ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সামনে এলো পঞ্চাশ অপ্রকাশিত আলোকচিত্র

প্রকাশিত: ২৩:২৪, ২৮ অক্টোবর ২০২১

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সামনে এলো পঞ্চাশ অপ্রকাশিত আলোকচিত্র

মোরসালিন মিজান ॥ মুক্তিযুদ্ধের আরও কিছু নতুন ছবি সামনে এলো। নতুন এ কারণে যে, ছবিগুলো আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। বাইরের দেশের একজন বিখ্যাত আলোকচিত্রী বাঙালীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল সময়টাকে ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন। ফরাসী এ আলোকচিত্রীর নাম মার্ক রিবুর। ১৯৭১ সালের নবেম্বরের শেষদিকে কলকাতায় আসেন তিনি। এ সময় শরণার্থী শিবির ঘুরে ঘুরে ছবি তোলেন। পরে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে প্রবেশ করেন বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে। বহু দুর্লভ এবং বিচিত্র মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করতে সক্ষম হন তিনি। অথচ কী কা-! তার তোলা ছবির কথা তেমন কেউ জানতেন না। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন দলিল দস্তাবেজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণে সরকারী উদাসীনতার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। ইতিহাস চেতনা ও ত্বরিত উদ্যোগের অভাবে অনেক কিছুই চিরতরে হারিয়ে গেছে। রিবুর ছবিগুলো হারিয়ে না গেলেও আড়ালে ছিল এতদিন। তবে আশার কথা, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মতো একটি বেসরকারী অথচ সক্ষম প্রতিষ্ঠান আমাদের আছে। মূলত এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই এত বছর পর ছবিগুলো বাংলাদেশে আনা সম্ভব হয়েছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে পঞ্চাশ নতুন আলোকচিত্র নিয়ে এখন চলছে বিশেষ প্রদর্শনী। অবশ্য শুধু তো প্রদর্শনী নয়, ইতিহাসের পথ ধরে চমৎকার একটা পরিভ্রমণ। এ পরিভ্রমণে বাঙালীর শরাণার্থী জীবন, মুক্তিসংগ্রাম ও বিজয়ের পূর্বাপর মুহূর্তগুলো প্রধান হয়ে ওঠে। একই সময় ও ঘটনাবলীর ছবি, হ্যাঁ, আরও অনেকে ক্যামেরাবন্দী করেছেন। তবে মার্ক রিবুর ছবিগুলো স্বতন্ত্র আবেদন নিয়ে হাজির হয়। খুঁটিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। যুদ্ধচলাকালে কত রকম সীমাবদ্ধতা! সব তিনি জয় করেছিলেন। একটা সচেতন রিয়েলিস্টিক ভাবনা থেকে ক্যামেরা চালিয়েছেন বলে মনে হয়। নানা মুহূর্ত ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। মুহূর্তগুলোই আজ ইতিহাসের এক একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অর্ধশত ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে তার শুরুটা বলা চলে কলকাতা থেকে। সল্টলেকের শরণার্থী শিবিরের ছবি তুলেছেন আলোকচিত্রী। ছবিতে বাঙালীর দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন। সর্বহারা মানুষের মুখগুলোকে মনে হয় পাথরপ্রতিমা। থিয়েটার রোডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের নানা কর্মকা-ের ছবিও তুলেছেন। কলকাতার রাজপথ অলিগলি দোকানপাট ঘুরে যেসব ছবি তুলেছেন সেখানও একখ- বাংলাদেশ। এপার বাংলার জন্য ওপার বাংলার মানুষের নিবেদন দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। কলকাতার পর্ব চুকিয়ে ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন মার্ক রিবু। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন আলোকচিত্রী। তার অভিযাত্রা শুরু হয় জামালপুর-শেরপুর হতে। সেনাদের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দেন তিনি। প্রত্যক্ষ করেন জামালপুরের যুদ্ধ। সবই ক্যামেরায় ধারণ করার প্রয়াস নেন। রিবুর আলোকচিত্রে নতুন করে আরও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। ছবিতে মুখগুলো অনেক বেশি স্পষ্ট। অধিকাংশই অল্প বয়সী। কৈশোর উত্তীর্ণ। কিন্তু শক্তি ও সাহসের কোন অভাব নেই। গবেষণার মাধ্যমে এই বীর যোদ্ধাদের নাম পরিচয়ও হয়তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সফল পরিণতি দিতে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিলেন ভারতীয় সেনারা। আজকের দিনে ক’জন আর তাদের অবদানের কথা স্বীকার করে? বিস্মৃতপ্রায় সে ইতিহাস আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে একাত্তরের আলোকচিত্র। অস্ত্রশস্ত্রসহ মিত্রবাহিনীর বাংলাদেশে প্রবেশ ও বিভিন্ন অপারেশন সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায়, সেটিও কোন কোন ক্ষেত্রে নতুন। মার্ক রিবুর আলোকচিত্রে পাকিস্তান আর্মির বর্বরতার চিত্রও ওঠে এসেছে। বাঙালীর ওপর যে অন্যায় হয়েছিল তা যথার্থই তুলে এনেছেন তিনি। একইসঙ্গে ছবিগুলো মানবাধিকার লংঘন, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের প্রামাণ্য দলিল। আলোকচিত্রের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বাঙালীর যুদ্ধ জয়ের ঐতিহাসিক মুহূর্ত। দীর্ঘ লড়াই ও নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে চূড়ান্ত বিজয়। স্বাধীন দেশ। দেশটিকে নিজের করে পাওয়া আনন্দ ক্যামেরায় ধারণ করেছেন আলোকচিত্রী। অন্যদিকে পাকিস্তানীদের পরাজয়, পিছু হটার অনেক অদেখা ছবি এখানে খুঁজে পাওয়া যায়। এভাবে বাঙালীর হাসি-কান্নার ইতিহাস অনন্য এক দৃশ্যকাব্য হয়ে উঠেছে। আর এ দৃশ্যকাব্যের জনক মার্ক রিবু। না, আর বেঁচে নেই তিনি। তবে তার ছবি বাংলাদেশের ইতিহাসকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীরকালে ছবিগুলো তাই অনেক বড় পাওয়া। দেখার ইচ্ছে হচ্ছে? ‘বাংলাদেশ ১৯৭১: শোক ও সকাল’ শীর্ষক প্রদর্শনীটি আগামী ১৬ নবেম্বর পর্যন্ত চলবে। একবার সময় করে ঘুরে আসুন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বিশেষ আমন্ত্রণ।
×