ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সোনার বাংলা তোমায় ভালবাসি

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ২৬ অক্টোবর ২০২১

সোনার বাংলা তোমায় ভালবাসি

গত ক’দিনের ঘটনা যেন অসহায় চোখে দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। পূজা এতদিন মহাসমারোহে হলেও এবার হয়নি। যে বা যারাই করুক এটাকে কোনভাবে বিচ্ছিন্ন বলা যাবে না। থেমে থেমে আক্রোশ ও আক্রমণ চলছে। বেশিরভাগ মানুষ চায়নি বলেই ঘটনা পুরো দেশে ছড়ায়নি। এসব সাধারণ মানুষকে স্যালুট। কিন্তু হৃদয়ে যে দাগ রেখে গেল তার জন্য সমাজ ও নৈতিকতার দিকটা ভাবার দরকার আবার। পাঠ্যক্রম বদলানো থেকে আপোসের সবটাই আজ বুমেরাং। সরকার ও প্রশাসন থামাতে পারেনি। এটাও সত্য। নৈতিকতা এক সময় ভ‚ষণ ছিল সমাজের। সে সময় আমাদের জীবন ছিল প্লেইন লিভিং আর হাই থিংকিং-এর আদর্শে এক সরল জীবন। আমরা এখন ব্যাকডেটেড মানুষ। বিষয়টি যেমন জীবনযাপন, পোশাক, খাদ্য কিংবা কথায় টের পাই তেমনি মনে করিয়ে দেয় সময় সময় নানা ঘটনার আকস্মিক ধাক্কাগুলোও। এ এক আজব যুগ। এখন কোনটা নৈতিক কোনটা অনৈতিক বোঝা দায়। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীকে দোষারোপ করি আমরা। ভাবি তারা যুগের প্রবাহে নানা ধরনের আজগুবি কাণ্ড ঘটায়। তাদের ভাষা, পোশাক আমাদের চোখের পীড়ার কারণ হয়। কিন্তু আসলে কি তা সত্যি? আমরা যখন যৌবনের শুরুতে বেলবটম প্যান্ট পরতাম তখনও আমাদের আমাদের অভিভাবকরা বিস্ময়ের চোখে তাকাতেন। ভাবতেন এ আবার কি রে বাবা! হঠাৎ নিচের দিকে এসে ঢোলাঢালা এ এক আজব পাতলুন। এটাও ঠিক হিল দেয়া জুতা না পরলে সে পাতলুনের নিচের দিকটা ময়লা-আবর্জনা কুড়িয়ে নিত মহানন্দে। এমন সব ঘটনা যে কোন সমাজে ঘটে। পরিবর্তন মানুষকে মানতে হয়। আর পরিবর্তনের ভেতর দিয়েই মানুষ পৌঁছে যায় আধুনিকতায় নতুন কোন গন্তব্যে। স¤প্রতি আমাদের দেশে যত অঘটন আর মুখরোচক কাহিনী ঘটেছে তার পেছনে আসলে কতজন তরুণ-তরুণী রয়েছে? সব ঘটনার নেপথ্যে মধ্যবয়সী পুরুষ কিংবা নারী। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত পুরুষ মানেই এখন যৌনতার ইন্ধন কিংবা আকামের নায়ক। কেউ কাউকে ভোগ করে, কেউ কাউকে প্ররোচনা দিয়ে কেউ অর্থ আত্মসাৎ করে বা লুটপাট করে সংবাদের শিরোনাম হয়। আর নারীরাও বা পিছিয়ে থাকবে কেন? নৈতিকতার কথাই যদি বলেন দেখবেন এর দেয়াল তারাও ভেঙ্গে ফেলেছে অনেক আগে। কেউ লুটপাট, কেউ মধুচক্রের হোতা আর কেউ কেউ রাজনীতির নামে সমাজে মাফিয়া হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এদের একেকজন যখন ধরা পড়ে তখন আমরা অবাক হই। ভাবি- ওহ্ এমনও ঘটে? কিন্তু এমন সরল ভাবনার কি আসলে কোন মানে হয়? প্রত্যেকটি ঘটনা মিডিয়ায় আসার পর দেখা যায় এসব নারী-পুরুষের বাড়িতে বিয়ারের বোতল, মদের খালি বা আধাভর্তি কয়েকটা বোতল, হরিণের চামড়া বা এমন জাতীয় কিছু থাকে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় এসব কোথায় থাকে এতোদিন? কেনই বা কর্তারা এসব আগে থেকে জানেন না? আর জানলেও কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল? আইন তার নিজস্ব গতিতে চলুক। হোক বিচার। আসল কথা আমরা চাই সব ধরনের দুর্নীতি ও অপরাধমুক্ত দেশ ও সমাজ। আমি একটু পেছন ফিরে তাকাতে চাই। প্রাইমারী ও হাইস্কুলের পর কলেজ জীবন এটুকু আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আজ মনে হয় এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ বুঝি। প্রাইমারী স্কুলে