ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কুমিল্লাকান্ডে ইকবালসহ চারজন ৭ দিনের রিমান্ডে

পীরগঞ্জের ঘটনার হোতাসহ দুজন গ্রেফতার

প্রকাশিত: ২২:০১, ২৪ অক্টোবর ২০২১

পীরগঞ্জের ঘটনার হোতাসহ দুজন গ্রেফতার

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ কুমিল্লা নগরীর নানুয়ার দীঘির উত্তরপাড়ে অস্থায়ী পূজামন্ডপে পবিত্র কোরান রাখার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল হোসেনসহ চার জনের সাতদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। শনিবার দুপুরে পুলিশ কড়া প্রহরায় তাদের কুমিল্লার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম মিথিলা জাহান উর্মির আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত প্রত্যেকের সাতদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিকে রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার অন্যতম হোতা সৈকত মন্ডল ও সহযোগী রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। শুক্রবার রাতে গাজীপুরের টঙ্গী থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। ফেসবুকে ফলোয়ার বাড়াতেই মূলত উস্কানিমূলক পোস্ট দেয় মন্ডল। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতার। কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম তানভীর আহমেদ আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাথমিকভাবে ইকবাল হোসেন মন্ডপে পবিত্র কোরান শরিফ রাখা এবং হনুমানের গদাটি পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়ার কথা স্বীকার করেছে। সে ঘটনার বিষয়ে পুলিশকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হবে। তাই বিস্তারিত জানতে এবং অধিকতর তদন্তের স্বার্থে ইকবালসহ চারজনকে পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। ইকবাল ছাড়া অপর তিনজন হলো ঘটনার দিন ৯৯৯-এ ফোন করা বজ্রপুর এলাকার বিল্লাল হোসেনের ছেলে রেজাউল ইসলাম ইকরাম, মাজারের সহকারী খাদেম দারোগাবাড়ি এলাকার একেএম মোস্তাফিজুর রহমানের ছেলে মোঃ ফয়সাল, বরুড়ার মোহাম্মদপুর গ্রামের সানাহউল্লার ছেলে হুমায়ুন কবির সানাউল্লাহ। তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজন হলে রিমান্ডে তাদের মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পুলিশের একটি সূত্র জানায়, শুক্রবার দুপুরে ইকবালকে কক্সবাজার থেকে কুমিল্লায় আনার পর ঢাকা থেকে আসা উচ্চ পর্যায়ের যৌথ তদন্ত টিম তাকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ সময় সে দারোগা বাড়ি মসজিদ থেকে পবিত্র কোরান শরিফ নিয়ে পাশের মন্ডপে রেখেছিল বলে স্বীকার করে এবং মন্ডপ থেকে হনুমানের মূর্তির গদা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরার পর গদাটি পুকুরে ফেলে দেয় বলে স্বীকার করলেও নেপথ্যের ইন্ধনদাতাদের বিষয়ে একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছে। ঘটনার দিন কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই হারুন অর রশীদ বাদী হয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা ও অবমাননার অপরাধে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে থানায় যে মামলাটি দায়ের করেন ইকবালকে ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। এছাড়াও পুলিশকে ৯৯৯ এ ফোন করা ইকরাম, দারোগাবাড়ি মাজার মসজিদের সহকারী খাদেম ফয়সাল ও হুমায়ুনকেও একই মামলায় আসামি হিসেবে গ্রেফতার দেখানো হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই মফিজুল ইসলাম খান জানান, ইকবালসহ চার আসামিকে এ মামলায় অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডে আবেদন জানিয়ে শনিবার কুমিল্লার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম মিথিলা জাহান উর্মির আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাদের প্রত্যেকের সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে ৯৯৯-এ কল দেয়া