ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশে মানসিক উন্নয়ন দরকার

প্রকাশিত: ২১:১৩, ২৮ অক্টোবর ২০২১

অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশে মানসিক উন্নয়ন দরকার

বাঙালী জাতি ’৭১-এ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পরাজিত করে শুধু যে পাকিস্তানী সেনা শাসকদের আত্মম্ভরিতা ও চরম বৈষম্যমূলক আচরণকে পরাস্ত করেছিল তা নয়, বাঙালীর জন্য চরম ক্ষতিকর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মূলোৎপাটনও মহান মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব করেছিল। বঙ্গবন্ধু যে কারণে বিশ্বের অন্যসব নেতার মধ্যে আপন স্বকীয়তায় উজ্জ্বল সেটি হচ্ছে- তিনিই বিশ্বের প্রথম নেতা যিনি ধর্মের ছদ্মাবরণে ঘৃণার অপরাজনীতি এবং এর কুফল উপলব্ধি করেছিলেন। সবচাইতে বড় কথা- শুধু উপলব্ধি করেননি, ‘৭২ এর নভেম্বরে এই সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিভিত্তিক অপরাজনীতির মূলোৎপাটন করতে একটি সংবিধান রচনা করেন। সংবিধানে সকল ধর্মের মানুষের সমানাধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে যেমন গুরুত্বপূর্ণ মৌল নীতি হিসেবে প্রতিস্থাপন করেন। ধর্মনিরপেক্ষতাকে সফলভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে ‘ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ’ করে তিনি আর্টিকেল যুক্ত করেছিলেন। আমাদের সংবিধানের মৌল প্রত্যয় এর সাপোর্টিভ আর্টিকেলগুলো পাঠ করে বঙ্গবন্ধুর মূল আদর্শ উপলব্ধি করে আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাঙালীর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে যা আমরা এখনও পর্যন্ত অর্জন করতে পারিনি। সরকার এবং আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে- বাংলাদেশের জন্মের শত্রু, উন্নয়নের শত্রু, শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ধর্মনিপেক্ষ বাংলাদেশের শত্রু জামায়াত-বিএনপি, হেফাজত এবং তাদের নেতা তারেক রহমান। দেশ যখন উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে তখন এই শত্রুরা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির সবচাইতে বড় কিন্তু দুর্বল টার্গেট গণ্য করে- হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত হানছে। এরা হিন্দু সাম্প্রদায়কে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসাব গণ্য করে। পহেলা বৈশাখসহ বাঙালী সংস্কৃতির সব পালা-পার্বণকে তারা হিন্দুয়ানী নাম দিয়ে সাধারণ মুসলিমদের হিন্দু-বিদ্বেষী করে তোলার চেষ্টা করে। এরাই হিন্দু মন্দির, এর দেব-দেবী, প্রতিমা ভাঙচুর, বর্তমানে ফেসবুকের মাধ্যমে ছবি তৈরি করে হিন্দু তরুণের দ্বারা মুসলিম ধর্মের অবমাননার কল্পিত কাহিনী প্রচারণা করে তা-ব সৃষ্টি করেছে। এই মিথ্যা প্রচারণার ফল দুর্গাপূজার দশমীর দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের ওপর সহিংস তা-ব, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, ব্যবসা ধ্বংস ইত্যাদি জনগণ সংঘটিত হতে দেখেছে। কেন সরকারের শত্রুরা হিন্দু সম্প্রদায়কে বেছে নিল এবং কেন এই সময়টিকেই বা বেছে নেয়া হল? আমাদের জানা আছে, এই ২০২১ এ আমাদের ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর যেমন পূরণ হচ্ছে তেমনি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষও এ বছরে উদযাপিত হচ্ছে। শত্রু পক্ষের জন্য আঘাত হানার জন্য এই বছরটি টার্গেটে ছিল। আমরা জানি, সম্প্রতি অনেক জঙ্গী-জেহাদী নানা জেলায় এবং এমনকি ভারতে গ্রেফতার হয়েছে তাদের পরিকল্পিত হামলাগুলো করতে পারার আগেই। এই ক্ষেত্রে গোয়েন্দা ও পুলিশের যথেষ্ট সফলতা দেখা গেছে। এরপর, শত্রুরা তাদের সহজ টার্গেট- হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গা পূজাকে বেছে নিয়েছে। প্রথম টার্গেট স্থল কুমিল্লার মন্দির, ম-প, দেব-দেবী প্রতিমার স্থানগুলো। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে প্রায় প্রহরাহীন দেখা গেছে। যেগুলো পাহারায় থাকলে এই কোরান রাখার হীন কাজটি হতোনা। পূজা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা নেতৃবৃন্দের অনুরোধের আগেই প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধিরা অকুস্থলে উপস্থিত হতেন, তাহলে সম্ভবত ঘটনা এতদূর গড়াত না। সবচাইতে দুর্ভাগ্যজনক এখানে আমাদের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে আঘাত করে শত্রু পক্ষ দু’জন হিন্দু যুবককে হত্যা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র-যুব নেতা-কর্মীরা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করলে কুমিল্লার ঘটনাটির পর নোয়াখালী, রংপুরসহ দেশের অন্যত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের দরিদ্র ও নি¤œবিত্ত মানুষের ওপরে সংঘটিত হামলার তা-ব ছড়িয়ে পড়ত না। যেসব স্থানে হিন্দু সম্প্রদায় হামলার মুখে পড়েছে দেখা যাচ্ছে- সেসব হামলার পরিকল্পক, কুশীলব, তা-ব সৃষ্টিকারী প্রায় সব গু-া-সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও যাদের গ্রেফতার করা হবে তাদের সঙ্গে যেসব স্থানে প্রধানতঃ হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোটের সাহায্যে নির্বাচিত সব রকম জনপ্রতিনিধিদের সাম্প্রদায়িক তা-ব সংঘটিত হবার জন্য অন্তত কারণ দর্শানোর নির্দেশ দিতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের এবং প্রশাসকদের প্রায় প্রত্যেক সভায় প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে জনগণের সেবক হতে বলেন। সেক্ষেত্রে এতবড় অঘটনের ও তা-বের শিকার ভোটারদের প্রতি তাদের দায়বোধের প্রমাণ দিতে হবে। এজন্য তাদের তান্ডব দমনে অক্ষমতার কারণ জিজ্ঞাসা করা প্রধানমন্ত্রীর সময়োপযোগী পদক্ষেপ হবে। একই সঙ্গে প্রশাসনের সব কর্মকর্তাকে এই ‘তা-ব’ বন্ধে অপারগতার কারণ জানাতে হবে। সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে আমরা এই চাকরির দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সবসময় ওয়াকিবহাল ছিলাম। অধঃস্তনদের সবরকম কাজের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত উপরের কর্মকর্তার কাছে আমরা জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকতাম। এটাই প্রশাসনিক কাজের সৌন্দর্য। আমার জীবনের চাকরির প্রথম দরখাস্তে আমি কিছুতেই ণড়ঁৎ সড়ংঃ ড়নবফরবহঃ ংবৎাধহঃ লিখতাম না। যা নিয়ে আমাকে অনেকের কাছে কথা শুনতে হয়েছে। আমি লিখেছি, ণড়ঁৎং ভধরঃযভঁষষু অথবা ঝরহপবৎবষু ুড়ঁৎং । আমার ধারণা- এই ‘বিশ্বস্ত দাস’ লিখতে লিখতে সব কর্মকর্তা নিজেকে ওপরওলার দাসে পরিণত করে আর নিচের কর্মকর্তাদের নিজের দাস মনে করতে অভ্যস্ত হয়েছে! যদিও এটি ঔপনিবেশিক শাসনকাল থেকে নেটিভ বা দেশীয়রা ইংরেজের ‘দাস’ হিসেবে নিজ পরিচিতিকে স্বীকার করে নিয়েছিল! যাই হোক, আমরা ২০০৯-এর ফেব্রুয়ারিতে পিলখানা বিদ্রোহ দেখেছি। শুরুতে এ বিদ্রোহ অন্য বিডিআর ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়ছিল, সেজন্য এর বিস্তার বন্ধ করতে সব চ্যানেলে এ বিদ্রোহের প্রচার বন্ধ করা হয়েছিল। মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হয়। সুতরাং যে কোন গ-গোল, তা-ব, লুটপাট, সন্ত্রাস বন্ধ করতে প্রথম সূচনার স্থানটিতে সেটি সীমিত রেখে ঘটনার সেখনেই