ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস শত শত কোটি টাকা হাতিয়েছে

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ২৭ অক্টোবর ২০২১

কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস শত শত কোটি টাকা হাতিয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সমবায় অধিদফতরের সব আইন কানুন মেনেই প্রকাশ্যে প্রতারণা করে গ্রাহকের পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির। সমবায়ভিত্তিক দারিদ্র্য নিরসনের অজুহাতেই এ ধরনের ভয়ানক জালিয়াতি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে এখন প্রশ্ন উঠেছে খোদ সমবায় অধিদফতরের ভূমিকা নিয়ে। র‌্যাব অবশ্য তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরবে। কেননা ২০১৯-২০ সালে সমবায় অধিদফতর অডিটও করে। ওই অডিটে দেখানো হয়, মাত্র ৫১৮ জন সদস্য। লেনদেন মাত্র ৮২ লাখ টাকা। অথচ তদন্তে ওঠে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক সংখ্যা ২০ থেকে ২৫ হাজার। প্রতিষ্ঠানটিতে লেনদেন হয়েছে শত কোটি টাকার বেশি। যা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার জসিম উদ্দিন ব্যক্তিগত এ্যাকাউন্টে অর্থ ট্রান্সফার করে মানিলন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ করেছেন। গড়েছেন নামে-বেনামে প্লট-ফ্ল্যাট ও জমি। ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ গড়ে তুলেছেন আটটি প্রতিষ্ঠান। র‌্যাবের দাবি, সমবায় অধিদফতরের নিবন্ধনভুক্ত হলেও প্রতিষ্ঠানটির সব ধরনের কার্যক্রম প্রতারণামূলক। নিয়ম অনুযায়ী, সমিতি পরিচালনার অনুমোদন থাকলেও আর্থিক লেনদেন অনুমোদিত নয়। এছাড়া এনজিও এবং মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরির আর্থিক লেনদেনের অনুমোদনও নেই। এসব অভিযোগই এখন তদন্ত করা হবে। তবে প্রাথমিক তদন্তে যে ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে তা খুবই মারাত্মক ও অবিশ্বাস্য। গত সোমবার রাজধানীর পল্লবীতে প্রতিষ্ঠানটির সামনে বিক্ষোভ করে দুই শতাধিক বিনিয়োগকারী। পরে র‌্যাব-৪ সোমবার দুপুর থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত মিরপুর ১১/এ, রোড নং-৬, প্লট-৪, নান্নু সুপার মাকের্টে অভিযান চালিয়ে কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডের প্রকল্প পরিচালক শাকিল আহম্মেদসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার অন্যরা হলেন, মোঃ চাঁন মিয়া (৩৮), এ কে আজাদ (৩৫), মোঃ রেজাউল (২২), তাজুল ইসলাম (৩১), শাহাবুদ্দিন খান (২৮), আব্দুস ছাত্তার (৩৭), মাসুম বিল্লাহ (২৯), টিটু মিয়া (২৮) ও আতিকুর রহমান (২৮)। এ বিষয়ে মঙ্গলবার কাওরানবাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, মূল অভিযুক্ত জসিম নিজেই সমিতির সভাপতি, সহ-সভাপতি তার শ্বশুর মোতালেব সরকার, সাধারণ সম্পাদক তার প্রথম স্ত্রী লাকী আক্তার এবং কোষাধ্যক্ষ তার শ্যালিকা শাহেলা নাজনীন। এমনকি যুগ্ম সম্পাদকও নিকট আত্মীয় লাভলী আক্তার। এটি এক রকম পারিবারিক সমিতি। প্রতিষ্ঠানটি সমবায় অধিদফতর কর্তৃক নিবন্ধনপ্রাপ্ত। সরকারী হিসেবে- প্রতিষ্ঠানটিতে ৫১৮ জনের কথা উল্লেখ করা হলেও গ্রাহকদের অভিযোগ ও র‌্যাবের তদন্তে উঠে এসেছে প্রতিষ্ঠানটিতে অন্তত ২০ থেকে ২৫ হাজার গ্রাহক রয়েছে। যারা শত কোটির বেশি টাকা লেনদেন করেছেন। প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি একটি ডিপিএস মাসে এক হাজার টাকা করে বছরে ১২ হাজার টাকা জমা দেয় তবে পাঁচ বছরের ৬০ হাজার টাকা জমা হবে। মেয়াদ শেষে তাকে ৯০ হাজার টাকা দেয়া হবে। টার্গেট সংগ্রহকারী ব্যক্তি প্রথম এক বছর প্রতিমাসে ২০০ টাকা এবং পরবর্তী চার বছর প্রতিমাসে ১০০ টাকা করে লভ্যাংশ পাবেন। আর কোম্পানির কোন সদস্য যদি নতুন কোন সদস্যকে এক হাজার টাকার এফডিআর করাতে পারে তাহলে টার্গেট সংগ্রহকারীকে মাসে এক হাজার টাকা এবং এফডিআরকারী সদস্যকে মাসে দুই হাজার টাকা প্রদানের প্রলোভন দেয়া হতো। প্রকৃতপক্ষে যা দেশে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান দিতে পারে না। তদন্তে দেখা গেছে, গ্রেফতার শাকিল আহম্মেদ ও চাঁন মিয়া ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়ে ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ’ এ বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে আগ্রহী করতেন। এভাবে প্রলুব্ধ হয়ে বস্তি এলাকার গার্মেন্টসকর্মী, রিক্সাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, সবজি ব্যবসায়ী, ফল ব্যবসায়ী, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষেরা বিনিয়োগ করতেন। প্রতি সদস্য মাসিক ১০০ থেকে এক হাজার টাকা করে কথিত ডিপিএস জমা করতেন। যা তিন বছরে ৩০ শতাংশ এবং পাঁচ বছরে ৫০ শতাশং মুনাফা প্রদানের শর্তে টাকা গ্রহণ করা হতো। কিন্তু ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী, তাদের নিয়মিত লভ্যাংশ দেয়া হতো না। ডিপিএসের মেয়াদ পূর্ণ হলেও পাওনা টাকা পরিশোধ করা হতো না। অধিক মুনাফার লোভে করোনার সময়েও ভুক্তভোগীরা সঠিক সময়ে ডিপিএসের টাকা জমা দিলেও লভ্যাংশ পায়নি। ভুক্তভোগীরা লাভের টাকা চাইতে গেলে হুমকি-ধমকি প্রদর্শন করা হতো। নারী গ্রাহকদের প্রতি অশালীন মন্তব্য, পুরুষ সদস্যদের টর্চার সেলে নিয়ে মারধর করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযান পরিচালনার সময় শাকিলের অফিসের টর্চার সেল থেকে মারধরের সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়েছে।
×