ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চউকের ৯শ’ কোটি টাকা ব্যয়

চট্টগ্রামে ফ্লাইওভারগুলোর অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২৯ অক্টোবর ২০২১

চট্টগ্রামে ফ্লাইওভারগুলোর অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ মহানগরীতে ফ্লাইওভার নির্মাণ শুরু হয়েছিল বহদ্দারহাট উড়াল সড়ক দিয়ে। আর শুরুতেই ছিল বিতর্ক এবং নানা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ। শুধু তাই নয়, ওই স্থানে একটি ফ্লাইওভার আদৌ দরকার ছিল কিনা তা প্রশ্ন উঠেছিল তখনই। এছাড়া নির্মাণ কাজে অদক্ষতা যে ছিল, তা প্রমাণ হয়েছে গার্ডার চাপা পড়ে ১৪টি প্রাণ ঝরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। অভিযোগ রয়েছে যে, বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারটি তৎকালীন চউক (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) চেয়ারম্যন নির্মাণ করেছিলেন প্রধানত চমক দেখানোর জন্য, যা হয়েছে ব্যক্তির একক ইচ্ছায়। এক্ষেত্রে নগর বিশেষজ্ঞরা কোন উচ্চবাচ্য করেও লাভ হয়নি। কাজটি হয়েছে অনেকটা গায়ের জোরে। এরপর আরও তিনটিসহ চউকের মাধ্যমে নির্মিত হয়েছে মোট ৪টি ফ্লাইওভার, যাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। শুরুতেই যে বিতর্ক উঠেছিল, তা থামছে না একের পর এক ঘটনার কারণে। সর্বশেষ একটি ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পে ফাটলের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় বাণিজ্যিক রাজধানীখ্যাত চট্টগ্রামের ফ্লাইওভারগুলো পরিকল্পিতভাবে হয়েছে কিনা, তা নিয়ে ফের প্রশ্ন উঠেছে। চউকের নির্মাণ করা চারটি ফ্লাইওভারে কার্পেটিং উঠে বিভিন্ন স্থানে খানখন্দ ও নির্মাণ কাজে নিম্নমানের সরঞ্জাম ব্যবহারের কারণে গার্ডারের ওপর চাপ পড়ছে, যার কারণে দ্রæতই আয়ুষ্কাল কমে যাচ্ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবসহ নানা কারণে ফ্লাইওভারগুলোর অবস্থা এখন ঝুঁকিপূর্ণ। নির্মাণকারী চউক হলেও ২০১৯ সালে এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে (চসিক)। সেই কাজটিও যথাযথভাবে হচ্ছে না বলে প্রতীয়মান। গত সোমবার রাতে বহদ্দারহাট এম এ মান্নান ফ্লাইওভারের দুটি র‌্যাম্পে ফাটলের ছবি ফেসবুকে ভাইরাল হলে তা নিয়ে তুলকালাম ঘটে যায় চট্টগ্রামে। চসিক মেয়র মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী নির্মাণে ত্রæটির অভিযোগ তোলেন। এরপরই প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান অধিক ওজনের যানবাহন চলাচলের কারণে এমনটি হয়েছে জানায়। বুধবার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ও নক্সা প্রণয়নকারীরা এ বিষয়ে ভয়ের কিছু নেই এবং এটি ফাটল নয় বলেও সাংবাদিকদের জানায়। তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নগরীতে অপরিকল্পিত-ভাবেই গড়ে উঠেছে ফ্লাইওভার। কোন ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই চট্টগ্রামে লাগাতারভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয় রাজনৈতিক কারণে। বর্তমানে এসব ফ্লাইওভার বর্তমানে মরণফাঁদ। চট্টগ্রামে ফ্লাইওভার বিতর্কে শুরুতেই নগর পরিকল্পনাবিদদের মতামতের সঙ্গে একমত পোষণ করে চউকের ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। চউক চেয়ারম্যান শুরুতে বহদ্দারহাট এলাকায় ৫টি ফ্লাইওভার নির্মাণের পরিকল্পনা নিলে খোদ আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রকৌশলীরা