আমাদের টিচাররা ছিলেন অভিভাবকের চেয়েও বড় কেউ। তারা আমাদের কাছে দেবতুল্য। পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এটা জানতাম তারাই মানুষের বীজতলা তৈরি করেন। তাদের ভয় পেতাম তারা মার লাগাবেন বলে। কিন্তু মাঝে মাঝে তাদের স্নেহ আর ভালবাসা বয়ে যেত নদীর ধারার মতো। এরপর হাই স্কুলের জীবন। সেখানকার স্যারেরাও ছিলেন আমাদের অভিভাবক। আমাদের ইংরেজী স্যার ছিলেন কড়া একজন মানুষ। তার অনেক শর্তের ভেতর একটি ছিল জামার হাত গোটানো যাবে না। লম্বা হাতের যে কোন জামার আস্তিন কোন ভাবে গুটানো থাকলে হয় প্রহার নয়তো বকা খাওয়াই ছিল নিয়তি। তিনি আমাদের অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। যে কোন অভিযোগ বা পড়াশোনার ঘাটতি সব খুলে বলতেন। মাঝে মাঝে তার ভাষা পথ হারাত বটে কিন্তু সেগুলো এখন হাসির খোরাক মাত্র। বড় জোর এই কুলাঙ্গার ছেলেকে নিয়ে কি করবেন আপনারা? বা এই ছাগল তো মানুষ হবে না। এমন কঠিন কঠোর মানুষটি আমাদের স্কুল শেষ হবার দিন ক্লাসে এসেছিলেন একটা লম্বা ছিপছিপে বেত নিয়ে। আমরা সবাই অবাক। শেষদিনও কি তিনি আমাদের কাউকে কাউকে মারবেন? সে দিনটি আমি কখনও ভুলব না। সেদিন ক্লাস শেষ হয়েছিল কান্না আর ভালবাসা দিয়ে। সে বেতটি তিনি টুকরো করে ভেঙ্গে কেঁদে দিয়ে বলেছিলেন, এটা দিয়ে তোদের অনেক মেরেছি। শুধু একটা কারণে, তোরা মানুষের মতো মানুষ হবি বলে। তার কান্না আমাদের এই কথা বলেছিল, কঠিন হলেও তারাই আমাদের আলোর দিশারী। দিনকাল পাল্টেছে। এখন এমন সব কথাবার্তা ফাঁস হয় যা শুনে আমরা লজ্জায় মুখ লুকাই। দেশের স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের মানুষ এখনও অভিভাবক মানে। জানে তাদের কাছে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যত গচ্ছিত। ছেলেমেয়েরা তাদের কাছেই শিখবে নৈতিকতা। কিন্তু সম্প্রতি কি দেখছি, কি শুনছি আমরা? এমন ভাষায় তো যাদের আমরা ছোটলোক বলে তুচ্ছ করি তারাও কথা বলে না। আমি কারও ব্যক্তিগত নিন্দা বা বিদ্বেষ ছড়ানোকে লেখার উপজীব্য মনে করি না। আমার একটাই প্রশ্ন যতবড় আঘাত আর রাগ এসে ভিড় করুক কেন আমাদের ভাষা তার সীমা ছাড়াবে? বিষয়গুলো যদিও দুদিক থেকে ভাবা দরকার। একদিকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁস আর বেইমানি। অন্যদিকে কঠিন এক নিদারুণ বাস্তবতা। জিহ্বা এমন একটা অঙ্গ যা বত্রিশ পাটি কঠিন শক্ত দাঁতের ভেতর নিরাপদে থাকতে পারে। যে দাঁতগুলো মাংস চিবিয়ে হাড্ডি টুকরো করে তাদের ফাঁকে এর নিরাপদ থাকার কারণ তার নমনীয় শীতল অবস্থান। সে জিহ্বা নিয়ে চমৎকার লিখেছেন সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। আর আমরা সবাই জানি এই এক ফালি জিনিসটা সময় মতো তলোয়ারের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। এ যেমন মায়া ভালবাসা প্রেম বাড়াতে পারে কাউকে দুশমন থেকে বন্ধু করে তুলতে পারে তেমনি পারে বন্ধুকে দুশমন করে ছাড়তে। তার জন্য খুব বেশি সময়ের দরকার হয় না। আমাদের সমাজে দেশে রাষ্ট্রে বহু খ্যাতিমান মানুষের সবর্নাশ হয়েছে শুধু জিভের কারণে। তবু আমরা একে বাগে রাখতে ভুলে যাই। অহঙ্কার, রাজনৈতিক দম্ভ আর জিভের অসংযতায় আজ যখন সবাই কম-বেশি আক্রান্ত তখন বাল্যপাঠের সেই বাণী মনে পড়ে। যেখানে বলা হয়েছিল : স্বীয় জিহ্বাকে শাসনে রাখবে। এ কথা না মানলে যে কি হয় তাও আমাদের অজানা নয়। নৈতিকতার এই স্খলন বিপজ্জনক। দেশ ও জাতির জন্য এর সুরক্ষা আজ জরুরী। লেখক : সিডনি প্রবাসী [email protected]
×