ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতা গান চলচ্চিত্র গ্রাফিতি- সবই আজ প্রতিবাদের ভাষা

প্রকাশিত: ২১:৩৯, ২৪ অক্টোবর ২০২১

কবিতা গান চলচ্চিত্র গ্রাফিতি- সবই আজ প্রতিবাদের ভাষা

মোরসালিন মিজান ॥ কবিতা গান গ্রাফিতি হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। প্রতিরোধের ডাক দিচ্ছে নাটক চলচ্চিত্র। অন্যান্য শিল্প মাধ্যম, শিল্পী ও সংগঠকেরাও এখন সোচ্চার। উগ্রবাদী আচরণ সাম্প্রদায়িক হামলার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশকে উর্ধে তুলে ধরছেন তারা। এমন গর্জে ওঠা এমন জাগরণ প্রায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে শাহবাগ ও টিএসসি এলাকায়। জাতীয় জাদুঘরের সামনে, রাজু ভাস্কর্য বা অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নিয়মিতভাবেই শিল্পী সমাবেশ ঘটছে। সাংস্কৃতিক নানা আয়োজনে যোগ দিচ্ছে নাগরিক সমাজ। মানবিক ও মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা আসছেন। ঐক্যবদ্ধ এ প্রতিবাদ নতুন আশার সঞ্চার করছে। এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? গত কয়েকদিন আগে কুমিল্লা, রংপুর, চৌমুহনীসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় হামলা চালায় সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ভাংচুর করে। আগুনে পুড়িয়ে দেয় বসত বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এমন ঘটনায় বিবেকবান মানুষ মাত্রই হতবাক হয়ে যান। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নিয়ে কত না গর্ব। সে গর্বের জায়গায় আকস্মিক আঘাত এলে অনেকেই লজ্জায় ডোবেন। হৃদয় ভেঙ্গে যায়। শাহবাগ টিএসসি তৎক্ষণাৎ এই বেদনাকে ধারণ করে। তবে শুধু বেদনাবোধ নয়, সেইসঙ্গে গর্জে ওঠে। বর্তমানেও নানা ভাব ভাষায় চলছে প্রতিবাদ। গত ক’দিনের ধারাবাহিকতায় শনিবার প্রতিবাদী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ। গ্রাফিতি অঙ্কনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় কর্মসূচী। এ সময় সাম্প্রদায়িক হামলার নিষ্ঠুর ছবি দেয়ালে ফুটিয়ে তোলেন শিল্পীরা। ঘটনার নির্মমতা, মন ভাঙ্গার কষ্ট এবং ক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের অনুভূতিগুলোকে চমৎকারভাবে ধারণ করেন। একই সময় চলে গণস্বাক্ষর কর্মসূচী। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ নিজের নাম সই করে আয়োজকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানান। গণস্বাক্ষর কর্মসূচীর মাধ্যমে ৫ দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী যেকোন ধরনের রাষ্ট্রধর্ম রদ এবং রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ২. সাম্প্রতিক হামলা ও নির্যাতনের বিচার দ্রুততম সময়ের মধ্যে করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারীভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৩. প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজী মাধ্যম ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ৪. সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করতে হবে। ৫. ধর্মীয় সমাবেশে ধর্মবিদ্বেষী আলোচনা বন্ধের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মবিদ্বেষী বক্তব্য যাতে ছড়িয়ে না পড়ে এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। বিকেলে সমাবেশ ও সন্ধ্যায় ছিল সঙ্গীতানুষ্ঠান। সঙ্গীতানুষ্ঠানের শিরোনাম ‘ভিটে-মাটির গান।’ গানপোকা, মুয়ীজ মাহফুজ, লিসান, নাইম মাহমুদ এবং বুনোফুল নামের দলগুলো গানে গানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদ জানায়। শিল্পীদের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান শ্রোতারাও। চলচ্চিত্র সংসদের আয়োজনে ছিল চলচ্চিত্র প্রদর্শনীও। রাতে দেখানো হয় তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘চিত্রা নদীর পাড়ে।’ হ্যাঁ, এ ছবিটি বেশ আগের। অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু সংখ্যালঘু নির্যাতনের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সামনে আসার পর একই সিনেমা যেন সমকালীন হয়ে ওঠে। সেই যে হিন্দু মুসলমানকেন্দ্রিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, দেশভাগ, নির্যাতনের শিকার হয়ে ভিটে মাটি ছেড়ে যাওয়া- দেখতে দেখতে মন আবারও বিষণ্ণ হয়ে যায়। তার আগে গত শুক্রবার রাজু ভাস্কর্যের সামনে অনুষ্ঠিত হয় সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী কনসার্ট। ‘আক্রান্ত মাটি আক্রান্ত দেশ/এ মাটির কসম রুখবোই বিদ্বেষ’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত কনসার্টে গান করে কয়েকটি ব্যান্ড। শিরোনামহীন, মেঘদল, সহজিয়া, শহরতলী, বাংলা ফাইভ, গানপোকা, কৃষ্ণপক্ষ, কাল, অবলিক, অসৃক, গানকবি ও বুনোফুলের শিল্পীরা গানে গানে প্রতিবাদ জানান। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন জয় শাহরিয়ার, তুহিন কান্তি দাস, সাহস মোস্তাফিজ, লালন মাহমুদ, নাঈম মাহমুদ, প্রিয়াংকা পান্ডে, যশ নমুদার, তাবিব মাহমুদ, রানা, উদয়, অপু, উপায় ও অনিন্দ্য। নৃত্য পরিবেশন করেন উম্মে হাবিবা ও আবু ইবনে রাফি। আয়োজনে মূকাভিনয় পরিবেশন করে ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম এ্যাকশন। বিপুল সংখ্যক দর্শক শ্রোতা অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। একাত্মতা পোষণ করেন প্রতিবাদের সঙ্গে। তারও আগে মঙ্গলবার অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নাটকের ভাষায় সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদ জানানো হয়। এতে অংশ নেন থিয়েটার এ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের একদল শিক্ষার্থী। নাট্যায়োজন হলেও, এর মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার যে বীভৎস রূপ ফুটে ওঠে তাতে স্তম্ভিত না হয়ে পারা যায় না। একই দিন বিকেলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার বিরুদ্ধে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সাংবাদিকদের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আজ রবিবারও অব্যাহত থাকবে প্রতিবাদ। অব্যাহত থাকুক। ছড়িয়ে যাক গোটা দেশে। প্রতি প্রান্তে।
×