ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আসছে ভারত ও মিয়ানমার থেকে

নতুন ধরনের ইয়াবা ভয়ঙ্কর

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ২৯ অক্টোবর ২০২১

নতুন ধরনের ইয়াবা ভয়ঙ্কর

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ ভয়ঙ্কর নতুন ইয়াবা এখন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত ও মিয়ানমার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ঢুকে নতুন ইয়াবার চালান। নতুন ভার্সনের ইয়াবা এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মাদকসেবীদের কাছে। দিন দিন তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি ইয়াবার কয়েকটি চালান উদ্ধারের পর রাসায়নিক পরীক্ষাগারেও এ ধরনের ইয়াবার সন্ধান পাওয়া গেছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্র জানায়, শতাধিক প্রকারের ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে। নতুন এই ইয়াবার বেশিরভাগ আসছে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে। পাশাপাশি মালয়েশিয়া ও মায়ানমারে তৈরি হচ্ছে। মূলত এই তিন দেশ থেকে এগুলো ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে মাদক কারবারিরা। লালবাগের প্লাস্টিক ব্যবসায়ী রুবেল। এক সময় বন্ধুদের সঙ্গে পড়ে রাত জেগে নিয়মিত মরণনেশা ইয়াবা সেবন করতেন। এক পর্যায়ে এতে ইয়াবার সেবনের কারণে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। দিন-রাত ঘুম হতো না তার। এক পর্যায়ে কয়েক মাস আগে তার এক বন্ধু তাকে নতুন ইয়াবা সেবনে উৎসাহিত করে। নতুন ইয়াবা খাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যেই চলে আসে ঘুম। এক পর্যায়ে নতুন ধরনের ইয়াবা সেবন এক সময় তার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। কিন্তু এর কিছুদিন পর তার শরীরে দেখা নানা ধরনের মারাত্মক উৎসর্গ। ঠিকমতো খেতে পারেন না। হাত ও পা কাঁপাকাঁপি করে। জ্বালা-পোড়া করে। দিনরাত অস্থিরতার মধ্যে তাকে কাটতে হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ভয়ঙ্কর আইস দিয়ে তৈরি নতুন ইয়াবা মাদকসেবীদের কাছে ফেবারিট হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি ইয়াবার কয়েকটি চালান উদ্ধারের পর রাসায়নিক পরীক্ষাগারেও এ ধরনের ইয়াবার সন্ধান পাওয়া গেছে বলে পুলিশ সূত্র জানায়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নতুন এই ইয়াবায় রয়েছে মিথাইল, এমফিটামিন ও হেরোইনের উপাদান। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাদের দাবি মাদকের নতুন ভার্সন আইস নিয়ে তারা এমনিতেই চিন্তিত। এরপর ইয়াবার নতুন এই ভার্সন এখন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানতে চাইলে সিআইডির রসায়ন পরীক্ষাগারের প্রধান কর্মকর্তা দীলিপ কুমার জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের ইয়াবার নমুনা পাঠানো হয়। সেখানে দেখা গেছে আগে ইয়াবায় মূল উপাদান হিসাবে ম্যাথামফিটামিন ও ক্যাফেইন ব্যবহার করা হতো। কিন্তু সম্প্রতি যেসব নমুনা পাঠানো হচ্ছে সেখানে রয়েছে মিথাইল, এমফিটামিন ও হেরোইনের উপাদান। এ ধরনের উপাদান ব্যবহারের কারণে মাদকসেবীরা তা সেবনের পর দ্রæত ঘুমিয়ে যায়। আবার বেশি সেবন করলে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। সূত্রগুলো জানায়, গত সেপ্টম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বনশ্রী, বারিধারা, উত্তরা থেকে ৫০০ গ্রাম আইস ও পাঁচ হাজার ইয়াবাসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, রুবায়াত, রোহিত হোসেন, মাসুম হান্নান, আমানুল্লাহ, মোহাইমিনুল ইসলাম ইভান, মুসা উইল বাবর, সৈয়দা আনিকা জামান ওরফে অর্পিতা জামান, লায়লা আফরোজ প্রিয়া, তানজিম আলী শাহ ও হাসিবুল ইসলাম। এই চালানটির তিনদিন আগে ৫শ’ গ্রাম আইস এবং ৬৩ হাজার পিস ইয়াবাসহ সাত জনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। দুই মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামে চারটি আইসের চালান জব্দ করে র‌্যাব ও পুলিশ। উদ্ধারকৃত প্রায় সব চালানেই আইসের সাদা গুঁড়ো বা কাঁচামাল পাওয়া গেছে। এসব মালামাল পরীক্ষার জন্য রসায়নগারে পাঠানো হলে ইয়াবার মধ্যে মিথাইল, এ্যামফিটামিন ও হেরোইনের উপাদানের মিল পাওয়া যায়। ক্রিস্টাল মেথ বা মেথা-এ্যামফিটামিন প্রধানত তৈরি হয় থাইল্যান্ডে। পাশাপাশি মালয়েশিয়া ও মায়ানমারে তৈরি হচ্ছে। মূলত এই তিন দেশ থেকে এগুলো ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে মাদক কারবারিরা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্রে জানায়, এক সময় ইয়াবা ব্যবহার করা