ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মজলুমের করুণ আত্মচিৎকার প্রতিধ্বনিত হত নীলকুঠিতে

প্রকাশিত: ১৮:৪৬, ২৪ অক্টোবর ২০২১

মজলুমের করুণ আত্মচিৎকার প্রতিধ্বনিত হত নীলকুঠিতে

সংবাদদাতা, নান্দাইল, ময়মনসিংহ ॥ ইংরেজ শাসকদের নীলচাষের ভয়াবহতার কথা প্রায় সবারই জানা। নীলচাষের জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশের মানুষের উপর নির্মম নির্যাতন চালাত। নীলচাষের তদারকি করতে তারা বিভিন্ন জায়গায় নীলকুঠি স্থাপন করেছিল। যা তাদের ক্যাশঘর হিসেবে ব্যবহৃত হত। আজ নীলকর নেই। জমিদার নেই। বেঁচে নেই তাদের হাতে নিপীড়িত জনতাও। কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলায় তাদের নিপীড়নঘরটি। সরজমিনে দেখা গেছে, দেওয়ানগঞ্জ-মধুপুর সড়কের বিরাশি নামক গ্রামে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের কূল ঘেঁষে দাড়িয়ে আছে পতিত এক কাচারি। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি ‘জাঙ্গালিয়া কালিবাড়ি’ নামে পরিচিত। ২২ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থের ও ৩০ ফুট উচ্চতার পাকা এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটির চারপাশ ঘিরে বিশাল এক বটগাছ বক্ষস্থলে ধারণ করে যুগ যুগ ধরে দাড়িয়ে আছে। ইতিহাসের ঘৃনার উপর জন্ম নেওয়া সেই বটবৃক্ষ ছায়া দিয়ে জুলুমের ইতিহাস কিছুটা হলেও মুছে দিতে চেষ্টা চালাচ্ছে। স্থানীয় বয়োবৃদ্ধরা জানায়, বাপ-দাদাদের কাছ থেকে জেনেছি বৃটিশ শাসিত কলিকাতার শাসকরা নদীপথে এসে এ গৃহে অবস্থান নিতেন। পরে স্থানীয় চাষীদের নীলচাষে বাধ্য করতেন। তাদের অত্যাচারের ভয়ে মানুষ নির্জীব পাথর হতো। নির্যাতনের কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো এ কাচারি। মজলুমের আত্মচিৎকারে রাতের নিবরতাকে ছেদ করতো। অনেক করুণীকে জমিদারদের মনোরঞ্জনের পর জীবন দিতে হত। জমিদারের পাইকপোয়াদারা পালতোলা নৌকায় এসে কৃষকের ফসল, খাজনা খেরাজ নিয়ে ফিরে যেত। পশুর মতো আচরণ করতো জনতার সাথে। খাজনা দিতেই অনেক সময় জমির সকল ফসল তুলে দিতে হতো কৃষককে। এত কিছুর পর সুদী মহাজনের অত্যাচারে ভিটেমাটি সব খোয়ায়ে আত্মহত্যার পথ বেচে নিত অনেক কৃষক। স্থাপনাটি বর্তমানে কালি মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে। নান্দাইল সহ আশপাশের পুজারিরা এখানে এসে পূজা দেয়। মন্দিরের বর্তমান পুরোহিত শ্রী স্বপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, ঠাকুরদার মুখে শুনেছি এই স্থাপনাতে অবস্থান করে ইংরেজরা নীল সংগ্রহ করত। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে হওয়ায় সহজেই ওরা বড় নৌকা করে কলকাতা থেকে এখানে যাতায়াত করত। নীল বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর ইংরেজরা এ স্থাপনাটি পরিত্যাগ করে চলে যায়। এরপর এর নিয়ন্ত্রণ চলে আসে জমিদারের হাতে। পরবর্তী সময়ে স্থাপনাসহ বিশাল এলাকার নিয়ন্ত্রণভার নেয় হোসেনপুর উপজেলার ‘গাঙ্গাটিয়া জমিদার পরিবার’। প্রায় দু’শ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে কালিপূজা হয়ে আসছে। বর্তমানে এটি দেবোত্তর সম্পত্তি। তারিক জামিল বলেন, আমরা তরুণ প্রজন্ম সেই কাচারির বুকে পা দিয়ে নির্যাতনের আহাজারি শুনতে পাই। ইজ্জত হারানো বোনের করুণ কান্না এখনো ভেসে আসে। একদিন সবকিছু হারিয়ে যাবে কিন্তু ইতিহাস হারাবে না। মুছবে না করুনতার সেই চিত্র। স্থানীয় যুবক রহিম উদ্দিন বলেন, প্রতিদিন দূরদুরান্ত থেকে স্থাপনাটি দেখতে লোকজন এখানে আসে। স্থাপনাটির সামনের অংশে রয়েছে একটি লোহার সিন্ধুকের ভগ্নাংশ। সিন্ধুকটি বর্তমানে বটগাছের ভেতর চলে গেছে। এ ঐতিহাসিক স্থাপনাটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে এটি পর্যটকদের দর্শনীয় স্থান হত। খারুয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল হাসনাত মিন্টু বলেন, দীর্ঘদিন থেকে জায়গাটি কালি মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নীলকুঠির স্থানটি ইতিহাসের একটি অংশ হয়ে আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। নীল বিদ্রোহের পর থেকে হোসেনপুরের গাঙ্গাটিয়া জমিদার বাড়ি এই মন্দির পরিচালনা করে থাকে।
×