ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তবু ভাল করতে আশাবাদী বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০০:৩২, ২৭ অক্টোবর ২০২১

তবু ভাল করতে আশাবাদী বাংলাদেশ

ধুমধাড়াক্কা টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশের অধারাবাহিক পারফরমেন্সে হতাশ অনেকে। ধুঁকে ধুঁকে প্রথম রাউন্ড উতরিয়ে চলমান টি২০ বিশ্বকাপের আসল লড়াইয়ে শামিল হয়েছে বাংলাদেশ দল। কিন্তু লঙ্কানদের বিরুদ্ধে ১৭১ রানের পুঁজি গড়েও আত্মসমর্পণ করেছে টাইগাররা। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে এজন্য দায়ী বাজে ফিল্ডিং, অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের রক্ষণাত্মক কৌশল ও বোলার ব্যবহারে চৌকষ হতে না পারা। ক্যাচ মিস না করলে আর অধিনায়ক সঠিক সময়ে সঠিক বোলার ব্যবহার করতে পারলে লঙ্কানদের বিরুদ্ধে টাইগাররা জয় পেত বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এক পর্যায়ে হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচ হারের পরও কথার ফুলঝুরি ছুটেই চলেছে ক্রিকেটারদের মুখে! তবে এখন সব ভুলে বাংলাদেশ দল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচ নিয়ে ভাবছে। আজ আবুধাবীতে সাবেক চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলবে টাইগারা। এই ম্যাচে ভুল শুধরিয়ে জয়ের আশা করছেন অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। কিন্তু দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের কথাবার্তায় সন্তুষ্ট হতে পারছেন না ক্রিকেটপ্রেমীরা। সুপার টুয়েলভে নিজেদের প্রথম ম্যাচে শ্রীলঙ্কার কাছে ৫ উইকেটে হারের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঢেউ বয়ে যায়। ম্যাচটির পর দলের সবচেয়ে সেরা ব্যাটার মুশফিকুর রহীম সমলোচকদের কড়া সমালোচনা করে তাদেরকে আয়নায় নিজের মুখটা দেখার পরামর্শ দিয়েছেন। এর আগে প্রথম রাউন্ডে স্কটল্যান্ডের কাছে ৬ রানে হারের পর ওমানকে ২৬ রানে পরাজিত করে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ। মাসকাটের ওই ম্যাচে সেরা খেলোয়াড় হন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। ম্যাচের পর তিনি সমালোচকদের একহাত নেন। সাকিব বলেছিলেন, আমরা জেতার জন্যই খেলি। সমালোচনা করা উচিত বুঝেশুনে। এরপর পাপুয়া নিউগিনিকে ৮৪ রানে উড়িয়ে দিয়ে প্রথম রাউন্ডের মিশন শেষ করে টাইগাররা। ওই ম্যাচের পর অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ বিস্ফোরক সব মন্তব্য করেন। তিনি ক্রিকেট বোর্ডের কর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ ভক্তদের সমালোচনা নিয়েও বিরূপ মন্তব্য করেন। এই ধারা এবার ধরে রাখলেন অভিজ্ঞ ব্যাটার মুশফিকুর রহীম। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৩৭ বলে ৫৭ রানের ইনিংস খেলার পর ম্যাচ শেষে রীতিমতো তেলেবাগুনে জ্বলে উঠেন তিনি। সিনিয়র ক্রিকেটারদের এমন আচরণে বিরক্ত অনেকেই। তাদের মতে, সমালোচনা সইতে পারার মানসিকতা থাকা থাকতে হবে। দীর্ঘ দিন রান না পাওয়া মুশির ওপর ছন্দে ফেরার চাপ ছিল। ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে তাকে সইতে হয়েছে সমালোচনা। লম্বা সময় পর একটা অর্ধশতকের ইনিংস খেলার পর মুশফিক বলেন, ভাল করলে তালি দেবে; খারাপ করলে গালি দেবে। আমি ১৬ বছর ধরে খেলছি, আমার জন্য এসব নতুন কিছু না। আমার কাছে এসব খুবই স্বাভাবিক মনে হয়। তবে যারা সমালোচনা করেন তাদের নিজেদের মুখটা একটু আয়নায় দেখা উচিত। কারণ তারা বাংলাদেশের হয়ে খেলে না, আমরাই খেলি। শুধু আমি না, ১৬ বছর ধরে যারা খেলছেন কিংবা তারও আগে থেকে, যারা টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার আগেও খেলেছেন। সবাই কিছু করার চেষ্টা করেছেন। কোন দিন হয়, কোন দিন হয় না। তবে দিনের শেষে আমরা দেশের প্রতিনিধিত্ব করি। আমাদের কাছে সবচেয়ে গর্বের বিষয় এটিই। মুশফিক আরও বলেন, টি২০ ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে রান করা সহজ নয়। হয়ত শুরুতে শীর্ষ তিনের ব্যাটসম্যানরা সময় পান। ইনিংস পুনর্গঠনের সময় পাওয়া যায়। এরপর সুযোগ নেয়া যায়। তবে আমরা যারা চার-পাঁচ-ছয়ে খেলে থাকি, আমাদের ধারাবাহিক রান করে যাওয়া একজনও দেখাতে পারবেন, যে ধারাবাহিকভাবে রান করে। উত্থান-পতন থাকেই। তবে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, কন্ডিশনের বিচারে ওই দিন যার ভাল অবস্থা তার ইনিংসটা যেন বড় হয়। এর মাঝেও অবশ্য ব্যতিক্রম আছেন সাকিব আল হাসান। ইতোমধ্যে তিনি দুই ম্যাচের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। সুপার টুয়েলভের প্রথম ম্যাচে ব্যাট হাতে না পারলেও বল হাতে দারুণ করেন। কিন্তু অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ সাকিবকে দিয়ে সময়মতো বোলিং না করানোয় জয় হাতছাড়া হয় বাংলাদেশের। ইংলিশদের বিরুদ্ধে ম্যাচে আবারও সাকিবের অলরাউন্ড পারফরমেন্স আশা করছে দেশবাসী। তার জ্বলজ্বলে নৈপুণ্যে ভর করেই প্রথম রাউন্ডের গ-ি পার করে আসল লড়াইয়ে উঠে এসেছে লাল-সবুজের দেশ। প্রথম রাউন্ডে নিজেদের প্রথম ম্যাচে স্কটল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়ায় শঙ্কার কালো মেঘ ভর করেছিল টাইগারদের তাঁবুতে। কিন্তু ওমান ও পাপুয়া নিউগিনির বিরুদ্ধে পরের দুই ম্যাচে দুর্দান্ত জয়ে বুক চিতিয়েই মূল লড়াইয়ে অর্থাৎ সুপার টুয়েলভে খেলা নিশ্চিত করে মাহমুদুল্লাহর দল। প্রত্যাশিত এই প্রাপ্তি সহজ করে দিয়েছেন ধারাবাহিকতার মূর্ত প্রতীক সাকিব। ৩৪ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডার ওমানের বিরুদ্ধে ম্যাচসেরা হওয়ার পর পাপুয়া নিউগিনির বিরুদ্ধেও সবার সেরা হয়েছেন। এই পথে তিনি গড়েছেন চোখ ধাঁধানো বিশ্বরেকর্ড। অর্থাৎ বাংলাদেশ তথা বিশ্ব ক্রিকেটের মহাতারকা সাকিব এখন টি২০ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট কব্জা করা বোলার। পাপুয়া নিউগিনির বিরুদ্ধে ৪ ওভারে মাত্র ৯ রান খরচায় ৪ উইকেট নিয়ে গৌরবময় এ রেকর্ড গড়েন সাকিব। তখন রেকর্ডটি পাকিস্তানের সাবেক তারকা শহীদ আফ্রিদির সঙ্গে ভাগাভাগি করলেও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে দুই উইকেট নিয়ে এককভাবে রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন সাকিব। টি-২০ বিশ্বকাপের ইতিহাসে এখন সাকিবের নামের পাশে জড়ো সর্বোচ্চ ৪১টি উইকেট। উইকেটগুলো নিতে ২০০৭ বিশ্বকাপ থেকে এখন পর্যন্ত সাত আসরে সাকিব খেলেছেন ২৯ ম্যাচ। আর আফ্রিদির ৩৯ উইকেট পেতে লেগেছে ৩৪ ম্যাচ। এ নিয়ে ক্যারিয়ারে