হতো রাত জেগে থাকার জন্য। এতে ইয়াবাসেবীরা এক ধরনের আনন্দ উপভোগ করত। কিন্তু ইয়াবা তার আগের রূপ থেকে বেরিয়ে এসেছে। বর্তমানে বাজারে যেসব ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে সব সেবনের সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ছে ইয়াবাসেবীরা। অনেকে বিষয়টি ভালভাবে নিলেও ইয়ার নতুন এই ধরন দিয়ে দ্বিধাদ্ব›েদ্ব দেখা দিয়েছে সেবীদের কাছে। স্বাদে তিতা হওয়ার কারণে কিছু সেবীর কাছে এটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আবার অনেকে নতুন এই মাদক সাদরে গ্রহণ করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসির এক কর্মকর্তা জানান, শুরুর দিকে ওজন কমাবার জন্যও অনেকেই ইয়াবা ট্যাবলেট সেবন করত। পরবর্তী সময়ে রাত জেগে থাকা শিক্ষার্থীরা, লংড্রাইভের চালকরা এর ব্যবহার শুরু করে। অনেকেই যৌন উত্তেজক হিসেবে ইয়াবা সেবন করতে থাকে। ইয়াবা সেবনে সাময়িকভাবে সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দেয়ায় দ্রæতই তা বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এর আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় ছেড়ে দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। আগে চার ধরনের ইয়াবা পাওয়া যেত। গাড়ে লাল রঙের চম্পা, গোলাপি রঙের আর সেভেন, হালকা গোলাপি রঙের জেপি ও ডগ নামের মাটি রঙের ইয়াবা অন্যতম। তিনি আরও বলেন, এসব ইয়াবা সেবনের কারণে মাদকসেবীদের মাঝে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু হয়। শরীর নিস্তেজ হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, গলা মুখ শুকিয়ে যাওয়া, শরীর ঘামতে থাকা, অনবরত গরম অনুভূত হওয়া, নাড়ির গতি বৃদ্ধি পাওয়া, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা ও শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পাওয়া, যৌন উত্তেজনা চিরতরে লোপ পাওয়া অন্যতম। এসব কারণে রক্তনালী ছিঁড়ে অনেকের ব্রেন হেমারেজ হয়, স্মৃতিশক্তি কমে যায়, মানসিক ভারসাম্য দেখা দেয়। বেশি পরিমাণ ইয়াবা সেবন শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে ইয়াবা ছেড়ে আইসের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু আইসের দাম বেশি হওয়ায় তা সাধারণ মাদকসেবীদের কাছে সোনার হরিণ হয়ে দেখা দেয়। এ কারণে নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছে মাদক কারবারিরা। তারা আইসের কিছু উপকরণ দিয়ে ইয়াবার নতুন এই ভার্সন চালু করে বাজারজাত করার চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, চার ধরনের ইয়াবা ছেড়ে এখন বাজারে শতাধিক প্রকারের ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে। সাদা টিস্যু, পেস্ট, পেঁপে, কমলা, গাড়ো লাল, হলুদ, মাটি, হালকা লাল রঙের আট থেকে দশটি করে কোয়ালিটি বাজারজাত করা হচ্ছে। ইয়াবা কে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বিভিন্ন ফলের ফ্লেভারের সংমিশ্রণ করা হয় যাতে করে যুব সমাজ ইয়াবার প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। ২০১৮ সালে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়-মাদকসেবীদের ৫৮ ভাগ ছিল ইয়াবাসেবী। বর্তমান তার সংখ্যা ৮০ ভাগ। বাকি ২০ ভাগ বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত। নতুন এই ইয়াবার বেশিরভাগ আসছে ভারত ও মিয়ানমার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে। এর মধ্যে রয়েছে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী, জামালপুরের বকশীগঞ্জ, শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি-নালিতাবাড়ী, ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট ধোবাউড়া, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, সিলেটের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও কক্সবাজারের টেকনাফ অন্যতম। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, টেকনাফ সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে ইয়াবা পাচারের রুট পরিবর্তন করেছে মাদক কারবারিরা। তারা এখন সরাসরি দেশে ইয়াবা না পাঠিয়ে আগে ভারতে পাচার করে। তারপর এসব সীমান্ত ব্যবহার করে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি। আগে ১৫-২০ টাকায় সীমান্তে পাইকারিভাবে ইয়াবা পাওয়া গেলেও বর্তমান তার দাম বেড়ে ঠেকেছে ৭০-৮০ টাকায়। ইয়াবার রূপ পরিবর্তন হয়েছে তা সত্য। ইয়াবার মূল কারবার হচ্ছে মিয়ানমারে। ইয়াবা কারখানাগুলো বন্ধ করতে ওই দেশের সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়ত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।
×