সমাপ্তি ঘটানো অত্যন্ত জরুরী। ২/৩ দিন ইন্টারনেট বন্ধ রাখলে এমন কিছু ক্ষতি হতো না। সম্ভবতঃ মোবাইল নেটওয়ার্ক দেড় দিন বন্ধ ছিল। বিভিন্ন দেশে গুজব ও জঙ্গীবাদ ছড়ানো, শিশু-কিশোরদের মধ্যে সহিংসতা বাড়ানোর দায়ে ফেজবুককে দায়ী করা হচ্ছে। এই সময়ে আমাদেরও সক্রিয় হতে হবে। ফেজবুকের কাছে মিথ্যা তথ্যের বিস্তার, সাম্প্রদায়িকতা ও জেহাদী প্রচারণার দায়ে অভিযোগ পাঠানোর এটি উপযুক্ত সময়। যেটুকু ভাল তথ্য প্রচার পায়, তা মন্দ, ঘৃণা প্রচারণা, ভ্রান্ত তথ্যের তুলনায় অনেক কম। শিশু-কিশোরদের সহিংস চলচ্চিত্র দেখিয়ে তাদের মনে সহিংসতা উস্কে দিচ্ছে। যার ফলে মায়া-মমতা-দয়া-মায়ার বোধ কমে যাচ্ছে। এটি কতটা উদ্বেগজনক এবং ভয়াবহ পরিণতি আনছে তা অভিভাবকরা উপলব্ধি করছে কিনা জানি না। তবে, তারা খেলাধুলা, গল্পের বই পড়া, আঁকা, গান গাওয়া, অভিনয় করা- এসব থেকে অবশ্যই দূরে সরে গেছে। সমাজের উন্নয়নের জন্য শিক্ষাক্রম, পাঠ্যবিষয়, শিক্ষা ও খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চার কাছেই ফিরে যেতে হবে। আমার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, জসীমউদ্দীন যেমন পড়তে হবে, তেমনি এক একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কয়েকটি যুদ্ধের বর্ণনাও পড়া জরুরী। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ যেমন পড়া জরুরী, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বলি বুদ্ধিজীবী হত্যার কাহিনীও জানতে হবে। জানতে হবে, হিন্দু-মুসলিমের মিলিত মুক্তিযুদ্ধের কথা, চা-শ্রমিকদের মুক্তিযুদ্ধের কথাও। এর পাশে লালন, শাহ আব্দুল করিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীমউদ্দীনের গান শুনতে ও গাইতে হবে। প্রধানমন্ত্রী খেলাধুলার প্রসারে খুবই ভাল কাজ করছেন। এ প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। যাত্রাপালার বিবেকের সত্য বাণী শুনে মন হবে উদার ও অসাম্প্রদায়িক। আমাকে পুলিশের আগে আমার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা বাঁচাবেন এবং প্রতিবেশীরা বাঁচাবেন। প্রতিবেশী যদি শত্রু হয়, রাজনীতিক যদি উদাসীন থাকে, তাহলে পুলিশ খুব বেশি সাহায্য করতে পারে না। ক্রমেই সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠা প্রতিবেশীদের দেখে আমিই চিন্তিত হয়ে উঠি। মনে প্রশ্ন ওঠে- দেবী দুর্গার বিসর্জনের দিন কেন বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউতে মিছিল নিয়ে রাজপথে নামতে পারে একটি ধর্মীয় দল? অথচ সেদিন তাদের রাজপথে নামার অনুমতি পাবার কথা নয়! এ কারণে আমার চেনা পাড়া-মহল্লার অনেক দুর্গা প্রতিমা পাড়ার ছোট পুকুরে বিসর্জন দিতে হয়েছে! কেননা সদরঘাট হয়ে বুড়িগঙ্গা যাবার রাস্তা গুলিস্তান পার হয়ে! সরকার ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধে কি কি কৌশল নির্ধারণ করছে জানি না। তবে, এবারের বিজয়ার দিনে জঙ্গী এবং দেশের শত্রুরা ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের মর্মস্থলে বিশাল একটি আঘাত দিয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে থাকা আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। সে চিড় অবশ্যই সারাবেন সবার প্রিয় প্রধানমন্ত্রী- এ ভরসা আছে। আমি নিজে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে তাদেরকে এই তা-বের হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি বলে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। জানিনা ভবিষ্যতের এমন ঘটনা থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে পারব কিনা! লেখক : শিক্ষাবিদ
×