ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী

প্রকাশিত: ২১:৩২, ২৬ অক্টোবর ২০২১

মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসছে। বিশ্বের অনেক দেশে লকডাউন নেই বললেই চলে। এটি একটি স্বস্তির বিষয়। বিশ্ব অর্থনীতি এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। অনেকেই মনে করছেন বিশ্ব অর্থনীতি এখন উত্তরণের পথে। এই উত্তরণ বা ঘুরে দাঁড়ানো সকল দেশের জন্য সমহারে হবে কিনা এই নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। করোনা পরবর্তী অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বে নানা ধরনের আলোচনা চলমান। যাতে বিশ্বের সকল দেশ একটি ভারসাম্যময় অর্থনীতিতে বিরাজ করতে পারে। তাহলেই হবে সব মানুষের মঙ্গল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতি উত্তরণের পথে থাকলেও প্রবৃদ্ধি সমভাবে হবে না। বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়ায় বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। এতে বৃদ্ধি পাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, বিশ্বে আবার ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ পরিস্থিতির মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এটি এমন এক অর্থনৈতিক অবস্থা, যেখানে কোন অর্থনীতি একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি হার বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়া ও বেকারত্বের হার বেড়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। ফলে আমাদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে যা আমাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে যা সাধারণ মানুষের জন্য তাদের জীবন জীবিকা সচল রাখতে অনেক বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। একে অর্থনীতির জন্য খুব খারাপ সময় হিসেবে বিবেচিত করা হয়। কারণ এ সময় মূল্যস্ফীতি কমাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য হিমশিম খেতে হয় এবং একে নিয়ন্ত্রণ করাও সহজ নয়। যার জন্য ধনী দেশগুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে গরিব দেশগুলো যেন কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাধারণত ঋণের ওপর সুদের হার বৃদ্ধি করে। ফলে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমে যায় এবং বিনিয়োগও ব্যয়বহুল হয়। অর্থাৎ বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, বিনিয়োগ হ্রাস পায়। আর বিনিয়োগ হ্রাস পেলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি কম হয়। ফলে অর্থনীতি বিশাল ধাক্কা খায় এবং মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হয়। মূলত করোনা মহামারীতে বিশ্ব অর্থনীতি তীব্র চাপের মধ্যে পড়েছে। উৎপাদন কমে যাওয়াসহ নানা সমস্যায় ভুগছে বিশ্ব অর্থনীতি। এশিয়া, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলো উচ্চমূল্যস্ফীতির সমস্যায় পড়ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এর প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে রয়েছে। বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যসহ নানা ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। বিশ্ব অর্থনীতিতে যখন সরবরাহের তুলনায় চাহিদা যদি বৃদ্ধি পায় তখন সাধারণত মূল্যস্ফীতি হয়ে থাকে। বিশেষ করে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি। পণ্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে কোম্পানি বা সরকারকে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করতে হয়। এতে মূল্যস্ফীতি দেখা যায়। অর্থনীতিবিদরা মনে করছে, বাংলাদেশের আমদানি নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার ফলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর সরবরাহ ব্যবস্থা সঠিক পথে না থাকায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গেছে। করোনা মহামারীর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযয়ী গত জুলাইয়ে এটি ছিল ৫.৪ শতাংশ। এর মূল কারণ হলো খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। এ ছাড়াও জ্বালানি, হাউজিং এবং বস্ত্র খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে সেখানকার মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। চিকিৎসা খাতেও করোনাকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের ব্যয় বেড়েছে। এসব কারণে দেশটিকে অর্থনীতিতে প্রচুর অর্থ জোগান দিতে হয়েছে। যেটি মুদ্রাস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করছে। এরূপ পরিস্থিতি একটি দেশের অর্থনীতির জন্য কোনভাবেই কল্যাণকর নয়। তবে এশিয়ার দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও পরিস্থিতি এখনও খুব বেশি খারাপ হয়নি। বাংলাদেশ এবং ভারতসহ কয়েকটি দেশে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। তবে ভারতের মূল্যস্ফীতিতে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি অনেক বেশি ভ‚মিকা রেখেছে। বর্তমানে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশে। এশিয়ার অন্য যেসব দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মিয়ানমার ইত্যাদি। বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হার উর্ধগতি, তবে শ্রমবাজারে কাজের অভাব এবং করোনার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলা করে অর্থনীতিকে সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে বাংলাদেশ ব্যাংককে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । এর কোন বিকল্প নেই। নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের জন্য এক সুখবর বয়ে আনবে। উল্লেখ্য, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে চারটি প্রধান ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে। এগুলো হলো-বৈশ্বিক খাতে প্রত্যাশার চেয়ে পুনরুদ্ধারের গতি কম, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির হার উর্ধগতি, শ্রমবাজারে কাজের অভাব এবং পণ্য পরিবহন ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ইত্যাদি। সম্প্রতি খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা বেড়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করছি। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতির দিক থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে পারে যাতে মূল্যস্ফীতির হার আর না বাড়ে । দরকার হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের নামকরা অর্থনীতিবিদদের নিয়ে একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করতে পারে। এই কমিটি সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করতে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবে। এতে করে সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফুটানো সম্ভব হতে পারে। কারণ জীবনযাত্রার ব্যয় এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষের স্বল্প আয়ে সংসার চালানো এখন বেশ কঠিন। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে মানুষের মধ্যে আস্থা সঞ্চার করা জরুরী। কর্মজীবী মানুষকে এ নিশ্চয়তা প্রদান করা উচিত যে, কোনভাইে তাদের আয় হ্রাস পাবে না। ফলে মানুষ খরচ করবে ও অর্থনীতিতে ভোগ বাড়বে। এতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম গতি আসবে, যা বর্তমান সময়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ব্যবসায়ীদের উৎপাদিত পণ্য বিপণনের সুযোগও নিশ্চিত করতে হবে এবং তাদের বিনিয়োগ থেকে মুনাফা আসার বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে তারা একটা ভরসা পায় যে তাদের ব্যবসা কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলবে। লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দি ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির কথা উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও করোনা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করছে। কারণ বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন ও ভারত থেকে। আশঙ্কার বিষয় হলো, এ দুই দেশেই মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। ভারতে গত তিন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬ শতাংশে উঠেছে। ভারত ও চীন থেকে পণ্য আমদানির ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ছে। করোনার কারণে গত ১ বছর ধরে ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত রয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর আয় হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে যাতে ব্যাংকিং সিস্টেমে ভারসাম্য অবস্থা বিরাজ করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন অফিস যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র কেনাকাটায় বহু আর্থিক অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। পাশাপাশি জালিয়াতি কার্যক্রম এবং প্রণোদনা প্যাকেজ সঠিকভাবে কার্যকর না করা ইত্যাদিও রয়েছে। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক করোনার জরুরী কেনাকাটা দ্রæত সম্পন্ন করতে লেনদেনগুলো নিবিড়ভাবে তদারকি করার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ এমনি মূল্যস্ফীতির চাপ, এর সঙ্গে যদি আর্থিক দুর্নীতি বৃদ্ধি পায় তাহলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা কঠিন ও চ্যালেঞ্জ হবে। সর্বোপরি অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে সম্ভাবনা কাজে লাগাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। নিতে হবে কার্যকরী পদক্ষেপ যাতে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে থাকে। লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
×