ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহবাগে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের গণঅনশন

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই

প্রকাশিত: ২১:৫৯, ২৪ অক্টোবর ২০২১

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, এলাকার জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগ থাকার পরও শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটেছে। চিহ্নিত কিছু উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সুকৌশলে ধর্মকে পুঁজি করে এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব ধর্মান্ধ, ধর্ম ব্যবসায়ী, উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়নি বলেই আজ রামু-নাসিরনগর থেকে কুমিল্লা কিংবা রংপুরের ঘটনা ঘটছে।’ শনিবার রাজধানীর শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের গণ-অনশন, গণ-অবস্থান ও বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন। সম্প্রতি শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘিরে হামলা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সারাদেশের মতো শাহবাগেও সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ হিন্দু- বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নিন্দ চন্দ্র ভৌমিক, মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির, বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জী, সহ-সভাপতি মিলন কান্তি দত্ত, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিন্দ্র কুমার নাথ প্রমুখ। একই সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি সংগঠন শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিলে প্রায় দুই ঘণ্টা এলাকাটিতে যান চলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় বক্তারা বলেন, দেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। সবাই মিলেমিশে যখন বসবাস করছে, ঠিক সেই সময়ে সাম্প্রদায়িক হামলা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক এ রাষ্ট্রকে জঙ্গী বানানোর চেষ্টা চলছে। দেশের অগ্রযাত্রাকে থামানোর চেষ্টা হচ্ছে। সমাবেশে মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপতৎপরতার অংশ হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘর-বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। সম্প্রীতি বিনষ্টে সহিংসতার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে যা অত্যন্ত ঘৃণ্য অপরাধ। এসব হামলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার ওপর আঘাত করা হচ্ছে। এ ধরনের অশুভ তৎপরতা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলে দমন করতে হবে। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক হামলা এখনও ঘটে যাচ্ছে, এটা বন্ধ হয়নি। অথচ আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। যে দেশ হবে সবার, যেখানে সবার অধিকার থাকবে। যুদ্ধ করেছি অসাম্প্রদায়িক বাংলার জন্য, ধর্মান্ধদের আধিপত্য করতে দেব না। আমি মানুষ, কাউকে আক্রান্ত হতে দেখলে এগিয়ে যাব। সবাই আক্রান্তদের পাশে এগিয়ে আসুন। নিন্দ চন্দ্র ভৌমিক বলেন, শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘিরে কুমিল্লা, রংপুর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর আগেও বিগত দিনে এমন হামলা হয়েছে। রামু থেকে নাসিরনগরের ঘটনা আমরা ভুলে যাইনি। এসব ঘটনা সাজানো, পরিকল্পিত। আগে দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। অতীতের ঘটনায় সরকার কিছু ব্যবস্থা নিলেও দিষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। অথচ সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে সংখ্যালঘু কমিশনের কথা বলেছিল, যার বাস্তবায়ন আজও হয়নি। বঙ্গবন্ধুর সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছে, যার কারণে হামলা-মামলা বাড়ছে। তিনি বলেন, আমরা সাম্য, মানবিক, ন্যায়বিচার চাই। ’৭২’র সংবিধান চাই, অর্পিত সম্পত্তির অধিকার চাই। আমাদের সংবিধানের চার মূলনীতিতে বিশ্বাসী হতে হবে। এই চার মূলনীতির বাইরে যারা তাদের রাজনীতির অধিকার নেই। যারা বিশ্বাস করে না, তাদের সঙ্গে পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। সমাবেশ শেষে পানি খাইয়ে অনশনরতদের অনশন ভাঙ্গান অতিথিরা। পরে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি শাহবাগ মোড় হয়ে রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে গিয়ে শেষ হয়। গণঅনশন ও গণঅবস্থান কর্মসূচী শেষ করার আগে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ সংগঠনের পক্ষে আট দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবিতে বলা হয়, শারদীয় দুর্গোৎসব চলাকালে ও এর পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার তদন্তে সুপ্রীমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সব মন্দির, বাড়িঘর পুনর্র্নিমাণ, গৃহহীনদের পুনর্বাসন, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান ছাড়াও আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ও নিহতদের প্রতিটি পরিবারকে ন্যূনতম ২০ লাখ টাকা প্রদান অথবা প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের একজনকে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিতে হবে। ঘটে যাওয়া এসব সাম্প্রদায়িক ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে হামলাকারী ও তাদের পেছনে থাকা চক্রান্তকারীদের অনতিবিলম্বে গ্রেফতার করার দাবি জানানো হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে। বলা হয়, বিশেষ ক্ষমতা আইন, সন্ত্রাস দমন আইনের আওতায় এনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুততম সময়ে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। হামলাকারীদের রোধেও প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে যারা দায়িত্ব পালনে গাফিলতি ও অবহেলা করেছেন তাদের চিহ্নিত করে অনতিবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধেও দ্রুত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। দাবি করা হয়, বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যম ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছাড়াও সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছে যারা তাদের চিহ্নিত করে বিশেষ ক্ষমতা আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আর প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশনা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের মোকাবেলায় যেসব জনপ্রতিনিধি এগিয়ে আসেননি তাদেরও চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত সংগঠিত সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলী তদন্তে সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনায় গঠিত সাহাবুদ্দিন কমিশনের সুপারিশ সংবলিত রিপোর্ট অনতিবিলম্বে জনসমক্ষে প্রকাশ ও এর সুপারিশ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করারও দাবি তুলেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ। এছাড়াও ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকারী দলের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুত সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের দ্রুত বাস্তবায়নসহ ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে প্রদত্ত অঙ্গীকার দ্রুত বাস্তবায়ন করার দাবি জানানো হয়েছে। মনীন্দ্র কুমার নাথ এসব দাবি পেশ করে তিন দফা কর্মসূচীর ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আমাদের দাবিসমূহের অগ্রগতি পর্যালোচনায় রেখে প্রয়োজনে পরবর্তীতে এসব দাবি সমর্থনে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে- ‘চল চল ঢাকায় চল’ স্লোগানে ঢাকায় সমবেত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রার কর্মসূচী ঘোষণা করছি। আমাদের দাবি বাস্তবায়নের লক্ষে ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিটি সংগঠন পৃথক পৃথকভাবে ও যৌথভাবে জনসংযোগ ও প্রতিবাদী কর্মসূচী এগিয়ে নেবে। আগামী ৪ নবেম্বর, ২০২১-এ অনুষ্ঠিতব্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শ্যামাপূজায় দীপাবলী উৎসব বর্জন, সন্ধ্যা ৬টা থেকে ১৫ মিনিট পর্যন্ত কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে স্ব স্ব মন্দিরে নীরবতা পালন এবং মন্দির বা ম-প ফটকে কালো কাপড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বিরোধী সেøাগান সংবলিত ব্যানার টাঙ্গানোর বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদের প্রতিবাদী কর্মসূচীর সঙ্গে সুগভীর সংহতি জ্ঞাপন করছি এবং এই কর্মসূচীর সফল বাস্তবায়নে সর্বস্তরের পূজার্থীদের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। কর্মসূচীতে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন), বাংলাদেশ পূজা উদ্পরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাসংঘ, বাংলাদেশ সনাতন কল্যাণ জোট, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট ফেডারেশন, এ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজসংস্কার সমিতি, জন্মাষ্টমী উদ্যাপন পরিষদ, বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি, বাংলাদেশ মাইনরিটি সংগ্রাম পরিষদ, বাংলাদেশ হিন্দু লীগ, মাইনরিটি রাইটস ফোরামের বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু ফোরাম ও হিন্দু ছাত্র ফোরাম, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজ সংরক্ষণ সমিতি, ইন্টারন্যাশনাল শ্রী শ্রী হরি গুরুচাঁদ মতুয়া মিশন, বাংলাদেশ হরিজন ঐক্য পরিষদ, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ সংহতি জানিয়ে অংশ নেয়। ঢাকার স্বামীবাগ ইসকন মন্দিরের পুরোহিত মহামন্ত্র কিপ্তন দাশ বলেন, ‘আমরা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, নির্যাতনে জড়িতদের বিচার দাবি করছি। সারাদেশে আজ গণঅনশন ও বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচী চলছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচী চালিয়ে যাব।’ শনিবার সকাল ৬টা থেকে শাহবাগে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের গণঅনশন কর্মসূচী শুরু হয়। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তারা শাহবাগ মোড়ের সড়কে অবস্থান নেন। এসময় আশপাশের বিভিন্ন সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
×