ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূইয়া

পায়রা সেতু ॥ স্বপ্ন পূরণের অভিযাত্রা

প্রকাশিত: ২১:৪১, ২৯ অক্টোবর ২০২১

পায়রা সেতু ॥ স্বপ্ন পূরণের অভিযাত্রা

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নবনির্মিত পায়রা সেতুর মাধ্যমে সমুদ্র শহর কুয়াকাটার সঙ্গে রাজধানীসহ সারা দেশের নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের দ্বার উন্মোচন হলো। দৃষ্টিনন্দন এই সেতু উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছেন নতুন এক দিগন্ত। জাতির জনকের কন্যা গত ২৪ অক্টোবর পটুয়াখালীর লেবুখালীতে পায়রা নদীর ওপর নবনির্মিত গুরুত্বপূর্ণ ১.৪৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে অত্যাধুনিক পায়রা সেতুর শুভ উদ্বোধন করেন। নানা রকম সুযোগ-সুবিধা সংবলিত চার লেনের এ সেতুটি উদ্বোধনের ফলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হলো। জনপ্রিয় পর্যটননগরী সাগরকন্যা কুয়াকাটার সঙ্গে নিরবচ্ছিন যোগাযোগ স্থাপনের ফলে পর্যটন শিল্পে আসবে নতুন মাত্রা। এদিকে উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে কুয়াকাটা, পটুয়াখালী, বরগুনা, বরিশাল অঞ্চলসহ পুরো দক্ষিণাঞ্চলে সম্পূর্ণ ফেরিবিহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হবে। ঢাকা থেকে এক সময় পর্যটননগরী কুয়াকাটা যেতে ১০টি ফেরি পার হতে হতো। ফলে সম্ভাবনাময় পর্যটন স্পট হওয়া সত্তে¡ও পর্যটকের সংখ্যা ছিল নিতান্ত কম। অত্যাধুনিক এই সেতুটি চালু হওয়ায় ঢাকা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত পদ্মা নদী ছাড়া আর কোন ফেরি থাকল না। পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে বিরামহীনভাবে পৌঁছে যাওয়া যাবে কুয়াকাটা। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবনযাত্রার মানসহ পর্যটন শিল্পে আসবে অভাবনীয় পরিবর্তন। নদী বিধৌত আবহমান বাংলার অপার নৈসর্গিকতায় বিমুগ্ধ দেশ থেকে দেশান্তরের মানুষ। প্রকৃতির অকৃত্রিম দানে ভরপুর এমন রূপশৌর্য অবগাহন করতে শুধু আপন দেশের মানুষই নয়, ভিনদেশী পর্যটকদের কলকাকলিতেও মুখরিত হচ্ছে দর্শনীয় জায়গাগুলো। আর সেই অবারিত বৈভবকে উপভোগ করতে এতদিনের যাত্রাপথের দুর্ভোগকে পেছনে ফেলে নবোদ্যোমে ভ্রমণকে নিরবচ্ছিন্ন প্রশান্তিতে পূর্ণ করা হলো। একটি দেশের উন্নয়নের মূলে রয়েছে আধুনিক এবং নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা। রাতারাতি যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে অর্থনীতির চাকা দ্রæততর গতিতে ঘুরবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। অত্যাধুনিক এ সেতুটিতে বিভিন্ন আধুনিক ব্যবস্থার সংযোজন করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছে ব্রিজ হেলথ মনিটরিং সিস্টেম, যা বজ্রপাত, ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং অতিরিক্ত মালবোঝাই যানবাহন উঠলে সেতুটি ভাইব্রেশন তৈরি করবে এবং ক্ষতির আশঙ্কা থাকলে সঙ্কেত প্রদান করবে। তদুপরি এ সেতুটি সর্বোচ্চ স্প্যানবিশিষ্ট যেখানে নদীর মধ্যে মাত্র একটি পিলার ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে সেতুতে বড় বড় জাহাজ চলাচল করতে পারবে। নিচ দিয়ে বড় জাহাজ চলাচল ও ওপর দিয়ে ভারি যানবাহন চলাচল করার কারণে দেশীয় অর্থনীতিতে এ সেতুটি গুরুত্বপূর্র্ণ প্রভাব ফেলবে। পায়রা সেতু আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুনত্ব নিয়ে এলো, যা দক্ষিণাঞ্চলের ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক জিডিপি বৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকা রাখবে। পর্যটন খাতে সৃষ্টি হবে নতুন নতুন ক্ষেত্র, যা বদলে দেবে পুরো দক্ষিণাঞ্চলের চেহারা। নব নব ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি হওয়ার সঙ্গে স্থাপন হবে নানা ধরনের হোটেল-মোটেল। সুবিধাবঞ্চিত এসব জেলার মানুষের জন্য নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিকভাবে উন্নত করবে তাদের জীবন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবনার মূলে রয়েছে বাংলাদেশের উন্নয়ন, দেশের মানুষের উন্নয়ন। যার জন্য তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এবং স্বপ্ন দেখাচ্ছেন উন্নত বাংলাদেশের। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে আসে এক সময় আমাদের এই দেশই বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে ঝড়, জলোচ্ছ¡াস, বন্যা, দুর্ভিক্ষসহ হরেকরকম সমস্যাজর্জরিত হিসেবে। মাত্র ১২ বছরের শাসনে পুরো দেশের সার্বিক অবয়বের যে আমূল পরিবর্তন হয়েছে তাও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার মহাপ্রত্যয়। তার সঙ্গে একাত্ম হয়েছে সরকারপ্রধানের আধুনিক ও প্রযুক্তির উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণের কঠিন অঙ্গীকার। উন্নয়নশীল দেশ গড়ার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রায় দেশকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে আনুষঙ্গিক উন্নয়ন শর্ত পূরণের মধ্য দিয়ে। অবকাঠামোর দৃশ্যমান উন্নয়ন তেমন ধারাবাহিকতার সফল নির্দেশনা। যে জন্য দেখা যায় পায়রা সেতুর উদ্বোধনের দিনেই তিনি ঢাকা-সিলেট ও সিলেট-তামাবিল মহাসড়ককে ৬ লেনে