ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সম্প্রতি সিনেমার সেটে ঘটে গেল বাস্তবে মর্মান্তিক এক মৃত্যু

প্রকাশিত: ১১:৫৯, ২৪ অক্টোবর ২০২১

সম্প্রতি সিনেমার সেটে ঘটে গেল বাস্তবে মর্মান্তিক এক মৃত্যু

অনলাইন ডেস্ক ॥ নিউ মেক্সিকোর ফিল্ম সেটে আমেরিকান অভিনেতা অ্যালেক বল্ডউইন প্রপ বন্দুক থেকে যে গুলি করেছেন তাতে নিহত হয়েছেন ছবির চিত্রগ্রাহক হ্যালিনা হাচিন্স এবং আহত হয়েছেন পরিচালক জোয়েল সুজা, এমনটাই জানিয়েছে পুলিশ । উনিশ শতকের ওয়েস্টার্ন ঘরানার ছায়াছবি 'রাস্ট' এর সেটে এই ঘটনা ঘটে। বুকে গুলি লাগে ৪২ বছর বয়সী মিস হাচিন্সের। গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছেন অভিনেতা মি. বল্ডউইন। একটি স্থানীয় পত্রিকায় সান্টা ফে কাউন্টির শেরিফের অফিসের বাইরে ৬৩ বছর বয়সী তারকাকে কাঁদতে দেখা গেছে। ছবির সহযোগী পরিচালক বলেছেন তিনি জানতেন না প্রপ বন্দুকে লাইভ গুলি ছিল। তিনি চেঁচিয়ে জানিয়েছিলেন ''বন্দুকটি নিষ্ক্রিয়''। তদন্ত প্রক্রিয়া চলছে এবং আমরা জানি না কীভাবে কী ঘটেছিল। অ্যালেক বল্ডউইনের একজন মুখপাত্র বলেছেন সিনেমার সেটে প্রপ বন্দুক দিয়ে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ার সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের ঘটনা বিরল এবং এই খবরে সিনেমা জগত স্তম্ভিত হয়ে গেছে। সিনেমার সেটে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের সময় কড়া মানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। তাহলে কী ঘটল, তা নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন। "আমি সম্প্রতি যে চলচ্চিত্র তৈরি করেছি, তাতে ব্যবহার করা এমনকি আমার প্লাস্টিকের বন্দুকও আমাকে প্রতিদিন দেখিয়ে সই করে সেটে নিয়ে যেতে হতো, বেরনর সময়ও আবার দেখিয়ে সই করতে হতো,'' বলেছেন অস্ট্রেলিয় অভিনেতা রিস মালডুন। "সে কারণেই এই ঘটনা কীভাবে ঘটল তা রীতিমত বিভ্রান্তিকর।" কিন্তু বিষয়টা অভাবনীয় মনে হলেও, প্রপ বন্দুক এবং ফাঁকা গুলি বিপজ্জনক হওয়ার কারণ আছে। কী সেই কারণ? আমরা এ বিষয়ে কতটা জানি? প্রপ বন্দুক কী? সিনেমায় গোলাগুলির দৃশ্য দেখানোর সময় ফাঁকা গুলি ব্যবহার করা হয়। দেখে সেটা সত্যিকার গুলি মনে হওয়ার কারণ হল যে ফাঁকা কার্তুজ বন্দুকে ভরা হয় সেটা আসলে কিছু পরিবর্তন ঘটানো সত্যিকার বুলেট। বন্দুকে যেটা ভরা হয় সেটাকে আমরা সাধারণত বলি "বুলেট"। কিন্তু সঠিকভাবে বর্ণনা করলে বন্দুকে যেটা ভরা হয় সেটা পুরো একটা কার্তুজ (কাট্রিজ)। ফাঁকা কার্তুজেও বিস্ফোরক ভরা থাকে, সব কিছুই তাতে থাকে আসল কার্তুজের মত- থাকে না শুধু বুলেটটা। প্রপ বন্দুক অনেক ধরনের হতে পারে। যেমন নিষ্ক্রিয় করা আসল আগ্নেয়াস্ত্র থেকে