ষষ্ঠবার ইনিংসে ৪ বা এর বেশি উইকেট পেয়েছেন সাকিব। গত আগস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও ৪ উইকেট নিয়েছিলেন ৯ রানে। টি২০ তে সাকিবের ক্যারিয়ারসেরা বোলিং ২০১৮ সালে। সেবার মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ২০ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার। এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩৮ বার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন সাকিব। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখানে তার ধারেকাছে নেই কেউ। বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসেই তার ওপরে আছেন কেবল ১৪ জন। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই সাকিবের সামনে একগাদা রেকর্ডের হাতছানি দিচ্ছিল। স্কটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচে ২ উইকেট নিয়ে টি২০ ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন। ছাড়িয়ে গেছেন শ্রীলঙ্কার কিংবদন্তি পেসার লাথিস মালিঙ্গাকে। বর্তমানে টি২০ ক্রিকেটে সাকিবের ভা-ারে জমা সর্বোচ্চ ১১৭ উইকেট। টি২০ বিশ্বকাপের ইতিহাসে বর্তমানে সাকিবকে টেক্কা দেয়ার মতো আশপাশে কেউ নেই। সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় খেলা চালিয়ে যাওয়াদের মধ্যে সাকিবের পরের অবস্থানে আছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের তারকা অলরাউন্ডার ডোয়াইন ব্রাভো। তার নামের পাশে শোভা পাচ্ছে ২৫ উইকেট। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব ক্রিকেটেরই বড় তারকা সাকিব আল হাসান। বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারও তিনি। এবারের বিশ্বকাপে তার সাফল্যের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে বাংলাদেশের সাফল্য-ব্যর্থতা। প্রথম রাউন্ডে এ স্বাক্ষরে রেখেছেন মাগুরার ছেলে। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে হওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপেও অপ্রতিরোধ্য ছিলেন সাকিব। সেবার সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বকাপ মিশনে গিয়েছিল টিম বাংলাদেশ। সেই স্বপ্ন পূরণ না হলেও বিশ্বমঞ্চ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব। ওই আসরে দল হিসেবে বাংলাদেশ সফল হতে না পারলেও সাকিবের কীর্তি জ্বলজ্বল করে জ্বলবে চিরকাল। রানের চূড়ায় উঠে বিশ্বকাপ মিশন শেষ করেন বাংলাদেশের অহংকার। বিশ্বকাপের এক আসরেই ৬০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন। গড় ছিল ৮৬.৫৭। সবমিলিয়ে সাকিব বিশ্বকাপে ৮ ম্যাচ খেলে ২টি শতক ও ৫টি অর্ধশতকের সাহায্যে করেন সর্বোচ্চ ৬০৬ রান। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে একমাত্র ম্যাচে তিনি অর্ধশতকের আগে আউট হন। কিন্তু সেই ইনিংসটিও ছিল ৪১ রানের। এমন অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতা ক্রিকেট ইতিহাসে আর কোন ব্যাটসম্যানেরই নেই। যে কারণে প্রত্যাশামতো বিশ্বকাপ শেষ করতে না পারলেও সাকিবের বীরত্বে গর্বিত হয়েছিল বাংলাদেশ। চলমান টি২০ বিশ্বকাপেও আলো ছড়াচ্ছেন তারকা এই অলরাউন্ডার। ইতোমধ্যে দুটি বিশ্বরেকর্ড গড়া সাকিবে ভর করে মরুর বুকে ভাল করার স্বপ্ন বুনছে টাইগাররা।
×