উন্নীতকরণের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। উন্নয়নের অগ্রযাত্রা এভাবে চলতে থাকলে ২০৪১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে একটি উন্নত দেশের আসনে আসীন হবে। দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, পায়রা সমুদ্র বন্দর, পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্প, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প, এমআরটি লাইন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র, মাতারবাড়ী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল ফায়ার্ড পাওয়ার প্রকল্প ইত্যাদি দেশকে নিয়ে যাবে অনন্য উচ্চতায়। দেশ হবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিক দিয়ে স্বাবলম্বী ও ধারাহিকভাবে উন্নয়নের রোল মডেল। এছাড়াও ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত অত্যাধুনিক এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ফলে অভাবনীয় উন্নয়ন সাধন হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলে, যার সুবিধা পাচ্ছে পুরো দেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ। অপরূপা এ দেশের সবুজ বনানী, সুবিশাল ম্যানগ্রোভ বনরাজি, নদ-নদী, শ্যামল পাহাড়, বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকত, প্রাচীন ঐতিহাসিক ও প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনসমূহ যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভ্রমণপিপাসু মানুষকে আকর্ষণ করছে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশটি যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মিউজিয়াম। বাংলাদেশের প্রকৃতির নন্দনকাননের সৌন্দর্যমণ্ডিত কোন সার্থক চিত্রশিল্পীর নিখুঁত চিত্রকর্মের সঙ্গে তুলনীয়। বদ্বীপসদৃশ এ বঙ্গভূমির রয়েছে বিচিত্র ভূভাগ এবং সমুদ্র বিস্তীর্ণ উপকূল। প্রকৃতির অঢেল সৌন্দর্যের রূপ ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে। এ দেশে রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম বেলাভূমি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত এবং রয়েছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুয়াকাটা। প্রকৃতির কোলে অথৈ জলরাশি শুধু কৌতূহল জাগায় এবং একমাত্র কুয়াকাটা সমুদ্রতট থেকেই দেখা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য। সারা দেশের মানুষকে এসব নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ দিতে প্রয়োজন উন্নত ও নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং দেশের সব অঞ্চলের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলেও একমাত্র দক্ষিণাঞ্চল ছিল এর বাইরে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরির জন্য অপেক্ষা এবং দীর্ঘ সময় ব্যয় করে পদ্মাসহ অন্যান্য নদী পার হতে হতো। কিন্তু পায়রা সেতুতে যান চলাচল শুরু হওয়ায় তা এখন অতীত হয়ে গেল। আগামী বছর পদ্মা সেতু চালু হলে শতভাগ ফেরিমুক্ত যান চলাচল করবে এ অঞ্চলে। যার প্রভাব পড়বে দেশীয় অর্থনীতি ও পর্যটন শিল্পে। স্মরণাতীতকাল থেকেই বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও সম্পদ বিশ্বের বিভিন দেশের অভিযাত্রী, ব্যবসায়ী ও পর্যটকদের উৎসুক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তারা অবাক হয়ে দেখেছে এই পৃথিবীতে এমন একটি দেশ আছে যা ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা, সবুজ শ্যামল প্রকৃতিময় আর আছে সুখ-শান্তি সমৃদ্ধির অফুরন্ত ভাণ্ডার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে যা অবলোকন করতে ছুটে আসছে নানা দেশের মানুষ। দেশের এই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে খুব শীঘ্রই শুভ উদ্বোধন হবে দেশের বৃহত্তম পদ্মা বহুমুখী সেতু, যা দ্বিতলবিশিষ্ট সেতু, যার ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন এবং নিচ দিয়ে চলবে রেল। অচিরেই ঢাকা-পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন চালু হয়ে যাবে এবং পায়রা বন্দর থেকে একটি শাখা লাইন যাবে পর্যটননগরী কুয়াকাটায়। ফলে পুরো দক্ষিণাঞ্চল রেল নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে। শিল্প-কারখানা, পর্যটনের জন্য বিনোদন কেন্দ্র, হোটেল, অত্যাধুনিক আবাসন প্রকল্প, স্যাটেলাইট শহরসহ নানা স্থাপনা গড়ে উঠবে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে, যা অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। দেশে উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান ধারায় পদ্মা ও পায়রা সেতু এক অনবদ্য সফলতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাকালে সশরীরে উপস্থিত থেকে স্বচক্ষে পায়রা সেতু দেখতে না পারার কষ্ট অনুভূত হয়েছে। সেতুর উদ্বোধন করে হেঁটে চলার যে উপভোগ্য দৃশ্য আপাতত সেখান থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা আক্ষেপ করে বলেন তিনি। দেশের উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান ধারায় পদ্মা সেতু এক অনবদ্য সফলতা অব্যাহত থাকুক প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণের অভিযাত্রা। লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×