ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডেমু এখন গলার কাঁটা, ৬৫৪ কোটি টাকাই পানিতে

প্রকাশিত: ২২:০৩, ২৪ অক্টোবর ২০২১

ডেমু এখন গলার কাঁটা, ৬৫৪ কোটি টাকাই পানিতে

আজাদ সুলায়মান ॥ স্বল্প দূরত্বের যোগাযোগের জন্য রেল যাত্রীদের চাহিদার বিপরীতে কেনা হয়েছিল ডেমু ট্রেন। নতুন নতুন বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই ডেমু ট্রেন এখন রেলের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৩ সালে ২০ সেট ডেমু (ডিজেল ইলেক্ট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) ট্রেন কেনা হলেও এখন অচল ১৭টি। বাকি ৩টি খুঁড়িয়ে চলছে। অথচ ৬৫৪ কোটি টাকায় এই ট্রেনগুলো কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ বছর সচল থাকার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল। চীন থেকে কেনা এসব ট্রেন খুব শীঘ্রই সচল করারও কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছেনা। খোদ রেলের নীতি নির্ধারকরাই এখন মন্তব্য করছেন- এ ৬৫৪ কোটি টাকাই জলে গেল। অথচ এই পরিমাণ টাকা দিয়ে সাধারণ ট্রেনের ১২০টি এসি বগি কেনা যেত। প্রতিটি এসি বগি থেকে বছরে গড়ে আড়াই কোটি টাকা আয় হয়। মূলত সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া আর বাস্তবতার চিত্র উপলব্দি না করেই নেয়া হয়েছিল এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এসব বিষয়ে রেলের কেউ মুখ খুলতেও আগ্রহী নন। তবে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চীনের তৈরি ডেমু ট্রেন কেনার প্রকল্প সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। নীতিগত কিছু ভুলের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি কমলাপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ডেমুগুলো পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রতিটি বগিতে রয়েছে দৈন্যদশার চিত্র। কমলাপুর রেল স্টেশন সংলগ্ন ডেমু ট্রেনের ওয়ার্কশপ। ওয়ার্কশপের ভেতর এবং বাইরে বিকল হয়ে পড়ে আছে ১০টি ডেমু ট্রেন। এসব ট্রেনের অধিকাংশের দরজা-জানালা ভাঙ্গা। আসনের ওপর কয়েক স্তর ধুলাবালির আবরণ পড়েছে। কয়েকটি ট্রেনে লতাপাতা গজিয়েছে। অযতেœ পড়ে থাকা ডেমুগুলো মেরামত করারও নেই কোন উদ্যোগ। আবার ট্রেনের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ ফ্যান নষ্ট। এছাড়া জানালাগুলো খুবই ছোট। বাইরে থেকে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস ট্রেনে ঢোকে না। ফলে প্রায়ই গরমে অনেক যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েন। রেল সূত্র জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকায় এসব ট্রেন সচলও করতে পারছে না রেলওয়ে। এমনকি যে তিন সেট ডেমু সচল আছে- সেগুলোতেও যান্ত্রিক ত্রুটি রয়েছে। এসব ট্রেন প্রায়ই বিকল হয়ে যায়। অন্য ট্রেন দিয়ে টেনে ওয়ার্কশপে নিতে হয়। ফলে এসব ট্রেনে চলাচলকারী যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মাঝপথেই বিকল হয়ে পড়ায় যাত্রীদের ডেমু থেকে নেমে যেতে হয়। এ বিষয়ে সুমন নামের এক যাত্রী বলেন, চীন থেকে আনায় কোন দোষের বিষয় নয়। কথা হচ্ছে, ডেমু ট্রেন যাত্রীদের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়নি। অথচ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ শহরে সার্কুলার ট্রেন হিসেবে ডেমু যাত্রীদের চাহিদা পূরণ করতে পারতো। সেটা হয়নি। উল্টো এখন রেলের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে এগুলো। এ বিষয়ে রেলের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, কোন ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই বাছাই না করেই কেনা হয়েছিল এগুলো। চীনের পরিস্থিতি আর ঢাকার পরিস্থিতি যে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী সেটাও আমলে নেয়া হয়নি। তাই ডেমুগুলো দেশে আনার পর চোখে পড়ে স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনের সিঁড়ি আড়াই ফুট উঁচু। এতে নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের ওঠানামায় সমস্যা হয়। ট্রেনের ভেতরের কাঠামোও যাত্রীবান্ধব নয়। এ ধরনের জটিলতার দরুন ডেমু জনপ্রিয়তার পরিবর্তে