ইকরামের সঙ্গে ঘটনার আগে-পরে ইকবালের কি কথা হয়েছিল তা জানতে চাওয়া হবে। সিসিটিভি ফুটেজে দারোগা বাড়ি মাজার মসজিদ থেকে কোরান শরিফ নেয়ার বিষয়ে মসজিদের সহকারী খাদেমদ্বয়ের কোন যোগসূত্র ছিল কিনা তাও রিমান্ডে তথ্য বের হয়ে আসতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। জেলা পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, ইকবাল ঘটনার দিন সকালেও মন্ডপে হামলার সময় ঘটনাস্থলে ছিল, কিন্তু পরে সে ট্রেনে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম ও পরে বাসে কক্সবাজার চলে যায়। তাই কুমিল্লা থেকে কক্সবাজার যাওয়া, হোটেলে অবস্থান ও খাওয়ার অর্থ ও পরামর্শ তাকে কে দিয়েছে তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কেউ অর্থ সরবরাহ করে থাকলে তাকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এছাড়াও তার এ অপরাধ সংগঠনের মোটিভ কি ছিল এবং এর সঙ্গে কোন ব্যক্তি, সংগঠন কিংবা গোষ্ঠী জড়িত কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকত থেকে নোয়াখালীর তিন ছাত্রলীগ কর্মীর সহায়তায় পুলিশ ইকবালকে আটক করে। গত ১৩ অক্টোবর নগরীর নানুয়া দীঘির পাড়ের পূজামন্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় কোতোয়ালি মডেল থানায় পাঁচটি, সদর দক্ষিণ মডেল থানায় দুটি এবং দাউদকান্দি ও দেবিদ্বার থানায় একটি করে মোট নয়টি মামলা হয়। এসব মামলায় শনিবার পর্যন্ত ৫২ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পীরগঞ্জের ঘটনার হোতা সৈকতসহ গ্রেফতার দুই ॥ রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার অন্যতম হোতা সৈকত মন্ডল ও সহযোগী রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। শুক্রবার রাতে গাজীপুরের টঙ্গী থেকে তাদের গ্রেফতার করে র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখার একটি দল। মূলত ফেসবুকে ফলোয়ার বাড়াতে এবং ব্যক্তিগত ইমেজ প্রচার করতেই ‘এই মুহূর্তে গ্রামপুলিশের কাছ থেকে পাওয়া সংবাদ, হিন্দুদের আক্রমণে এক মুসলিমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে’ এমন উস্কানিমূলক পোস্ট দেয় সৈকত মন্ডল। সেই পোস্টের সূত্র ধরে হামলার ঠিক কাছাকাছি একটি মসজিদ থেকে মাইকিং করেন রবিউল ইসলাম। মাইকিংয়ে তিনি তৌহিদী জনতাসহ ধর্মপ্রাণ মানুষকে প্রতিরোধের ডাক দেন। এরপর সৈকত নিজে একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়ে হামলায় অংশ নেন। শনিবার কাওরানবাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, গত ১৭ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্টকে কেন্দ্র করে রংপুরের পীরগঞ্জের বড় করিমপুর গ্রামে দুর্বৃত্তরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশে বেশ কয়েকটি বাড়িঘর, দোকানপাট ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। ওই ঘটনায় পীরগঞ্জ থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়। এ বিষয়ে আল মঈন বলেন, মামলার প্রেক্ষিতে র‌্যাব-১৩ বেশ কজনকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসে। ওই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারে র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েদা শাখা ও র‌্যাব-১৩ এর একটি আভিযানিক দল শুক্রবার রাতে টঙ্গী এলাকা হতে পীরগঞ্জে হামলা ও অগ্নিসংযোগের অন্যতম হোতা সৈকত ম-ল ও রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ওই ঘটনায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে তথ্যপ্রদান করেছেন। তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অরাজকতা তৈরি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের লক্ষ্যে হামলা-অগ্নিসংযোগ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার এবং মাইকিং করে হামলাকারীদের জড়ো করেন। তিনি বলেন, গ্রেফতার সৈকত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উস্কানিমূলক, বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যাচারের