ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংখ্যালঘু নির্যাতনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ২৭ অক্টোবর ২০২১

সংখ্যালঘু নির্যাতনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ কোন অবস্থায় থামানো যাচ্ছে না সংখ্যালঘু নির্যাতন! সরকারকে অস্থিতিশীল করতে একের পর এক গুজব রটিয়ে, কখনও উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটনার জন্ম দিয়ে নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে একটি মহল। করা হচ্ছে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুরের ঘটনা। রীতিমতো ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে সংখালঘুদের হৃদয়ে। অতীতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাহায্য নিয়ে ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ নারকীয় ঘটনা ঘটালেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সে সুযোগ না পেয়ে তারা ছলচাতুরীর মাধ্যমে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কখনও বা ফেসবুকে অপ্রচার করে আবার গুজব রটিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করছে। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর (২০০১) দেশব্যাপী নারকীয় ঘটনার অবতারণা করে এই চক্রটি। সিরাজগঞ্জে পূর্ণিমার গণধর্ষণ, ভোলার ভেরেন্ডাবাড়ির ঘটনা, বাগেরহাটসহ দেশের সেই নারকীয় ঘটনা মনে করে আজও শিউরে ওঠে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। বাংলাদেশে যে কোন সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও রাজনীতি হয়। কিন্তু বিচার হয় না। ফলে থামছে না নির্যাতনের ঘটনাও। অভিযোগ, নেপথ্যে কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীনরা জড়িত থাকায় তাদের আইনের আওতায় আনা যায় না। দেশে একের পর এক সংখ্যালঘু নির্যাতন হলেও তার বিচার হয় না। কোন একটা ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হলে পরবর্তী ঘটনা ঘটত না বলেন, হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা মনে করেন। ঘটনার পর ঘটনা ঘটে যায়, কিন্তু বিচার হয় না। এতে নতুন নতুন ঘটনা ঘটাচ্ছে ধর্মের নামে এই জঙ্গীগোষ্ঠী। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও হিন্দু পল্লীতে হামলার ঘটনায় এ পর্যন্ত পুলিশ হামলায় এখন পর্যন্ত ২৩ জনকে আটক করা হয়েছে। সর্বশেষ গ্রেফতার হয়েছেন ‘মূল আসামি’ শহীদুল ইসলাম স্বাধীন ওরফে স্বাধীন মেম্বার। এদিকে হামলার ঘটনায় জড়িতদের ধরতে এখন তৎপর হলেও ঘটনার ১২ ঘণ্টা আগে খবর পেয়েও কোন ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। এ ঘটনার একদিন আগে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগে ঝুমন দাসকে গ্রেফতার করা হয়। হিন্দু মহাজোটের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রিপন দে বলেন, শুধু সুনামগঞ্জ নয়, তার আগেও যে কয়টি বড় ধরনের হামলা হয়েছে পুলিশ আগে পরিকল্পনার কথা জানলেও নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা নেয়নি। আর গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনইবা কী করেন? ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে রামুতে বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার ঘটনা ঘটে। প্রায় ৯ বছর পার হলেও কোন বিচার এখনও হয়নি। এ ঘটনায় মোট ১৯টি মামলা হয়েছিল। একটি মামলার চার্জশীট হলেও বিচার শুরু হয়নি। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল তারা সবাই জামিনে আছেন। আর যে উত্তম বড়ুয়ার নামে ফেসবুক পোস্টের অজুহাতে রামু, উখিয়া এবং টেকনাফে তা-ব চালানো হয়েছিল তিনি জামিন পেলেও এখন নিখোঁজ রয়েছেন। যদিও তদন্তে তার ফেসবুক পোস্টের কোন প্রমাণ মেলেনি। ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু বসতিতে হামলার তদন্ত প্রায় পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি। ওই সময় যাদের আটক করা হয়েছিল তারাও জামিনে মুক্ত। অন্যদিকে লেখাপড়া না জানা যে রসরাজের ফেসবুক পোস্টের ধর্মীয় অবমাননার কথা তুলে হামলা হয়েছিল তাকেই উল্টো দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়েছে। এখন জামিন পেলেও আতঙ্কে তার দিন কাটছে। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, নাসিরনগরে হামলার নেপথ্যে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংসদ সদস্য ও তার ভাই। তাদের আইনের আওয়তায় আনা হয়নি। একইভাবে রংপুর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ভোলায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার তদন্ত শেষ হয়নি। কাজল দেবনাথ বলেন, আমাদের জানামতে কয়েক বছরে কোন হামলারই বিচার হয়নি। প্রত্যেকটি হামলার পেছনেই ধর্মীয় গোষ্ঠীকে ব্যবহারকারী নেপথ্যের শক্তি রয়েছে। তাদের পরিকল্পনায়ই এসব হামলা হয়েছে। কিন্তু তারা ক্ষমতাবান আবার কেউ কেউ শাসক দলের। ফলে তারা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গত বছরের অক্টোবরে সাত মাসে সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটি জরিপ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয় গত বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর এই সাত মাসে ৬০টি পরিবারকে গ্রামছাড়া করা হয়েছে। মন্দিরে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের ২৩টি ঘটনা ঘটেছে। ২৭টি প্রতিমা ভাংচুর করা হয়েছে। বসতভিটা, জমিজমা, শ্মশান থেকে উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ২৬টি। সাতজনকে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য হুমকি দেয়া হয়েছে চারজনকে। বসত-ভিটা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে ৮৮টি। হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন ২৪৭ জন। তাদের হিসাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় মামলার হার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অনেক ঘটনায় মামলাও করা যায় না। আর বিচার পাওয়ার হার সর্বোচ্চ ৫-৬ শতাংশ। কাজল দেবনাথ বলেন, এতদিন ছিল ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হামলা। আর সুনামগঞ্জের ঘটনায় দেখা গেল হেফাজত নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করায় হামলা। এর সঙ্গে ধর্ম অবমাননার কী সম্পর্ক আছে? আর মামুনুল হক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলার কথা বলেছেন। আমরা যদি বলতাম তাহলে এখনও কি মুক্ত বাতাসে থাকতে পারতাম? এ ঘটনায় ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি গ্রেফতার হয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি মনে করি এর পেছনে আরও বড় শক্তি আছে। তারা এখনও আইনের আওতায় আসেননি। যারা হামলা করে তারা গ্রেফতার হয় না। বিচারও হয় না। কাজল দেবনাথ বলেন, এর পিছনে আছে রাজনীতি। ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার। আরও আছে হিন্দুদের জমি ও সম্পত্তি দখল। আর এটা ক্ষমতা না থাকলে করা যায় না। এখন সব মতলববাজদের টার্গেট সংখ্যালঘুরা। হিন্দু মহাজোটের রিপন দে বলেন, আমরা বারবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি। তিনি বলেন আটকরা জামিন পেলে তাদের কিছু করার নাই। আর যখন প্রশ্ন করি অপরাধ না করেও এসব ঘটনায় তাহলে সংখ্যালঘুরা কেন আটক আছেন? তার জবাবে তিনি বলেন, নিরাপত্তার কারণে আটক রাখা হয়। মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, এই হামলায় পেশিশক্তি যেমন থাকে। রাজনৈতিক শক্তিও থাকে। রামুতে যেমন দলমত নির্বিশেষে সব দলকে একত্রিত করে হামলা চালানো হয়েছে। সাধারণভাবে এমন একটি ধর্মীয় জিকির তোলা হয় যে তখন অনেক ক্ষেত্রেই সব দল এক হয়ে হামলা চালায়। রাষ্ট্র আসলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। শাসক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাবেক আইন সম্পাদক এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, সুনামগঞ্জের ঘটনায় গ্রেফতার ওই ব্যক্তি যুবলীগের কেউ নন। যুবলীগের পক্ষ থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে তিনি প্রাথমিক সদস্যও নন। আর নাসিরনগরের ঘটনায় সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। দলীয়ভাবে নয়, কেউ ব্যক্তিগতভাবে ওই ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু দলীয় পরিচয়ের কারণে তাদের সরকার ছাড় দেয়নি। তিনি বলেন, সরকার সাম্প্রদায়িকতাকে কোনভাবে উৎসাহিত করে না। বরং কঠোর হাতে দমন করে। যা ঘটছে তা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য কেউ নেপথ্যে থেকে ঘটাতে পারে। সরকার এটাকে কঠোরভাবে নিয়েছে। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার প্রেক্ষাপটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পক্ষে বলা হচ্ছে যে এ ধরনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও শাস্তি না হওয়ায় পরিকল্পিত হামলা ও নির্যাতন থামছে না। ২০১৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বনগ্রাম বাজারে ধর্মীয় অবমাননার ভুয়া অভিযোগে অর্ধশত হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বনগ্রাম বাজারে স্থানীয় ব্যবসায়ী বাবলু সাহার ছেলে রাজীব সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ফেসবুকে ইসলামের কটূক্তি করে পোস্ট দেয়ার। বনগ্রাম হাটের দিনে শত শত লিফলেট বিলিয়ে সাধারণ জনগণকে উত্তেজিত করা হয়। কিন্তু পরে পুলিশের তদন্তে দেখা যায় রাজীব এরকম কোন পোস্ট দেয়নি। অথচ ধর্মীয় অবমাননায় উস্কানি পেয়ে সেদিন হাজার হাজার লোকজন সাহাপাড়ায় হামলা করে। এলাকার প্রায় ৩০-৩৫টি হিন্দু বাড়িতে ভাংচুর এবং বাজারে কেন্দ্রীয় কালী মন্দিরসহ বাবলু সাহার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালায়। বাড়িতে ভাংচুর করে পারিবারিক মন্দিরে আগুন দেয় আর প্রতিমা ভাংচুর করে। ২০০১ সাল থেকে এক হাজার তিনশ’র বেশি ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছে মাইনরিটি ওয়াচ। সংস্থাটির সভাপতি রবীন্দ্র ঘোষ বলছেন, বাংলাদেশে এরকম বহু ঘটনায় মামলাও হয় না। তিনি বলেছেন, অনেক সময় আমাদের উপস্থিতিতে মামলা নিচ্ছে। কিন্তু মামলা নেয়ার পর দেখা যাচ্ছে এইটা বছরের পর বছর এফআরটিএ হচ্ছে না চার্জশীটও হচ্ছে না। সেখানে পুলিশের যে গাফিলতি সেটা প্রণিধানযোগ্য। ঘোষের মতে মামলা নিতে গেলে দ্রুত বিচার আদালতে মামলা নেয়া উচিত। বাংলাদেশে এ আইনতো আছে। তো এই সেকশনে মামলা নেয়া হচ্ছে না কেন? এসব ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে এবং পুলিশের পক্ষ থেকে উদাসীনতা আছে। বর্তমান আইনে সুষ্ঠু বিচার ও শাস্তি না হওয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশে এখন সংখ্যালঘু নিরাপত্তায় আলাদা আইন করারও দাবি তুলেছেন। ২০০৯ সালে চারদলীয় জোট সরকার দায়িত্বগ্রহণের পর বিগত ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সহিংস ঘটনা তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, নির্যাতিতরা অনেকে মামলা করতে সাহস পায় না। অপরাধীরা মামলা দায়ের করতে না চাইলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করবে। আবার অনেকে মামলা সাক্ষীর অভাবে খালাস হয়ে গেছে ব আলামত নষ্ট করায় অপরাধীরা পার পেয়ে গেছে। এ জাতীয় মামলা পুরুজ্জীবিত করতে হবে। কিন্তু এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোন মামলা দায়ের না করায় আবারও তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারই ফলে সাতক্ষীরা ও দিনাজপুরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও নির্যাতন চালায়। পরে রামুতেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। প্রধানমন্ত্রী তখন দেশের বাইরে থেকেও বিষয়টি খোঁজ-খবর নেন এবং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। এর পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ১৫ দিনের মধ্যে নির্বাচন পরবর্তী ঘটনার মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন। কিন্তু তার পরও কোন মামলা দায়ের করা হয়নি। দেশের বিভিন্ন থানায় এ ঘটনার জন্য মামলা দায়ের করা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কিছুদিন আগেও নির্বাচন পরবর্তী সহিংস ঘটনার মামলা করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যে সকল থানায় মামলা করার সিদ্ধান্ত হয় সেগুলো হয়-পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ থানা, ভোলার লালমোহন, পিরোজপুরের নাসিরাবাদ, যশোরের সদর ও কেশবপুর, ডেমরার যাত্রাবাড়ী, পিরোজপুর সদর, সিলেটের বিশ্বনাথ, ঢাকার মেট্রোপলিটন এলাকা, ফেনী সদর, বাগেরহাট সদর, চট্টগ্রামের রাউজান, রাজশাহীর দুর্গাপুর, নাটোর সদর, পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া। এসকল এলাকার সম্ভাব্য নামও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশকে জানানো হয়। কিন্তু এ সকল এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন মামলা দায়ের হয়নি। ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। ধর্ষণের শিকার হয়েছে যত্রতত্র। খুন, লুণ্ঠন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ সকল মানবতাবিরোধী সহিংসতায় আক্রান্ত নিরীহ ব্যক্তি ও পরিবারের শোক, দুঃখ ও বেদনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর মুহূর্তেই খুন, লণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি ধর্ষণ শুরু করে বিএনপি-জামায়াত জোটের নরপিশাচরা। আবাল-বৃদ্ধা-বণিতা, প্রতিবন্ধী কেউ এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি তখন। হায়নারা যেন দল বেঁধে নামে ধর্ষণে। ৯ বছরের শিশু কাজলীও ধর্ষণের শিকার হয় এই নরপশুদের হাতে। মদ খেয়ে ধর্ষণে মাতোয়ার হয়ে ওঠে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। এ সময়ে ঘটনা শুধু মধ্যযুগীয় নয়, যে কোন সময়ের বর্বরতাকেও হার মানায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিশ লাখ মা বোন সম্ভ্রম হারালেও এ বর্বরতা সে ঘটনাকেও ম্লান করে দেয়। এদের সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ, সম্পদ লুণ্ঠন, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, শারীরিক নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের মতো অসংখ্য ঘটনায় মানবতা ক্রন্দনরত। সারাদেশে একযোগে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ল-ভ-, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তির নারকীয় তা-ব, হত্যা, ধর্ষণ, উচ্ছেদ, লুণ্ঠন, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগসহ এমন কোন হীন কাজ নেই যা ঘটেনি। পাশবিক! জান্তব আক্রোশ। হিংস্রতা। প্রতিটি ঘটনা যেন মথিত হৃদয়ের বেদনার্থ সমগ্রতা নিয়ে জীবন্ত অসহায় চিৎকারে বলেছিল এই কি আমাদের জন্মভূমি। কমিশনের রিপোর্টে ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী সহিংস ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের পাশাপাশি উস্কানি দাতাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে বলা হয়, এ সময়ে উস্কানিদাতারা মনে করেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস হয়েছে। তারা বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন করে সাম্প্রদায়িক সংবিধান তৈরি করে। এ সময়ে উগ্র মৌলবাদের উত্থান ঘটে। তারা পাকিস্তানী ভাবধারায় এ দেশ পরিচালনার উদ্দেশ্যে এ জাতীয় কাজ করে। তদন্ত প্রতিবেদনে সহিংস ঘটনার প্রকৃতি অনুযায়ী ছয়টি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ওই সময়ে অনেক ঘটনা রয়েছে, যা মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়নি। এ জাতীয় সকল বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে মামলা দায়ের করা, কোন কোন মামলা পুনরুজ্জীবিত করা, তদন্ত না করে যে সকল মামলা চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রদান করা হয়, সে সকল মামলার পুনঃতদন্ত করা, কিছু মামলা রিভিউ করা, কিছু মামলা আপীল করা এবং সহিংস প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে বের করতে প্রতিটি জেলায় ছোট আকারে তদন্ত কমিশন বা কমিটি গঠন করা। প্রতিবেদনে বলা হয়, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় সংখালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি কিছু আওয়ামী নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে মধ্যযুগীয় বর্বরতা। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকের বাড়ি লুট, মায়ের সামনে কন্যাকে ধর্ষণ, স্বামীকে বেঁধে তার সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ, কোন কোন ক্ষেত্রে ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়াসহ লোমহর্ষক অনেক ঘটনার বর্ণনা রয়েছে এতে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর একের পর এক হামলা হতে থাকে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, জমি দখল করা, হাত-পা কেটে নেয়া এবং খুন-ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু কোন একটি ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে পরবর্তী ঘটনা হয়তো ঘটত না বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা।
×