উল্টো দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ চীন থেকে কেনা এসব ডেমু ট্রেন সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তির। প্রতিটি ট্রেনের মেয়াদকাল ছিল ৩০ বছর। কিন্তু উদ্বোধনের কিছুদিন পর এক এক করে ট্রেনগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন দেশে এই ধরনের ট্রেন সচলে ওয়ার্কশপ ও যন্ত্রপাতি নেই। ফলে ট্রেন নষ্ট হলে সারানোর ব্যবস্থাও নেই। এখন এই ডেমু ট্রেনগুলো রেলওয়ের গলার কাঁটা। রেলের মতে, ডেমু কেনা হয়েছিল মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জের স্বল্প দূরত্বে অর্থাৎ ২০ কিলোমিটার যাতায়াতের জন্য। অথচ অন্য প্রতিটি রুট গড়ে ৯০ কিলোমিটারের বেশি ছিল। ফলে উদ্বোধনের কিছুদিনের মধ্যেই একের পর এক ট্রেন বিকল হতে শুরু করে। ডেমুর দুই দিক দিয়ে দুটি ইঞ্জিন থাকে। মাঝখানে একটি বগি। বগির পাশাপাশি ইঞ্জিন অংশেও যাত্রী বহন করা যায়। প্রতিটি ডেমুতে ১৪৯ জন বসে এবং ১৫১ জন দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে পারেন। কিন্তু এগুলো যখন উদ্বোধন করা হয়, তখন প্রতিটি ডেমুতে ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী যাতায়াত শুরু করেন। এতেই দ্রুত সর্বনাশ ঘটতে থাকে। সঠিক সময়ে রক্ষণাবেক্ষণ না করে অযতœ অবহেলায় এগুলোকে অচল করা হয়েছে। রেল সূত্রমতে- স্বল্প দূরত্বের এসব ট্রেন এক থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে যাত্রী বহন করতে থাকে। মূলত এ কারণেই ট্রেনগুলো অল্পদিনে বিকল হয়ে পড়ে। অন্যথায় এ ধরনের ট্রেনের ইঞ্জিনে পাঁচ বছরের আগে হাত দেয়া লাগে না। মেরামত করে ২০ থেকে ২৫ বছর চালানো যায়। এমন চিন্তা থেকেই ২০১১ সালে ৪২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ সেট ডেমু ট্রেন কিনতে চীনের একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এর সঙ্গে শুল্ককর এবং ৩০ জন কর্মকর্তার বিদেশে ভ্রমণ-ভাতার খরচ যোগ হয়। এতে এই খরচ গিয়ে দাঁড়ায় ৬৫৪ কোটি টাকায়। পরে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুই সেট ট্রেন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই ঢাকা-টঙ্গী, ঢাকা-জয়দেবপুর, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, সিলেট-আখাউড়া, কমলাপুর-আখাউড়া, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা, নোয়াখালী-লাকসাম, লাকসাম-চাঁদপুর, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট, পার্বতীপুর-পঞ্চগড় রুটে বাকি ট্রেনগুলো চালু হয়। এগুলো চালু হওয়ার পর বেশ বড় গলায় রেল দাবি করে ২০১৩ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত ডেমু দিয়ে যাত্রী পরিবহন করে প্রায় ৩০ কোটি টাকা আয় করেছে রেলওয়ে। কিন্তু ডেমু ট্রেন পরিচালনায় প্রায় সম পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে। অর্থাৎ ডেমুর আয়-ব্যয় সমান। কিন্তু যে ৬৫৪ কোটি টাকা খরচ করে এই ট্রেন কেনা হয়েছে, সেই টাকা পুরোটাই জলে গেছে। এসব ডেমুতে নিত্য যাতায়াত করেন এমন একজন যাত্রী ফজলু মিয়া বলেন, শুরুতে বেশ আগ্রহ নিয়ে অনেকেই চড়তো। কারণ এগুলোতে যাতায়াতে সময় এবং ভাড়া কম লাগে। তাই নারায়ণগঞ্জ থেকে কমলাপুর আসা-যাওয়ায় ট্রেনেই যাতায়াত করি। কিন্তু যেদিন ডেমু ট্রেনে উঠি, সেদিন গরমে হাঁসফাঁস লাগে। আসন খালি থাকলেও ভেতরে বসি না। আলো-বাতাসের জন্য দরজার পাশে দাঁড়িয়ে যাতায়াত করি। আমার মতো সব যাত্রীরই একই অভিজ্ঞতা রয়েছে। আসলে গরমে কষ্ট হলেও ট্রেনে যাতায়াত করি। তবে যাত্রীসেবার নামে রেলওয়ের এই তামাশা বন্ধ করা উচিত। রেলের হিসাবমতে- দুপুরে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ডেমুতে গড়ে ৩শ’ করে যাত্রী পরিবহন করা হয়। ভোরে যাত্রীর চাপ কিছুটা কম থাকে। এছাড়া ডেমুতে ত্রুটি বা মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। তখন ট্রেনের টিকেট ফেরত নেয়া হয়। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর রুটে যে দুটি ট্রেন চলাচল করে সেগুলো ভোর সাড়ে ৫টা ও দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে কমলাপুর ছেড়ে যায়। এসময় ডেমুতে যাত্রী সংখ্যা কম থাকে। ফলে চলাচলে তেমন সমস্যা হয় না।
×