শুরু করে খেলনা বন্দুক বা ক্যাপ গান। এর অর্থ হল সিনেমায় আসল আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হতে পারে বা ফাঁকা গুলি ছোঁড়ার জন্য বদলে নেয়া আসল বন্দুকও ব্যবহার হতে পারে। এধরনের বন্দুক ছবিতে সত্যিকার গোলাগুলির আবহ তৈরি করে। প্রপ বন্দুক থেকে ফাঁকা গুলি ছুঁড়লে আপনি শুনবেন বন্দুকের গুলির জোর আওয়াজ, বন্দুকের নল থেকে বেরবে আগুনে ঝলকানি। বারুদে বিস্ফোরণ ঘটার কারণে বন্দুক চালানোর আসল সব দৃশ্যত ব্যঞ্জনাও পাওয়া যাবে পর্দায়। এ ধরনের ঘটনা কি আগে ঘটেছে? হ্যাঁ। মার্শাল আর্ট তারকা ব্রুস লি-র ছেলে ব্র্যান্ডন লির কথা আপনাদের মনে থাকতে পারে। ব্র্যান্ডন লি মারা যান মাত্র ২৮ বছর বয়সে ১৯৯৩ সালে, দ্য ক্রো ছবির শ্যুটিং চলার সময়। ওই শ্যুটিং-এ প্রপ বন্দুকে ভুল করে ডামি রাউন্ড গুলি ভরা ছিল যা তার দিকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়। ডামি রাউন্ড হল পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় গুলি। এতে কোন বিস্ফোরক ভরা থাকে না। ওই ছবিতে ডামি রাউন্ড ভরা বন্দুক ব্যবহার করা হয়, কারণ গুলি করার দৃশ্যের ক্লোজ আপ শটের জন্য ওই প্রপ বন্দুক ব্যবহার করা হয়েছিল। যখন সেখানে ফাঁকা কার্তুজ ভরা হয়, তখন ডামি গুলির অংশ বন্দুকে থেকে গিয়েছিল। ব্র্যান্ডন লি-কে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার পরও ক্যামেরা চলছিল। কিন্তু ওই দৃশ্যের ছবি নেয়া শেষ হওয়ার পরেও যখন দেখা গেল মি. লি. উঠছেন না, তখন সেটে যারা ছিলেন তারা প্রথম বুঝতে পারেন কিছু একটা অঘটন ঘটেছে। আরও একটি ঘটনা ঘটে ১৯৮৪ সালে। আমেরিকান অভিনেতা জন-এরিক হেক্সাম একটি টিভি অনুষ্ঠানের সেটে ফিল্ম শ্যুটিংয়ে দেরি হওয়ার ঘটনা নিয়ে হতাশ হয়ে ঠাট্টা মস্করা শুরু করেন। এ সময় ঠাট্টা করেই তিনি একটি রিভলবারে ফাঁকা কার্তুজ ভরেন, গুলির চেম্বারটা ঘুরিয়ে নেন এবং নিজের মাথায় বন্দুক তাক করে বন্দুক চালান। মি. লি. মারা গিয়েছিলেন বুলেট লেগে। মি. হেক্সামের মৃত্যু বুলেটের আঘাত থেকে হয়নি। কিন্তু বারুদের বিস্ফোরণ এতটা শক্তিশালী ছিল যে তার মাথার খুলি ফেটে যায়। তিনি পরে হাসপাতালে মারা যান। তাহলে ফাঁকা কার্তুজ আর প্রপ বন্দুক নিরাপদে ব্যবহারের উপায় কী? মি. হেক্সামের মৃত্যুর ঘটনা বলে দেয় ফাঁকা কার্তুজ থেকেও জীবনের ঝুঁকি আছে। কার্তুজের মাথায় বুলেট না থাকলেও কার্তুজের ভেতরটা যে পরিমাণ বারুদে ঠাসা থাকে, তার শক্তি কিন্তু কম নয়। এই ঝুঁকি আরও বাড়ে আর একটি কারণে। কোন কোন সিনেমা সেটে গুলির দৃশ্য আরও চমকপ্রদ, আরও ভয়ঙ্কর করে তোলার জন্য কার্তুজে বাড়তি বারুদ পাউডার ভরে দেয়া হয়। ফলে এসব ক্ষেত্রে বিস্ফোরণের তীব্রতা বাড়ার একটা ঝুঁকি থাকে। ফিল্ম সেটে