ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পায়রার মতো অলস বসিয়ে রাখতে হতে পারে

রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নিয়ে শঙ্কা

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ২৬ অক্টোবর ২০২১

রূপপুর পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নিয়ে শঙ্কা

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ পাবনায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে বসেছে বহুল প্রতীক্ষিত পারমাণবিক চুল্লিপাত্র অর্থাৎ নিউক্লিয়ার রিএ্যাক্টর প্রেসার ভ্যাসেল। এটাকে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের হৃৎপি- বলা হয়। চলতি মাসের ১০ তারিখে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এর উদ্বোধন করেন। রাশিয়া থেকে দ্বিতীয় ইউনিটের রিএ্যাক্টরটি পাঠানোর প্রক্রিয়াও সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৩ সালে নির্ধারিত সময়েই উৎপাদন শুরু করতে পারবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট। বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগোলেও অনিশ্চয়তা রয়েছে এর সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন পর্যন্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, জরিপ ও কিছু নক্সা তৈরি ছাড়া সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ তেমন একটা এগোয়নি। তারা বলছেন, সঞ্চালন লাইন সময়মতো নির্মাণ না হলে উৎপাদিত বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাবে না। সেক্ষেত্রে বৃহৎ এ বিদ্যুতকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখতে হবে। এর বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে গুনতে হবে বিপুল পরিমাণ অর্থ। আর্থিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বিদ্যুতকেন্দ্রটি। তবে সঞ্চালন লাইন তৈরির কাজে নিয়োজিত পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লি. (পিজিসিবি) বলছে, পরিকল্পনা অনুযায়ীই কাজ হচ্ছে। যথাসময়ে শেষ হবে সঞ্চালন লাইন তৈরির কাজ। তবে ঠিক কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে তা এখনই আগাম বলতে নারাজ প্রতিষ্ঠানটি। জানা যায়, সরকারী মালিকানাধীন রূপপুর পারমাণবিক এ বিদ্যুতকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে ভারতের ‘লাইন অব ক্রেডিট’ (এলওসি) চুক্তির সহায়তায়। ১০ হাজার ৯৮ কোটি টাকার এ প্রকল্পের ৮ হাজার ২১ কোটি টাকা দিচ্ছে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক। বাকিটার সংস্থান হচ্ছে সরকার ও পিজিসিবির নিজস্ব অর্থায়নে। বিদ্যুত প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে গৃহীত প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১৮ সালের ১০ এপ্রিল। বাস্তবায়নের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। একনেকে অনুমোদনের এক বছর পর ২০১৯ সালের ২৬ মে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এ নিয়ে চুক্তি সই হয়। ৪৬৪ কিলোমিটারের ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্পটি সহজে ও দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য ৪টি প্যাকেজে বিভক্ত করা হয়। এগুলো হলো ১০২ কিলোমিটার রূপপুর-বগুড়া লাইন, ১৪৪ কিলোমিটার রূপপুর-গোপালগঞ্জ লাইন, ১৪৭ কিলোমিটার রূপপুর-ঢাকা লাইন ও ৫১ কিলোমিটার আমিনবাজার-কালিয়াকৈর লাইন। এর মধ্যে ১৩ কিলোমিটার নদী পারাপার। এ নদী পারাপার লাইনের মধ্যে ছয় কিলোমিটার পদ্মা নদীতে ও সাত কিলোমিটার যমুনা নদীতে স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও প্রায় ৩ বছর পর কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজে তেমন একটা অগ্রগতি হয়নি। গত বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক ভৌত অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এরপর করোনার কারণে চলতি অর্থবছরেও অনেকটা স্থবিরতার মধ্যেই রয়েছে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ। তবে করোনার পরে কাজে আবারও গতি ফিরেছে বলে দাবি করেছেন পিজিসিবি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী পারাপার লাইন প্যাকেজের দরপত্র মূল্যায়ন করে ঠিকাদারদের তালিকা এক্সিম ব্যাংকের কাছে পাঠানো হয়েছে। ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের ঋণ হওয়ায় এখানে বেশকিছু শর্ত রয়েছে। বিশেষত লোকবল নিয়োগ, মালামাল ক্রয়, পরামর্শক নিয়োগসহ আরও কিছু কাজ তাদের তত্ত্বাবধানে হবে। শর্তে ৭৫ শতাংশ মালামাল ভারত থেকে আমদানি করার কথা বলা হয়েছে। বাকি ২৫ শতাংশ সংগ্রহ করতে হবে স্থানীয়ভাবে এবং অন্যান্য দেশ থেকে। সব কিছু মিলিয়ে একটু সময়তো লাগবেই। তবে সঞ্চালন লাইন নির্মাণে গতি এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রকল্প এলাকায় পুরোদমে কাজ চলছে। এরই মধ্যে টাওয়ার নির্মাণে ডিজাইন, রুট সার্ভে, অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা কাজ শেষ হয়েছে। এটি একটি বড় প্রকল্প। এ প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদন, দরপত্র আহ্বান, ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম করতে একটু দেরি হলেও আগামী বছরের আগামী বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে তৈরি করে দেয়ার কথা। বাঘাবাড়ি থেকে রূপপুর লাইনের কাজ চলমান। রিভার ক্রসিংয়ের টেন্ডারটাতে একটু সময়ক্ষেপণ হয়েছে। তবে ২২ এর জানুয়ারির মধ্যে পদ্মার ওপর লাইন তৈরির কাজ হয়ে যাবে। সেতু কর্তৃপক্ষও চেষ্টা করছে। রূপপুর বিদ্যুতকেন্দ্রের কাজের অগ্রগতি বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা সমন্বয় করে এগিয়ে যাচ্ছি। কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসার আগে বেশকিছু লাইনের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আশা করছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। জানা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ রাশিয়ানরা যেভাবে এগিয়ে নিচ্ছে তাতে ২০২৩ সালের মধ্যেই কাজ শেষ হবে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুতকেন্দ্রটির ফুয়েল লোড করা হবে। তার আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে অবশ্যই গ্রিড লাইনের কাজ শেষ করতে হবে। যদি তা না করা যায় তাহলে পায়রা তাপ বিদ্যুতকেন্দ্রের মতো রূপপুরকেও সঞ্চালন লাইনের জন্য বসিয়ে রাখতে হবে। যদি নির্ধারিত সময়ে গ্রিডলাইনের নির্মাণকাজ সম্ভব না হয় তাহলে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের উৎপাদন বিলম্বিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, সময়মতো সঞ্চালন লাইনের কাজ শেষ না হলে তা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, পরিকল্পনার সময় সবসময় উৎপাদনকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। কিন্তু বিদ্যুতের ভ্যালু চেইনটা যদি আমরা বিবেচনা করি, তাহলে উৎপাদন-সঞ্চালন-বিতরণ কোনটির গুরুত্ব কম নয়। কিন্তু পরিকল্পনাবিদরা সবসময় সঞ্চালনকে দ্বিতীয় অগ্রাধিকার দেন। ফলে আমরা দেখতে পাচ্ছি পায়রা তাপ বিদ্যুতকেন্দ্র প্রস্তুত হওয়ার পরও তা বসে থাকছে। সেক্ষেত্রে রূপপুরের একই অবস্থা হতে যাচ্ছে। এর আগে চলতি বছরের ৩১ মার্চ ১৬০০ মেগাওয়াটের পায়রা তাপ বিদ্যুতকেন্দ্রের উদ্বোধন হলেও সঞ্চালন লাইন তৈরি না হওয়ার কারণে মাত্র ৬২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত জাতীয় গ্রীডে যোগ হচ্ছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন জানান, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে একটি সঞ্চালন লাইন যাবে। সেতুর কাজের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চালন লাইনের কাজেরও অগ্রগতি হবে। তাই এখন সিঙ্গেল লাইন দিয়ে জাতীয় গ্রীডে ৬২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত যোগ হচ্ছে। রূপপুরের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতিতে সঞ্চালন লাইন দিয়ে বিদ্যুত জাতীয় গ্রীডে যোগ হবে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, একনেকে অনুমোদনের পর ঠিকাদার ও বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতেই অনেক সময় চলে গেলেও আশা করা যাচ্ছে নির্দিষ্ট সময়েই সঞ্চালন লাইন তৈরি হবে। জানা যায়, রূপপুর বিদ্যুতকেন্দ্রে বর্তমানে সাড়ে চার হাজারের বেশি বিদেশী নাগরিক কাজ করছেন। অধিকাংশই রাশিয়ার। এ ছাড়া ইউক্রেন, উজবেকিস্তান ও ভারতের কিছু দক্ষ প্রকৌশলী রয়েছেন এই প্রকল্পে। এ ছাড়া জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরাও খ-কালীন পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। দেশীয় বিশেষজ্ঞেরা বিভিন্ন কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছেন। বিদ্যুতকেন্দ্রটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেশের ১ হাজার ৪২৪ জনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ধাপে ধাপে তাদের রাশিয়া পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
×