ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের প্রত্যাশা

প্রকাশিত: ২২:০৫, ২৯ অক্টোবর ২০২১

জলবায়ু সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের প্রত্যাশা

মহামারী করোনার কারণে এক বছর পিছিয়ে ৩১ অক্টোবর শুরু হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন। যাকে সংক্ষেপে কপ ২৬ হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে জার্মানির বার্লিনে প্রথম জলবায়ু সম্মেলন শুরুর ধারাবাহিকতায় এবার স্কটল্যান্ডের বাণিজ্যিক শহর গøাসগোতে বসছে ২৬তম জলবায়ু সম্মেলন। বৈশ্বিক মহামারীর কারণে বিশ্ব ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। পরিবর্তন ঘটেছে মানুষের জীবন-যাত্রায়। কিন্তু পরিবর্তন ঘটেনি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে। আঠারো মাস সময় ধরে করোনা মহামারী চলাকলে একটি বড় সময়জুড়েই বন্ধ ছিল শিল্প কারখানা, যানবাহন চলাচল, পর্যটন কেন্দ্র, বিমান চলাচল। মানুষ ঘরবন্দী সময় কাটিয়েছে। তারপরও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে বেড়ে গেছে ১.২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। যার ফলে দ্রæত পরিবর্তন ঘটেছে জলবায়ুর। যার প্রভাবে বিশ্বজুড়েই মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে প্রকৃতির রুদ্রমূর্তি। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে দাবদাহ, বন্যা. খরা ও দাবানলের মতো ঘটনা বাড়ছে। এগুলোর মাত্রা দিন দিন আরও তীব্রতর হচ্ছে। গত এক দশকের রেকর্ড উষ্ণতা সময়ই এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ। যুগ যুগ ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে স্বল্পোন্নত দেশসমূহই। তবে সাম্প্রতিক বাংলাদেশসহ কিছু স্বল্পোন্নত দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বেশ সক্ষমতা অর্জন করেছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবে এখন বাংলাদেশ কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বরং গত কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উন্নত দেশগুলো। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক হ্যারিকেনের হানা, অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল, কানাডায় রেকর্ড দাবদাহ এবং ইউরোপে প্রলয়ঙ্করী বন্যা। ফলে উন্নত দেশগুলো স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে। আর জলবায়ু পরিবর্তন থেকেই বিশ্বে একের পর প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এর জন্য দায়ী বৈশ্বিক তামপত্রা বৃদ্ধি। আর এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ঘটছে পৃথিবীতে মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ব জ্বালানি ব্যবহারের কারণে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে হলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে লাগাম টানতে হবে। এই লাগাম টানতে হলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য প্রধানত দায়ী কার্বন নির্গমন কমাতে হবে। তা না হলে মানুষ বসবাসের এই গ্রহকে বাঁচানো যাবে না। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী রেখে যেতে হলে কার্বন নিঃসরণ কমানো অতি জরুরী। এই প্রত্যাশা থেকেই এবারের জলবায়ু সম্মেলন মানবজাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রত্যাশার পারদ আরও বাড়িয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের লিডার্স সামিট। লিডার্স সামিটে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ইতিবাচক সাড়া আশা জাগিয়েছে সর্বমহলে। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই সেই আশায় নিরাশার দোলা লাগতে দেখা যাচ্ছে। গøাসগো জলবায়ু সম্মেলনের ঠিক এক সপ্তাহ আগে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কয়লা উৎপাদনকারী দেশ অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সম্মেলনে যোগ না দেবার ঘোষণা সবাইকে চমকে দেয়। শেষ পর্যন্ত কঠোর সমালোচনার মধ্যে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন। কিন্তু শীর্ষ কার্বন দূষণকারী দেশ চীনের প্রেসিডেন্ট এই সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না। যোগ দিচ্ছেন না রাশিয়ার প্রেসিডন্টও। আরও একটি নিরাশার বিষয় হচ্ছে, সম্মেলনের ঠিক আগে বিবিসির একটি প্রতিবেদন। বিবিসি ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়, জীবাশ্ব জ্বালানির বিষয়ে আইপিসিসির একটি রিপোর্ট পাল্টে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছিল বেশ কিছু উন্নত দেশ। জাতিসংঘের ওই প্রতিবেদন বদলে ফেলতে যে সকল দেশ তদবির চালিয়েছিল; তাদের মধ্যে আছে সৌদি আরব, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশও। শুধু তাই নয়, ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যায়, সবুজ প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দরিদ্র দেশগুলোকে দেয়া অধিক আর্থিক সহায়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল ওই ধনী দেশগুলো। ধনী দেশগুলোর এসব কর্মকাÐই গøাসগো জলবায়ু সম্মেলনের সফলতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করেছে। তারপরও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো অনেক প্রত্যাশা নিয়ে যাচ্ছে গøাসগো সম্মেলনে। প্রত্যাশা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে (নেট জিরো) নামিয়ে আনতে বড় উদ্যোগ নেবে উন্নত দেশগুলো। প্যারিস জলবায়ু চুক্তির প্রথম লক্ষ্যই হচ্ছে এটি। যদিও সেই লক্ষ্য অর্জনে অনেক পিছিয়ে আছে বিশ্ব। বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো মিলে কার্বন কমানোর যে প্রতিশ্রæতি দিয়েছে, ২০১৮ সালে তা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতিশ্রæতির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে। অবশ্য আশার বিষয় হলো, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের লিডার্স সামিটের পর জি-৭ দেশগুলোও ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে ২০৫০ সালের মধ্যে তারা কার্বন নির্গমন ‘নেট জিরো’তে নামিয়ে আনবে। জি-৭ দেশগুলোর সবই বিশ্বের উন্নত এবং শীর্ষ কার্বন নির্গমনকারী দেশ। ফলে নেট জিরোর ঘোষণার একটি প্রতিফলন দেখা যাবে গøাসগো সম্মেলনের সিদ্ধান্তে। সে লক্ষ্যেই এবারের সম্মেলনে ২০০ দেশের কাছে ২০৩০ সালের মধ্যে তাদের কার্বন নিঃসরণ কমানোর পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যকে। কারণ বিশ্বের শীর্ষ কার্বন নির্গমনকারী দেশ চীন বলছে, ২০৫০ নয়, তারা ২০৬০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন শূন্যে নামিয়ে আনবে। বিশ্বের তৃতীয় কার্বন নির্গমনকারী দেশ ভারত এ ব্যাপারে এখনও কোন সুনির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করেনি। অথচ এই দুটি দেশ বিশ্বের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি কয়লা ব্যবহারকারী দেশ। এসব দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ বিদ্যুতই কয়লা থেকে উৎপাদিত। ফলে এই দেশগুলো প্রতিশ্রæতি ছাড়া ২০৫০ সালের মধ্যে কিভাবে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনা যাবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। কারণ এখন পর্যন্ত ২০০টি দেশের মধ্যে মাত্র ১১১টি দেশ তাদের কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রæতি সংবলিত এনডিসি জমা দিয়েছে। প্রধান প্রধান দায়ী দেশগুলো এখন পর্যন্ত দেয়নি। ফলে সংশয়টা এ কারণেও আরও বেড়েছে। তাই সম্মেলনজুড়ে সবার দৃষ্টি থাকবে এই দুটি দেশের প্রতি। দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রত্যাশা হচ্ছে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখা। যদিও উন্নত দেশগুলো চাওয়া হচ্ছে, এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এখন সেদিকেই যাচ্ছে। কারণ ইতোমধ্যে প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কোন দেশই দেড় ডিগ্রীর মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি সীমাবদ্ধ রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ফলে গøাসগো জলবায়ু সম্মেলনে ‘এনহেন্সড এনডিসির’ আওতায় ব্যাপক আকারে কার্বন নির্গমন হ্রাসের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ২০৩০ সালের মধ্যেই তা দেড় ডিগ্রী ছাড়িয়ে যাবে। তাই দেড় ডিগ্রীর মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি আটকে রাখতে গøাসগোতে জোরালো পদক্ষেপ চায় বাংলাদেশ। এবারের জলবায়ু সস্মেলনে নেট জিরো ছাড়াও যে ইস্যুটি সবচেয়ে আলোচনায় থাকবে সেটি হলো অর্থায়ন। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলো ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার করে দেয়ার প্রতিশ্রæতি দিয়েছে সেই কোপেনহেগেন সম্মেলনে। ২০২০ সাল পেরিয়ে এখন ২০২১ সাল শেষ হতে চলেছে। কিন্তু এই ১০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থ এখনও গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডে আসেনি। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর কেউ কেউ এখন বলার চেষ্টা করছে তারা এই অর্থ বহুজাতিক উন্নয়ন সংস্থা তথা বিশ্বব্যাংককে দিয়েছে। তবে জাতিসংঘ তার গত বছরের (২০২০) এক মূল্যায়নে জানিয়েছে, ধনী দেশগুলোর দেয়া এই প্রতিশ্রæতি পূরণ হচ্ছে না। যে কারণে এবার ধনী দেশগুলোর কাছে আরও অর্থ চাওয়া হবে। এ বিষয়টি এবারের জলবায়ু সম্মেলনে ফয়সালা হতে হবে। গøাসগো সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধান চাওয়ার বিষয়গুলোর অন্যতম হলো, জলবায়ু শরণার্থী হওয়া থেকে মানুষকে বিরত রাখতে জলবায়ু অভিযোজনে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে সহায়তা আদায়। বাংলাদেশ আশাবাদী, কপ-২৬ সম্মেলনে ১০০ বিলিয়ন ডলারের অঙ্গীকার উন্নত দেশগুলো নিশ্চিত করবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের আরও দাবি আছে। বর্তমানে গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যে অর্থায়ন করা হচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, মিটিগেশন বা প্রশমন অর্থাৎ কার্বন নির্গমন কমানোর জন্যই এই তহবিল থেকে বেশি অর্থ দেয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর (এডাপটেশন বা অভিযোজন) জন্য প্রদত্ত অর্থের পরিমাণ অনেক কম। আনুপাতিক হারে দেখা যাচ্ছে, ৭০:৩০ অনুপাতে এই অর্থায়ন হচ্ছে। অর্থাৎ মিটিগেশনে ৭০ শতাংশ এবং অভিযোজনে ৩০ শতাংশ অর্থ প্রদান করা হচ্ছে। বাংলাদেশের চাওয়া হচ্ছে, এই অর্থ ৫০:৫০ অনুপাতে দিতে হবে। অর্থাৎ অর্ধেক মিটিগেশনে এবং অর্ধেক এডাপটেশনে দিতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষে এই তহবিল প্রাপ্তির প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে আরও দাবি আছে। দাবি হচ্ছে, এই অর্থ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। বর্তমানে জটিল প্রক্রিয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো এই তহবিল থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ পাচ্ছে না। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ এই তহবিল থেকে মাত্র ১০১ মিলিয়ন ডলার সাহায্য পেয়েছে। যা বিশ্বের সাত নম্বর ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে খুবই নগণ্য। তাই বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো যাতে এই তহবিল থেকে সহজে অর্থ পায় সেজন্য অর্থ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর আরও একটি বড় চাওয়া হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয় ও ক্ষতির ব্যাপারে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শুধু অবকাঠামোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, মানুষের জীবিকায়নের ওপরও এটি দারুণভাবে প্রভাব ফেলছে। যেমন সাগরে ঘন ঘন লঘুচাপ সৃষ্টির কারণে জেলেরা মাছ ধরতে যেতে পারে না। ফলে তাদের অলস সময় কাটাতে হয়। এতে তাদের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আয় কমে