বিরোধিতা করেন। প্রথম ফ্লাইওভারটি নির্মাণ হয় বহদ্দারহাটে। কদমতলীতে ৬৫ কোটি টাকা ব্যয়ে এক কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে একটি এবং প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১১ সালে দেওয়ানহাট এলাকায় একটি ওভারপাস তৈরির কাজ শুরু হয়, যা যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় ২০১৩ সালে। নগর আওয়ামী লীগের এক দায়িত্বশীল নেতা অভিযোগ করে বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুচ ছালাম অপরিকল্পিতভাবে ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছেন। প্রকৌশলগত কোন বিষয় বিবেচনা না করে রাজনৈতিক রেষারেষিতে এসব করেছেন। নগরবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, পরিকল্পিত যে উন্নয়নের সম্ভাবনা ছিল সব বিনিষ্ট করা হয়েছে। যে কোন ধরনের প্রকল্প নেয়ার আগে তার ভাল-মন্দ বিবেচনায় নিতে হয়। এসব প্রকৌশলগত কাজ সিস্টেম মেনে করতে হয়। জনগণের টাকার এই প্রকল্পগুলোর সুবিধা না পেয়ে জনগণ ভোগান্তিতে পড়লে তো টাকার অপচয়। শুরু থেকেই ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ নিয়ে বিতর্ক ছিল। এরমধ্যে নির্মাণ শেষে র‌্যাম্প নামানো হয় বিভিন্ন অংশের কাজ করা হয়। সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকৌশলগত ত্রæটি হয়। এদিকে সরকারী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এক প্রকৌশলী বলেন, বহদ্দারহাট ও কদমতলী ফ্লাইওভারে গাড়ি কয়টা ওঠে? তাছাড়া র‌্যাম্প দিয়ে ভারি গাড়ি চলাচল করলে যে তা ভেঙ্গে কিংবা দেবে যাবে, তা প্রতিষ্ঠানগুলো বুঝে না। যেসব দেশে অপরিকল্পিতভাবে ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে সব ভাঙ্গতে হয়েছে। চট্টগ্রামেও ভবিষ্যতে ফ্লাইওভার ভাঙ্গতে হবে। পরিকল্পিত নগরায়ন করতে হলে অবশ্যই উড়াল সড়কের বাস্তবিক সম্ভাব্যতা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে হয়নি। আলোচিত বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার ॥ ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে চান্দগাঁও থানা থেকে বহদ্দারহাট মোড় পর্যন্ত ১ দশমিক ৩৩ কিলোমিটার বহদ্দারহাট এম এ মান্নান ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করা হয়। তবে নির্মাণ কাজ শেষে চালু হওয়ার পর এর কার্যকারিতা তেমন ছিল না। অপরিকল্পিত এই উড়াল সড়কে উঠত না তেমন যানবাহন। এ অবস্থায় ২০১৭ সালে টার্মিনালমুখী র‌্যাম্প যুক্ত করা হয়। এর আগে ফ্লাইওভার নির্মাণের সময় ব্যাপকভাবে অনিয়ম ও নির্মাণ কাজে ত্রæটিসহ বিভিন্ন কারণে পরিবর্তন হতে থাকে নির্মাণ সরঞ্জামাদি। এরপর গার্ডার ধসে ১৪ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে থলের বিড়াল বের হয়। জানা যায়, প্রকৌশলীদের সিদ্ধান্ত ছাড়াই সন্ধ্যায় কাজ করতে থাকে শ্রমিকরা। চউকের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার নির্মাণের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ছিল তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুচ ছালামের। তিনি নিজে টেকনিক্যাল ব্যক্তি নন, কারও পরামর্শ গ্রহণ করতে চাননি। নক্সা বহিভর্‚ত র‌্যাম্পটি হয়েছে মূলত চেয়ারম্যানের ইচ্ছানুযায়ী। তিনি চেয়েছেন, তাই হয়েছে। এক্ষেত্রে কোন বিশেষজ্ঞ পরামর্শের মতামতের ধার ধারেননি। মোহরা এলাকার মানুষের যাতায়াতের সুবিধা চিন্তা করে যুক্ত করেছেন এই র‌্যাম্প। তার বাড়িও ওই এলাকায়। আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার ব্যবস্থাপনায় অবহেলা ॥ ২০১৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর সকালে মুরাদপুরের আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারটির মূল অংশ যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। তবে তখনও ফ্লাইওভারের দুই নম্বর গেট অংশে একটি র‌্যাম্প ও একটি লুপের নির্মাণাধীন কাজ চলছিল। এছাড়া জিইসি মোড় অংশে চারটি র‌্যাম্প নির্মাণের কাজও তখন শুরু করা যায়নি। ওই অবস্থায় তৎকালীন চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম ফ্লাইওভারটি খুলে দেয়ার নির্দেশনা দেয়। ২০১৪ সালের ১২ নবেম্বরে র‌্যাম্প ও লুপসহ প্রায় পাঁচ দশমিক দুই কিলোমিটার দীর্ঘ আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেও মূল কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের মার্চে। এর নির্মাণ ব্যয় ৪৬২ কোটি টাকা ধরা হলেও পরে র‌্যাম্প (গাড়ি ওঠানামার পথ) ও লুপ (উড়াল সড়কের সঙ্গে অন্য রাস্তার সংযোগ) যুক্ত হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৯৮ কোটি টাকায়, মেয়াদও বাড়ে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত। চউক নির্মিত চারটি ফ্লাইওভারের মধ্যে এটিকেই মোটামুটি পরিকল্পিত হিসেবে ধরা হয়, যা সংযুক্ত হবে পতেঙ্গা বিমানবন্দর থেকে আসা লালখান বাজার পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে। কিন্তু ফ্লাইওভারটির ব্যবস্থাপনায় রয়েছে গাফিলতি। চুরি গেছে পাশের রেলিংয়ের লোহা। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় কোন কোন স্থানে নাট-বোল্টু নড়বড়ে দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া নিয়মিত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজটি হচ্ছে না। প্রবল বর্ষণে পানি জমে খালের মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয় বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। প্রসঙ্গত, ফ্লাইওভারটি চউক নির্মাণ করলেও এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের। কদমতলী ও দেওয়ানহাট ফ্লাইওভার ॥ মহানগরীর কদমতলী ফ্লাইওভারটির দুই লেনের। সরু এই ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে দুদিকের যানবাহন করে। এতে ঝুঁকিতে থাকে যানবাহনগুলো। ফ্লাইওভারটি বিভিন্ন অংশে খানাখন্দ, বিটুমিনের প্রলেপ উঠে যাওয়ায় পরিচর্যার অভাবটি দৃশ্যমান। ভারি যানবাহন ওঠায় সেখানে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়, যা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে চসিক । ফ্লাইওভারের ওপরেই গর্তের কারণে যানবাহনগুলোকে ঝাঁকুনি খেতে হয়। লকডাউন ও করোনা মহামারীর এই সময়ে ফ্লাইওভারগুলোর দৃশ্যমান কোন মেরামতের কাজ করা হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দর নির্মিত ফ্লাইওভার ॥ তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে কাস্টম ব্রিজ এলাকায় একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়, যা মূলত বন্দর থেকে পণ্য বহনকারী যানবাহনগুলোই ব্যবহার করে থাকে। এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও বন্দর কর্তৃপক্ষের। এত ভারি যানবাহন চলাচল করা ফ্লাইওভারটির অবস্থা বড়ই করুণ। বড় বড় গর্তের কারণে ট্রাক কাভার্ডভ্যান ও লরিগুলো এত জোরে ঝাঁকুনি খায় যে, পুরো উড়াল সড়ক কেঁপে ওঠে।
×