ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘না করলে সময়ক্ষেপণ স্ট্রোক হলেও বাঁচবে জীবন’

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ২৯ অক্টোবর ২০২১

‘না করলে সময়ক্ষেপণ স্ট্রোক হলেও বাঁচবে জীবন’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো দেশে আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। ‘না করলে সময় ক্ষেপণ, স্ট্রোক হলেও বাঁচবে জীবন’ স্লোগান সামনে রেখে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় দিবসটি উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে সচেতনতামূলক নানা কর্মসূচীর। চিকিৎসকরা বলছেন, স্ট্রোককে অনেকে হার্ট এ্যাটাকের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললেও এটি মূলত মস্তিষ্কের রোগ। মস্তিষ্কের কোন স্থানের রক্তনালী সরু বা একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে ওই স্থানে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মস্তিষ্কের ওই বিশেষ এলাকা কাজ করতে পারে না। এটিই স্ট্রোক রোগ। এ রোগ নিয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। আর এই ঘাটতি মেটাতেই প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয় নানা আয়োজনে। দিবসটি সামনে রেখে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন বছরে প্রায় ৭ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে মারা যান এক লাখ ৬০ হাজার রোগী। আক্রান্তদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই মারা যান বা চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেশি। বাংলাদেশ এর মধ্যে অন্যতম। গবেষণার প্রেক্ষিতে বলা হয়, স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ১৯ শতাংশেরই ভুঁড়ি রয়েছে। ২৩ শতাংশই জাঙ্ক ফুডে আসক্ত। এছাড়াও কোলেস্টেরল এইচডিএল কম থাকলেও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে প্রায় ২৭ শতাংশ। দেখা যায়, স্ট্রোকে আক্রান্ত একশ’ রোগীর মধ্যে ৩৬ জনই অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এই রোগের অন্যতম কারণ মানসিক চাপ। এই রোগে আক্রান্তদের ১৭ শতাংশই মানসিক চাপের শিকার। চিকিৎসকদের ভাষায়, মস্তিষ্কের রক্তনালীর জটিলতার কারণে হঠাৎ করেই চলার শক্তি হারিয়ে যাওয়া ও অচেতন হওয়াকে সাধারণত স্ট্রোক বলা হয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই রোগের ভীতি বাড়তে থাকে। তবে তরুণদের বা চল্লিশের কম বয়স্কদের স্ট্রোকের আশঙ্কা পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশি। স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে বা লক্ষণ দেখা মাত্রই ৩ থেকে ৪ ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা যায়। তাই দিবসটি উপলক্ষে ‘মুহূর্ত বাঁচাতে পারে সজীবতা’ এবং ‘অমূল্য সময়’ ¯েøাগান দুটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে দিনব্যাপী সচেতনতা ক্যাম্পেন করা হবে বলে জানা গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শতকরা ৯০ ভাগ স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব শুধু স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মমাফিক জীবনযাপন করলে। দ্রæত নির্ণয় করতে পারলে ৭০ ভাগের বেশি রোগী এর মারাত্মক ছোবল থেকে রেহাই পেতে পারেন বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিকিৎসকরা বলছেন, দেশেই এখন স্ট্রোকের সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক নিউরো ক্যাথল্যাব, ইন্টারভেনশন ও অপারেশন থিয়েটার। যা কমপ্রিহেনসিভ এপ্রোচ বা হাইব্রিড পদ্ধতি নামে জনপ্রিয়। স্ট্রোক বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ শফিকুল ইসলাম বলেন, মস্তিষ্কের রক্তনালী বাধাপ্রাপ্ত হলে কিংবা ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হলে স্নায়ুকোষে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। এটিই স্ট্রোক বা ব্রেইন এ্যাটাক। রক্তনালীতে চর্বি বা থ্রম্বাস জমে সরু হয়ে যে স্ট্রোক হয় সেটি ইসকেমিক স্ট্রোক। আর রক্তনালী ফেটে রক্তক্ষরণ হলে সেটিকে হেমোরেজিক স্ট্রোক বলে। স্ট্রোকের লক্ষণ হিসেবে তিনি বলেন, যদি আচমকা হাত, পা, বা শরীরের কোন একদিক অবশ লাগে বা চোখে দেখতে বা কথা বলতে অসুবিধা হয়, কিংবা তীব্র মাথাব্যথা হয় ও হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যান তাহলে বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি স্ট্রোকে আক্রান্ত। এমন কোন একটি লক্ষণ দেখার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। স্ট্রোক হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে শফিকুল ইসলাম বলেন, অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ। ৫০ শতাংশ স্ট্রোক রোগীদের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থাকে। যারা নিয়মিত উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা করেন না তাদের স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা ৫ গুণ বেশি, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, ধূমপানের অভ্যাস, নিয়মিত মদ্যপানের অভ্যাস, হার্টের অসুখ-রিউমেটিক ভাল্বলার ডিজিস, এ্যারিদমিয়া, স্ট্রেস ও ডিপ্রেশনসহ অন্যান্য মানসিক সমস্যা, দিনভর বসে কাজ করা এবং কায়িক শ্রম না করা, ফাস্ট ফুড বেশি খেলে (বাচ্চাদের ও তরুণদের স্ট্রোকের জন্য দায়ী), রক্তে কোলেস্টেরল চর্বি স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হলে। তবে বিরল কারণও রয়েছে। এর মধ্যে রক্তনালীর গঠনগত ত্রæটি, রক্তরোগ যেমন হাইপার-কোয়াগুলোপ্যাথি, কোলাজেন সমস্যাগুলো অন্যতম। এছাড়া ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের ইসকেমিক স্ট্রোকের আশঙ্কা অনেকটাই বেশি। স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়াতে করণীয় হিসেবে চিকিৎসকরা বলছেন, ওজন কমাতে সুষম খাবার খেতে হবে। দামী নয় বরং দেশী ও সহজলভ্য খাবার দিয়ে পেট ভরাতে হবে, ডায়েটে পর্যাপ্ত সবজি ও দেশী ফল রাখতে হবে, সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন আধা-ঘণ্টা করে দ্রæত হাঁটতে হবে বা ২ দিন ১৫০ মিনিট জগিং করতে হবে, ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে, প্রতিদিন অন্তত ৬ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে, বøাড প্রেসার আর সুগার বেশি থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, শরীরচর্চার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন বেশি পরিশ্রমসাধ্য বা ক্লান্তিকর না হয়। মাইল্ড স্ট্রোক বা স্ট্রোকের মতো কিছু উপসর্গ, যা কয়েক মিনিটব্যাপী থাকে। চিকিৎসা না নিলে মাইল্ডস্ট্রোক আক্রান্ত হওয়া রোগীদের প্রতি ১০ জনে ১ জন তিনমাসের মধ্যে মেজর স্ট্রোকে আক্রান্ত হন। এক্ষেত্রে একজন স্ট্রোক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী চেক আপ করা প্রয়োজন।
×