মাধ্যমে জনসাধারণকে উত্তেজিত করে তোলে। সে হামলা ও অগ্নিসংযোগে অংশগ্রহণে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে। তার নেতৃত্বে বেশ কজন হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণ করে বাড়িঘর, দোকানপাট ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। সে গ্রেফতার রবিউলকে মাইকিং করে লোকজন জড়ো করতে নির্দেশনা দেয়। ঘটনার পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। র‌্যাব কমর্কর্তা বলেন, গ্রেফতার সৈকত মন্ডল রংপুরের একটি কলেজের স্নাতকে অধ্যয়নরত। তিনি বিভিন্ন সময়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন উস্কানিমূলক ও বিভ্রান্তিকর পোস্ট দিতেন ও শেয়ার করতেন। ঠিক কী উদ্দেশে উস্কানিমূলক পোস্ট দিয়েছিলেন সৈকত- জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, তার ফেসবুক পেজে ২৭০০-২৮০০ ফলোয়ার রয়েছে। সেটিকে কাজে লাগিয়েছেন ফলোয়ার বাড়ানোর জন্য। পাশাপাশি তার ব্যক্তিগত ইমেজ বাড়বে বলেও মনে করে সে। সৈকত মন্ডল ছাত্রলীগের কোন পদে ছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সৈকত রংপুরের একটি ডিগ্রী কলেজের শিক্ষার্থী। সে নিজেকে রংপুরে ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে নিজে প্রচার করতে পারে কিন্তু তার কোন রাজনৈতিক পদ-পদবি ছিল না। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তার কোন সম্পৃক্ততাও আমরা পাইনি। সৈকত ফেসবুকে কী ধরনের পোস্ট করত- এমন প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সৈকত তার ফেসবুকে পেজে বিভিন্ন ছোট-বড় ইস্যুতে উস্কানিমূলক পোস্ট দিত। মূলত কুমিল্লার ইস্যুর পর থেকেই সে ফেসবুকে উস্কানিমূলক পোস্ট দিয়ে আসছিল। এরপর রংপুরের পীরগঞ্জে যখন একটি ঘটনা ঘটে, তখন থেকে সৈকত একের পর এক উস্কানিমূলক পোস্ট দিতে থাকে। মূলত তার এসব পোস্ট দেখেই পীরগঞ্জে শত শত লোক জড়ো হয়েছিলেন। সৈকত প্রথমে পাশের মসজিদ থেকে মাইকিং করা শুরু করে। এরপর সে মাইকিংয়ের দায়িত্ব তার কাজিনকে দেয়। সৈকতকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার ॥ পীরগঞ্জের মাঝিপাড়ার হিন্দুপল্লীতে হামলার মূল উস্কানিদাতা হিসেবে যাকে র‌্যাব চিহ্নিত করেছে, সেই সৈকত মণ্ডলকে সংগঠন থেকে ‘বহিষ্কারের’ কথা জানিয়েছে রংপুর ছাত্রলীগ। শনিবার রংপুর কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সৈকতসহ দুজনকে সাংগঠনিক পদ থেকে ‘অব্যাহতি’ দিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আসে সাংবাদিকদের কাছে। আর মহানগর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন বহিষ্কারের কথা। তবে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সৈকতকে ১৮ অক্টোবরই কারমাইকেল কলেজ শাখা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। মাঝিপাড়ায় হামলাটি হয়েছিল ১৭ অক্টোবর রাতে, আর র‌্যাব শুক্রবারই সৈকতকে গ্রেফতারের কথা জানায়। রংপুর মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আসিফ হোসেন বলেন, গত ১৮ অক্টোবর মাঝিপাড়ায় ঘটনায় সরাসরি অংশ নেয়ার প্রমাণ পাওয়ায় দর্শন বিভাগ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে সৈকতকে। একই ঘটনায় কারমাইকেল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি তানজিরুল ইসলামকেও বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ। বিজ্ঞপ্তিতে সৈকত ও তানজিরকে অব্যাহতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে, যা এসেছে কারমাইকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুজ্জামান সিজার ও সাধারণ সম্পাদক জাবেদ আহমেদের নামে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকায় সৈকত ও তানজিরকে কলেজ শাখা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ছাত্রলীগ রংপুর মহানগর শাখারই অধীনে কলেজ শাখা; আর কাউকে বহিষ্কারের এখতিয়ার কলেজ শাখায় না থাকলেও জেলা বা মহানগর শাখার রয়েছে।
×