যাচ্ছে। একইভাবে উপক‚লে লবণাক্ততার কারণে কৃষক ফসল আবাদ করতে পারছে না। উপক‚লের কৃষকদের আয় কমে যাচ্ছে। তারা মাইগ্রেশন করে অন্যত্র কাজের সন্ধানে যাচ্ছে। যা তাদের মানসিক ও স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলছে। এই ক্ষতি পোষাতেই জলবায়ু সম্মেলনের আলোচনার এজেন্ডায় ক্ষয় ও ক্ষতির (লস এন্ড ড্যামেজ) ইস্যুটি নিয়ে আসা হয়েছে। এ ব্যাপারে পোল্যান্ডের ওয়ারশ জলবায়ু সম্মেলনে একটি ম্যাকানিজম প্রণয়ন করা হয়। এই ম্যাকানিজমের আওতায় একটি কারিগরি কমিটিও হয়েছে। কিন্তু এই কমিটির প্রস্তাব অনুসারে লস এ্যান্ড ড্যামেজ বিষয়টি দেখভাল ও বাস্তবায়নের জন্য একটি কার্যকরী সংস্থা গঠন করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের দাবি হচ্ছে, লস এ্যান্ড ড্যামেজের কার্যকরী কমিটিকে একটি বাস্তবায়নকারী কার্যকর সংস্থায় পরিণত করতে হবে। এই সংস্থার আওতায় একটি তহবিল থাকবে। এই তহবিল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের ক্ষয় ও ক্ষতি কমাতে অর্থায়ন করা হবে। বাংলাদেশের চাওয়ার আর একটি ইস্যু হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের মাইগ্রেশন বা অভিবাসন। কানকুন জলবায়ু সম্মেলনের এজেন্ডায় এই অভিবাসন ইস্যুটি স্থান পেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে উন্নত দেশগুলোর চাপে এই ইস্যুটি জলবায়ু আলোচনার প্রক্রিয়া থেকে হারিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। তারা নিজস্ব বাড়িঘর হারিয়ে পার্শ¦বর্তী শহর বা নগরে গিয়ে ঠাঁই নিচ্ছে। অথচ জলবায়ুর আলোচনার প্রক্রিয়ায় এখনও বাস্তুচ্যুতিকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুতরা পায়নি রিফিউজি স্ট্যাটাস। জলবায়ু বাস্তুচ্যুতদের পক্ষে জোরালো কণ্ঠ না থাকায় প্যারিস চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি ক্লাইমেট মাইগ্রেশন ইস্যু। এখন বাংলাদেশের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত আফ্রিকান ও দ্বীপ দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এই জলবায়ু বাস্তুচ্যুতি ইস্যুকে আবারও জলবায়ু আলোচনার প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা। এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত সব দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এই ইস্যুতে একটি ‘সাবমিশন’ প্রদান করা। গত ২৬ অক্টোবর জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডবিøউএমও) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আবহাওয়া ও জলবায়ুর বিপদ বিশেষ করে বন্যা, ঝড় এবং খরা এশিয়ার অঞ্চলের অনেক দেশে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর লোকজন দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের বাড়িতে ফিরতে অথবা স্থানীয়ভাবে সুসংহত হতে পারছে না। ২০২০ সালে বন্যা এবং ঝড়ের কারণে এশিয়া অঞ্চলের প্রায় ৫ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং প্রাণ হারিয়েছেন ৫ হাজারের বেশি। জাতিংঘের এই প্রতিবেদন থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কি পরিমাণ মানুষ ক্ষয় ও ক্ষতির শিকার হচ্ছে এবং উদ্বাস্তু হচ্ছে। এই উদ্বাস্তু ইস্যুকেও গøাসগো জলবায়ু সম্মেলন মূল আলোচনায় নিয়ে আসা উচিত। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। কোপেনহেগেন জলাবায়ু সম্মেলনের পর বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি দল যাচ্ছে গøাসগো সম্মেলনে। সরকারী প্রতিনিধি দলে রয়েছেন ৫৯ সদস্য। এছাড়া বেসরকারী পর্যায়েও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সাংবাদিক মিলিয়ে যাচ্ছেন আরও অর্ধশতাধিক। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যাচ্ছেন আরও একটি প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য মূল জলবায়ু আলোচনায় বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন না। বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দিবেন পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) আয়োজিত একটি উচ্চ পর্যায়ের সভায় যোগ দেবেন। জলবায়ু সম্মেলনের সাইড ইভেন্ট হিসেবে ২ নবেম্বর এই সভা অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে সিভিএফের সভাপতি। এতে সভাপতিত্ব করবেন শেখ হাসিনা। এতে সিভিএফের ৪৮টি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেবেন। উচ্চপর্যায়ের এ ইভেন্টে ২৬তম জলবায়ু সম্মেলনের সভাপতি অলোক শর্মা থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এর পর যুক্তরাজ্যের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক যোগ দিতে লন্ডন চলে আসবেন। সেখান থেকে তিনি প্যারিস যাবে ইউনেসকোর একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তবে সিফিএফ সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা কোপেনহেগেন সম্মেলনের মতো গøাসগো জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিলে দেশের কণ্ঠ আরও জোরালো হতো। পাশাপাশি তিনি সম্মেলনের নীতি নির্ধারণেও ভূমিকা রাখতে পারতেন। জলবায়ু আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহণ বা দরকষাকষির কোন সুযোগ নেই ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহের। বাংলাদেশ বা ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহে জলবায়ু আলোচনায় ভূমিকা রাখতে হলে জি-৭৭ প্লাস চীন এই গ্রæপের মাধ্যমে অংশ নিতে হয়। এই গ্রæপটি মূলত নিয়ন্ত্রণ করে থাকে চীন, ভারতের মতো দ্রæত উন্নয়নশীল দেশসমূহ, যারা মূলত শীর্ষ কার্বন দূষণকারী দেশ। ফলে তাদের স্বার্থ এবং বাংলাদেশ বা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর স্বার্থ এক নয়। তাই বাংলাদেশের উচিত সভাপতি হিসেবে সিভিএফকে জলবায়ু আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়ার জন্য জাতিসংঘের কাছ থেকে মর্যাদা আদায় করা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। যতদিন না ক্ষতিগ্রস্ত দেশসমূহ জলবায়ু আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে, ততদিন এসব দেশের দাবি বা প্রস্তাব উন্নত ও দ্রæত উন্নয়শীল দেশে রাজনীতি মারপ্যাঁচে হারিয়ে যাবে। দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের কণ্ঠ অনুপস্থিত। বাংলাদেশ যেন অংশগ্রহণ করতে হবে এ কারণেই জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণ করছে। এমনকি জলবায়ু আলোচনার প্রতিটি এজেন্ডায় অংশ নেয়ার মতো নেগোসিয়েটরও বাংলাদেশের নেই। আবার নতুন করে নেগোসিয়েটরও তৈরির কোন উদ্যোগ নেই। পুরো আলোচনা কাউকে নেতৃত্ব দিয়ে সমন্বয় করতেও দেখা যায় না। আলোচনায় সরকারের ভূমিকা কি হবে, বেসরকারী তথা নাগরিক সমাজ কি করবে তার কোন দিক নির্দেশনা দেয়া হয় না। বা দেয়ার মতো কেউ নেই। গত কয়েক বছরের আলোচনায় দেখা গেছে, সরকারের বড় টিম গেলেও কয়েক জন সদস্যকে দায়িত্ব নিয়ে নেগোসিয়েশন বা দরকষাকাষিতে থাকতে দেখা যায়। বাকিরা এক দিন বা দুদিন সম্মেলনে চেহারা দেখিয়ে বাইরে ঘোরাঘুরি করে দেশে চলে আসেন। সম্মেলনে শেষ দিকে গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনা চলে। সেসব আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষে কেউ থাকে না। জলবায়ু আলোচনায় শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে হলে এ বিষয়টির দিকে এখনই নজর দিতে হবে। অন্য দেশগুলো বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারত আলোচনায় কিভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখে বাংলাদেশকেও সেভাবে সক্রিয় হতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারী প্রতিনিধি দল নিজে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সম্মেলনে যোগদানকারী নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং সাংবাদিকদেরও দেশের স্বার্থে দেশের পক্ষে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই সম্মেলন থেকে বাংলাদেশের কিছু না কিছু প্রাপ্তি যোগ হবে। ২৭.১০.২০২১ লেখক : সাংবাদিক
×