প্রপ বন্দুক ব্যবহারের ব্যাপারে সচরাচর খুবই কড়াকড়ি নিয়ম থাকে। বিশেষজ্ঞরা এসব সিনেমা সেটের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে থাকেন এবং এগুলো ব্যবহারের বিষয়ে তারাই পরামর্শদাতা। "প্রতিটি সেটে সুনির্দিষ্ট কিছু নিরাপত্তা পদক্ষেপের নিয়ম থাকে," বলছেন মাইক ট্রিস্টানো। তিনি চলচ্চিত্র সেটের একজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ, যিনি অতীতে অ্যালেক বল্ডউইনের সাথে কাজ করেছেন। "সেটে যে কোন বন্দুক, এমনকি সেটা নিষ্ক্রিয় বন্দুক হলেও আপনার কখনই সেটা কোন মানুষকে তাক করে চালানোর কথা নয়। কাজেই আমি একেবারেই বুঝতেই পারছি না কীভাবে এমন ঘটনা ঘটতে পারল এবং এই গুলি এত মারাত্মক ক্ষতি করল কীভাবে।" চলচ্চিত্রে এধরনের বন্দুক থেকে গুলি করার দৃশ্যের ছবি সাধারণত যেভাবে তোলা হয় সেটা হল অভিনেতা ক্যামেরাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়বেন। ফিউরি অ্যান্ড দ্য ইমিটেশন গেম-এর মত ছবিতে কাজ করেছেন স্টিভেন হল- তিনি বলছেন সেটাও কিন্তু করা হয় সবরকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা মেনে। "বন্দুকের গুলি যে পথে যাচ্ছে, আপনি যদি সেখানে থাকেন... নিয়ম হল আপনাকে তখন মুখোশ পরতে হবে, আপনার চোখে গগলস পরা থাকতে হবে এবং আপনাকে থাকতে হবে পার্সপেক্সের তৈরি স্ক্রিনের পেছনে। এছাড়াও নিশ্চিত করতে হবে যে, ক্যামেরার ধারেপাশে যেন খুবই কম লোক থাকে," তিনি বলেন। "এবারের ঘটনায় আমি যেটা বুঝতে পারছি না, সেটা হল একই গুলিতে দুই ব্যক্তি কীভাবে আহত হলেন, যাদের একজন দুঃখজনকভাবে মারা গেলেন।" রাস্ট নামে এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে অন্য যারা কাজ করছেন তারা প্রশ্ন তুলেছেন বর্তমান যুগে যখন খুবই কম খরচে বন্দুক চালানোর এফেক্ট কম্পিউটারেই সৃষ্টি করা যায়, তখন ফাঁকা কার্তুজ ভরে এই এফেক্ট কেন তৈরি করা হচ্ছে? "ফিল্ম সেটে এখন আর ফাঁকা কার্তুজ ভরা বা অন্য ধরনের বন্দুক ব্যবহার করার কোন যৌক্তিকতাই নেই। এগুলো পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে দেয়া উচিত," টুইট করেছেন ক্রেগ যোবেল যিনি একজন সুপরিচিত অভিনেতা ও পরিচালক। "প্রপ বন্দুক- বন্দুকই," টুইটারে মন্তব্য করেছেন টিভি লেখক ডেভিড স্ল্যাক। "ফাঁকা কার্তুজেও আসল বারুদ ভরা থাকে। তা মানুষকে আহত করতে পারে, মানুষ মারাও যেতে পারে- এবং সেটা ঘটেওছে। আপনি যদি এমন কোন ফিল্ম সেটে কাজ করেন, যেখানে যথাযথ সতর্কতা বা নিরাপদ ব্যবস্থা না মেনে প্রপ বন্দুক ব্যবহার করা হয়, সেখান থেকে পালাবেন। "কোন সিনেমার দৃশ্য বা শো মানুষের জীবনের ঝুঁকির চেয়ে বড় নয়," মন্তব্য করেছেন ডেভিড স্ল্যাক। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×