিশ^র। দূর সম্পর্কের একমাত্র পিসি যে কি না গুরুদয়ালের এ ছন্নছাড়া আচরণ প্রত্যক্ষ করে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তার ¯েœহদগ্ধ মন ব্যাকুল হয়ে পড়ে যেকোন সময় গুরুদয়াল একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে এবং সন্ন্যাসী-টন্নাসী জীবন বেছে নেবে এই ভাবনায়। সত্যিই একদিন কাউকে কোন কিছু না বলে গুরুদয়াল নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কিন্তু নিরুদ্দেশেও সে বেশিদিন থাকেনি। ফিরে আসে ঘরে। তবে চেহারা-সুরত এবং আচরণে পরিবর্তন আসে তার। আগে যেখানে ঘরে একেবারেই মন বসত না তার সেখানে সে ঘর থেকে বের হয় না। কথাও বলে প্রচুর। ‘ছিরিক্ষেত্র, বিন্দেবন’, নানান মানুষ, সাধু-সন্নেসী দর্শনের কথা বলে। এতে তার সম্পর্কে সবার ধারণায় পরিবর্তন আসে। তারা ভাবে সে অনেক জ্ঞান অর্জন করে এসেছে। এজন্য অনেকেই ঝুপ করে তার পায়ের ধুলাটা নিয়ে ফেলে। কিন্তু যৌন সন্তাপিত আলো-আঁধারি মনের মানুষ হঠাৎই সবাইকে স্তম্ভিত করে সে বিধবা বিবাহের উদ্যোগের কথা জানায়। বেশ-ভূষা, চেহারায় আর ব্যবহারে আবার পরিবর্তন আসে। কিন্তু এ বিয়ে ভেঙে যায় তার। আবারও গৃহ ত্যাগ করে সে। এবং গ্রামবাসীকে হতবাক করে ফিরে আসে নব পরিণীতা স্ত্রীসহ। বউটি পিতৃ-মাতৃহীন এতিম ও বিশ্রী। তাকে মোটেই ভালবাসে না গুরুদয়াল। অত্যাচার করে। মারধর করে। যেন বিধবা আহ্লাদীকে বিয়ে করতে না পারার জন্য প্রতিশোধ মেটায় এতিম এ বউটির ওপর। বউটি সকল অত্যাচার প্রতিবাদহীন নিরবে সহ্য করে। একদিন গোকর্ণঘাট হতে তিতাস নদীপথে নবীনগর যাবার পথে লঞ্চের মধ্যে গুরুদয়ালের সাক্ষাৎ হয় আহ্লাদীর সঙ্গে। আহ্লাদীর গা-ঘেঁষা কোমল আচরণে এবারই বিভ্রান্ত হয়। জৈবিক কামনার আগুন গুরুদয়ালকে গ্রাস করে। আহ্লাদী তখনো জানে না গুরুদয়ালের বিবাহের কথা। আহ্ললাদী জানায় এক বুড়োর সঙ্গে দু‘দিন পর তার বিয়ে। বিয়ের আসর থেকে তাকে নিয়ে পালিয়ে আসার জন্য গুরুদয়ালকে প্রলুদ্ধ করতে চায় সে। আহ্লাদীর কামনার উত্তাপ পাওয়ার জন্য বিয়ের দিন গুরুদয়াল তৈরি হয়। কিন্তু বিকেলে বিশ্রী বউটির ¤øান মুখ দেখে তার যেন কি হয়ে যায়। বাধাগ্রস্ত হয় গুরুদয়াল। অদ্বৈত এ বাধাগ্রস্ত মুহূর্তের বর্ণনা দেন এভাবে : ‘একখানা কলমুখর অপূর্ব সৌন্দর্যমÐিত মুখ, আর একখানা নির্বাক শ্রীহীন বেদনাময় মলিন মুখ। অন্যসময় হইলে সে অনায়াসে বউটিকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতে পারিত কিন্তু আজ তাহার কি যেন হইল, সে দুঃখদগ্ধ রূপহীন মুখখানার দিকে চাহিয়া কেবল ভাবিতেই লাগিল। ভাবিল, এটা বড় অসহায়।’ গল্প সমগ্র: অদ্বৈত মল্লবর্মণ, গল্প-কান্না, পৃষ্ঠা-৩৪। ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত সময়ে হিটলারের তাÐব ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পরিসরে মন্বন্তরের পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় অদ্বৈতর স্পর্শদোষ গল্পটিতে। এ গল্পের প্রধান চরিত্র ভজা। যুদ্ধের তাÐবে সৃষ্ট ভয়াবহতায় তৈরি হয় খাদ্যাভাব। খাদ্যভাবের তাড়নায় একটি মানুষ, মানুষ থেকে টোকাই, টোকাই থেকে ভিখিরি, অতঃপর ভিখিরি থেকে জন্তুতে রূপান্তরের এক মর্মান্তিক চিত্রাঙ্কন করেছেন অদ্বৈত। এর জন্য সাদৃশ্য দেখাতে উপমান হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন খেঁকি নামের একটি নেড়ি কুকুরকে। লেখকের শৈল্পীকতায় ফুটে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ^ যুদ্ধের ভয়াবহ জীবন দুর্যোগের চিত্র যেমন মানুষের প্রতিনিধি ভজা ও ইতর প্রাণী খেঁকীর মধ্যে। ভজা ও খেঁকী দু‘জনই যখন খাদ্যের খোঁজে দিশেহারা। তখন একজনের হাঁটু ও আরেকজনের থুঁতনির সংঘর্ষে চিনে নেয় একে অপরকে। কিন্তু খাবার সংগ্রহকে কেন্দ্র করে ভজা ও খেঁকীর মধ্যে আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত সংঘর্ষের আয়োজনে তাদের মধ্যে কোন প্রকার সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত প্রসারিত হয়নি। বরং ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই তাদের পরস্পরের প্রতি প্রতিযোগী করে তুলে। খেঁকীর লুণ্ঠিত খাদ্যের আশায় ভজা এগিয়ে গেলে খেঁকী মারমুখী হয়ে উঠে। অদ্বৈতর ভাষায় : ‘মানুষের বন্ধুত্ব ও সাহচার্য জীবনে ভজা অনেক পাইয়াছে। অবস্থা-বিপর্যয়ে মানুষ তাহাকে পর করিয়াছে। এখন ইতর জীবের সঙ্গে বন্ধুত্বে তাহার আপত্তি নাই। ক্ষুধার্ত সে, পরম আগ্রহে অগ্রসর হইয়া খেঁকীর কোলের কাছে তাহার হাতখানা বাড়াইল। খেঁকী ইহাতে অসন্তুষ্ট হইয়া এমন ভাব দেখাইল যেন লুণ্ঠিত মালের অংশ দিতে সে মোটেই প্রস্তুত নয়। সে একখানা থাবা উঠাইয়া মুখব্যাদান করিয়া নখ ও দাঁত দেখাইল এবং মুখে একপ্রকার শব্দ করিয়া অসন্তোষ জানাইল। জোরজবরদস্তি করিলে একটা রক্তারক্তি ব্যাপার হইবে বুঝিয়া ভজা পৃষ্ঠভঙ্গ দেওয়াই শ্রেয় মনে করিল।’ গল্প সমগ্র: অদ্বৈত মল্লবর্মণ, গল্প-স্পর্শদোষ, পৃষ্ঠা-৪০। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ছোটগল্প ‘বিস্ময়’-এর প্রধান চরিত্র শ্রীপতি। তিনি ফরিকহাট রেল স্টেশনের সরকারী চাকুরে। প্লাটফরমের লোহার বেড়ার একমাত্র দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়া যাত্রীদের একজন বুড়ো তার হাতে আট আনার একটি আধুলি গুজে দিতে চায়। শ^শুড়বাড়ির লোকজন কর্তৃক নির্যাতনের শিকার মেয়েকে নায়ওর নিয়ে এসেছে বুড়ো। সময়ের অভাবে টিকিট কাটতে পারেনি। গোমটার নিচে মেয়েটির কাতর চাহনি দেখে শ্রীপতির অন্তরের কোন অজানা স্থানে যেন একটু ব্যথা বেজে উঠে। বিপতœীক শ্রীপতি তার বিগত প্রিয়তমা স্ত্রীর সরযূর কথা মনে করে ভেতরটায় হাহাকারের সুর অনুভব করে। বাপের বাড়িতে নায়ওর যাওয়া সরযূর মৃত্যুর টেলিগ্রাফ এলে স্টেশন মাস্টার তাকে সান্ত¦না দিতে এসে পুনরায় তাকে বিয়ের কথা বললে কথাটি শ্রীপতির কানে বিষের মতোই ঠেকেছিল। অদ্বৈতর ভাষায় : ‘সরযূর কথা ভাবিতে একটা তৃপ্তি আসে, শূন্যতার হাহাকারের অন্তরালে এক অপূর্ব অনুভূতি যেন আশ^াস দিয়া বলে, আমি আছি, যুগ-যুগান্তর থাকিব। শ্রীপতি ভাবে, সরযূ তাহার জন্ম-জন্মান্তরের সরযূ-একদিন তাহার সহিত দেখা হইবেই।’ গল্প সমগ্র: অদ্বৈত মল্লবর্মণ, গল্প-বিস্ময়, পৃষ্ঠা-৫৫। স্ত্রীর প্রতি এমন অনল অটল ভালোবাসার স্থানটি শ্রীপতি পূরন করতে চেয়েছিল ভিন্ন এক ভালোবাসায়। পূজার ছুটিতে শ্রীপতি পল্লীতে বসবাস করা তার মাসীমার বাড়ি বেড়াতে যায়। সেখানে বিধবা বিনোদিনীর কণ্ঠে বিরহ-বিচ্ছেদের গান শুনে তার মনে হয় সরযূর বিরহ-বিচ্ছেদে হাহাকারপূর্ণ প্রাণটা জুড়াইতে বিনোদিনীর সঙ্গলাভ জরুরী। তাই তাকে বিয়ে করে নিয়ে ফকিরহাট চলে আসে শ্রীপতি। অদ্বৈতর বর্ণনায় : ‘শ্রীপতির চোখের সামনে যেন ছল্ ছল্ করিতে থাকে সরযূর অশ্রæভরা চোখ দুটি, কি কাতর বেদনায় ভরা! শ্রীপতি কেমন যেন মনমরা হইয়া যায়। কোথা দিয়া যে কি হইয়া গিয়াছে তাহা সে পূর্বাপর স্মরণ করিতে চেষ্টা করে, কল্পনায় শুনিতে পায় সেই গান, সেই সুর, যাহা সে প্রথম বিনোদিনীর কণ্ঠে শুনিয়াছিল। চোখের সামনে ভাসমান সরযূর ক্ষীণ ছায়ামূর্তিটিকে অভয় দিয়া বলে, তোমাকে ভুলিব না, তোমাকে বাঁচাইয়া রাখিবার জন্যই আমার এই আয়োজন।’ গল্প সমগ্র: অদ্বৈত মল্লবর্মণ, গল্প-বিস্ময়, পৃষ্ঠা-৬৩। পঞ্চাশের মন্বন্তর-এর কথা অদ্বৈত তাঁর তিতাস পারের জন্ম গ্রাম গোকর্ণঘাটের চির অভাবি জেলেদের যাপিত জীবন ও প্রেম-ভালোবাসার সমন্বয়ে বর্ণনা করেছেন ‘জাল ফেলা-জাল তোলা’ গল্পে। এ গল্পের প্রধান চরিত্র গৌরাঙ্গসুন্দর বা গৌরা। তার জবানিতেই অদ্বৈত বর্ণনা করেন তার বড় দাদা জাল ফেলে কৃষিকাজের দিকে ঝুঁকে পড়া ও তাতে জেলেপাড়ার বিভিন্ন জনের তাকে নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টা-মস্কারির কথা। শুধু ঠাট্টা-মস্কারি করেই ক্ষান্ত হয় না তারা। মাতব্বরের মাধ্যমে তাকে একঘরেও করে ছাড়ে। কিন্তু তাতে দমে যায় না গৌরার দাদা নইদাবাসী। সে একেবারেই জাল থেকে দূরে সরিয়ে নেয় নিজকে। এবং জমি বন্ধক রেখে ফিশারি ব্যাংকের বাবুদের কাছ থেকে সুদে বিয়ের পনের টাকা নিতে গেলে বাদ সাধে গৌরা। তার সাফ সাফ কথা-বিয়া করবা তুমি আর কাঠগড়ায় মাথা লাগামু আমি। এতে ক্ষিপ্ত হলো নইদাবাসী। গৌরার জবানিতে অদ্বৈত’র ভাষায় : ‘দাদা দপ করে জ¦লে উঠল : জ্যেষ্ঠ ভাইয়ের বিয়াতে বাদ সাধলি বেইমান, যদি আমি সত্যের জ্যেষ্ঠ ভাই হইয়া থাকি, তোর মাথায় এ জীবনে শোলার মটুক উঠবে না রে গৌরা, এ আমি কইয়া রাখলাম।’ গল্প সমগ্র : অদ্বৈত মল্লবর্মণ, গল্প-জাল ফেলা-জাল তোলা, পৃষ্ঠা-৬৯। ফিশারি ব্যাংকের টাকা তাদের নৌকা ও জাল বন্ধক রেখে জেলেপাড়ার অনেকেই ঋণ নিয়েছিল। সে ঋণ শোধ দিতে পারেনি কেহই। কম সুদের ঋণ চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে আসল ছাড়িয়ে গিয়েছিল। জেলেদের চোখে তখন বিভীষিকা। এমন দুর্যোগপূর্ণ সময়ে তাদের সামনে এসে উপস্থিত হল পঞ্চাশের মন্বন্তর। উজান-চরের খাঁড়িতে জাল ফেলতে ও জাল তুলতে গিয়ে গৌরার একটি মেয়েকে পছন্দ হয়। মেয়েটিকে বিয়ের কথা বললে, সে বলে আমি তোমার মাছগুলোর মতো কানা নয় যে গিয়ে তোমার জালে উঠবো। আমাকে নিতে হলে এখানে এসে ধরে নিতে হবে। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তমোনাশের মন’ এবং ‘বিস্ময়’ শিরোনামের গল্প দুটিকে একটি গল্প বলেই মনে হয়েছে। ‘তমোনাশের মন’ গল্পটির পাÐলিপি সংশোধিত করেই কি ‘বিস্ময়’ গল্পটি লিখেছিলেন কি না অদ্বৈত তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। এমনও হতে পারে ‘তমোনিশার মন’ গল্পটি কোন পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর সেটিকে সংশোধন-সংযোজন করে পরবর্তীতে তিনি সেটিকে ‘বিস্ময়’ শিরোনামে কোন পত্রিকায় ছাপতে দিয়েছিলেন। কারণ দুটি গল্পের কাহিনী এবং চিত্রপ্লট একই। ‘তমোনাশের মন’-এর তমোনাশ এবং ‘বিস্ময়’-এর শ্রীপতি উভয়ই ফকিরহাট স্টেশনের টিকিটবাবু। দুটি গল্পেই বিনোদিনীকে দেখা যায় একই চরিত্রে। দুটি গল্পেই বিনোদিনীর সুরেলা কণ্ঠের গান শুনেই বিধবা বিনোদিনীকে বিয়ে করে তমোনাশ ও শ্রীপতি। পার্থক্য শুধু বিনোদিনীর আগে তমোনাশের কোন স্ত্রীর উল্লেখ নেই আর শ্রীপতির সরযূ নামের বিগতা এক স্ত্রীর কথা উল্লেখ আছে যার কথা শ্রীপতি কখনও ভুলতে পারে না। অদ্বৈতর আশালতা গল্পে তিনজন আশালতার কাহিনীর বয়ান করা হয়েছে, যাদের সকলেই নিজেদের কিংবা স্বামী-পুত্রদের অন্ন-বস্ত্র ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনীয় উপাদানের অভাবে মৃত্যুবরণ কিংবা আত্মহত্যা করেছে। তবে তাদের মৃত্যুর সঠিক কারণ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেলেও সরকারের পক্ষে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে মৃত্যু কার্যকরণের বিপরীত কারণ উল্লেখ করে নিজেদের পীঠ বাঁচিয়েছেন। এখানে লেখক সরকারের অযোগ্যতা ও মিথ্যাশ্রয়ের প্রতি কটাক্ষ-ইঙ্গিত দিয়েছেন। ‘আর সাঁঝের মজলিস গানের মূল্য’ গল্পটি অদ্বৈত মল্লবর্মণের লোককাহিনী ধাঁচের একটি গল্প। গল্পটিতে জোলার গান কেনা এবং গাওয়ার মাধ্যমে তার অজান্তেই চোর ধরা পরার বিষয়টির মতো অনুরূপ গল্প গ্রাম-বাংলার লোক মুখে শুনতে পাওয়া যায়। গল্পটিতে জোলার গানের বিভিন্ন পঙক্তির মধ্যে গ্রামীণ লোক সংস্কৃতির আকর প্রাধান্যতার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মোটকথা অদ্বৈতর গল্প সংখ্যা ৪টি, ৫টি কিংবা ১০টি, যে কটিই হোক তার প্রতিটি গল্পই তাঁকে ভিন্ন ধাঁচ ও ভিন্ন বলয়ের একজন সফল ছোটগল্পকার হিসেবে পরিচিত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। প্রায় সকল গল্পের বয়ানেই কাহিনীর প্রয়োজনে অদ্বৈত ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট বা প্লটের অবতারণা করলেও আমরা যা দেখি তা হলো- প্রধান প্রধান চরিত্রগুলোর আর্থিক, মানবিক ও মানসিক অভাব, দারিদ্র্যতা, অসহাত্ব, বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং জীবনযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার মর্মন্তুত ও নির্মম গল্প।
×