ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

সরকারের উন্নয়ন ভাবনায় পর্যটন

প্রকাশিত: ১৯:৫৯, ২৪ অক্টোবর ২০২১

সরকারের উন্নয়ন ভাবনায় পর্যটন

কেটে যাচ্ছে মেঘের ঘনঘটা, সুদিন আসতে শুরু করেছে পর্যটন শিল্পে। ধাপে ধাপে খুলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, এয়ারলাইন্স, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর অপারেশন ও অন্যান্য পর্যটন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম। যুক্তরাজ্যে সরকার ৩২টি দেশকে ভ্রমণের অনুমতি দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার পর্যটনকে গতিশীল করতে হাতে নিয়েছে বিভিন্ন যুগোপযোগী প্রকল্প। ইতোমধ্যে পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে গেছে। লাখ লাখ পর্যটকে মুখরিত হচ্ছে দেশের পর্যটন স্থানগুলো। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে পর্যটন’ এই প্রতিপাদ্য বিষয়কে কেন্দ্র করে উদ্যাপন হয়েছে বিশ্ব পর্যটন দিবস ২০২১। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিকে টেকসই প্রবৃদ্ধি হিসেবে দেখা হয়, যা অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি ও সম্প্রসারণ করবে। পর্যটনকে চাকরি বৃদ্ধির একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পর্যটনের ভূমিকা থাকবে যে ক্ষেত্রগুলোতে সেখানে কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে তা নিশ্চিত করার জন্য সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ সরকার পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়নকে গতিশীল করতে বহুবিধ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ২০২০-’২১ অর্থবছরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। করোনা পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকার ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি সরকার পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন ও বিকাশের পাশাপাশি দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণের লক্ষ্যে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড যে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে তা আগামী ১৮ মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে। ২০১৬-২০২১ সালকে পর্যটন বর্ষ হিসেবে উদ্যাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটন শিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করে প্রতিটি স্তরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবারের মতো সরকারী-বেসরকারী যৌথ বিনিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এগুলোতে প্রায় প্রত্যক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে: কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, আধুনিক হোটেল-মোটেল নির্মাণ, মহেশখালীতে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ, সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা, ইনানি সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরাং ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শ্যামলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, ঝিলংঝা সৈকতের উন্নয়ন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় বায়ু বিদ্যুত প্রকল্পের সম্প্রসারণ, চকোরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের আধুনিকায়ন ইত্যাদি। এছাড়া আরও চারটি নতুন প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার। এসব বাস্তবায়ন হলে আগামীতে দেশের পর্যটন খাত আরও চাঙ্গা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী খাতও পিপিপির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কক্সবাজারে যাতায়াত করার জন্য রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চাঁদপুরের মেঘনার চরে গড়ে তোলা হচ্ছে আন্তর্জাতিকমানের পর্যটন কেন্দ্র। নির্মাণ শুরু হতে যাওয়া এ পর্যটন প্রকল্পে থাকবে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের জাদুঘর, পানির ওপর ভাসমান কটেজ, চার কিলোমিটার দীর্ঘ ক্যাবল কার, ট্র্যাডিশনাল কটেজ, স্টুডিও এ্যাপার্টমেন্ট, পাঁচ তারকা হোটেল, থিমপার্ক, রিভারক্রুজ, স্পিডবোট, হেলিকপ্টার, কনভেনশন হল, থিয়েটার, মিউজিয়াম, ইন্টারন্যাশনাল এক্সপো সেন্টার, মার্কেট, জিমনেসিয়াম, ইনডোর এবং আউটডোর গেমস, ক্রিকেট এ্যারোনা, সুইমিং ক্লাব, ওয়াটার রাইড, হসপিটাল, পার্টিসেন্টার, হলিকর্নার, রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্টাফ রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া, এগ্রিট্যুরিজম, গ্রিনএনার্জি, পর্যটন ডিপ্লোমা কোর্স স্কুল প্রভৃতি। ব্লুরিভার আইল্যান্ড রিসোর্ট এ্যান্ড ট্যুরিজম ক্লাবের তথ্য অনুযায়ী এ পর্যটন কেন্দ্রে প্রতিদিন লক্ষাধিক লোকের ভ্রমণের ব্যবস্থা ও ২০ হাজার পর্যটকের রাত যাপনের সুবিধা থাকবে। এতে করে প্রায় পাঁচ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেললাইন রয়েছে। এ লাইন আরও সংস্কার করা হচ্ছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে। এ খাতে বিনিয়োগ হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন কক্সবাজারে আরও দুটি মোটেল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ বিমান-নৌবাহিনীর উদ্যোগে সেখানে একটি বড় গেস্ট হাউস নির্মাণ হচ্ছে। রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। ইতোমধ্যে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ প্রায় ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। শাহ পরীর দ্বীপের নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গড়ে উঠেছে বিশাল চর। এখান থেকে যেমন সেন্টমার্টিন দ্বীপ দেখা যায়, তেমনি সাগর ও নদীর পানির মিলনস্থলের পার্থক্যও বোঝা যায় পরিষ্কারভাবে। এগুলো পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে সেখানেও একটি প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। টেকনাফ এলাকায় তৈরি হচ্ছে ইকো ট্যুরিজম পার্ক। নাফ নদের মাঝে একটি চরকে গড়ে তোলা হচ্ছে পর্যটন এলাকা হিসেবে। মহেশখালীকে পাওয়ার হাব হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। শুধু মহেশখালীতেই বিনিয়োগ হচ্ছে লাখো কোটি টাকা। সোনাদিয়া দ্বীপে অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ পর্যটন এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কুতুবদিয়া দ্বীপে বায়ু বিদ্যুত প্রকল্প রয়েছে। এটি দেখতে অনেক পর্যটক সেখানে যান। এ কারণে একে আরও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। কক্সবাজার ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বে (পিপিপি) বাস্তবায়নের জন্য সাতটি প্রকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর ও বন্দরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ প্রকল্প। খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের পদক্ষেপ, বিশেষ করে নাফ ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার ঘোষণা পর্যটন বিকাশে নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। কারণ এতে বিনিয়োগ করছে থাইল্যান্ডের বিখ্যাত কোম্পানি সিয়ামসিয়াম ইন্টারন্যাশনাল। প্রাথমিকভাবে কোম্পানিটি ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। ২৭১ একর জায়গাজুড়ে প্রায় ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি ১২ হাজারেরও বেশি লোকের কর্মসংস্থান জোগাবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) নাফ ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়ন কাজ হাতে নিয়েছে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রথম পর্যটননির্ভর অর্থনৈতিক অঞ্চল হতে যাচ্ছে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক। কক্সবাজারের টেকনাফের সাবরাং সমুদ্রতীরে এ পর্যটন অঞ্চল গড়ে উঠছে। পরিকল্পিত এ আধুনিক পর্যটন পার্কে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কাছে বেশ কিছু কোম্পানির বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। এগুলো পর্যালোচনা করে ইতোমধ্যে ১২টি কোম্পানির প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে বেজার নির্বাহী বোর্ড। কোম্পানিগুলো পার্কের মধ্যে তারকা হোটেল, মোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণ করবে। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রায় সাড়ে ২৪ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৭৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। বেজার তথ্য অনুযায়ী পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এক হাজার ৪৭ একর আয়তনের এ পার্কে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা রেখে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রস্তাব অনুমোদন পাওয়া ১২টি কোম্পানি ১১৬ একর জমিতে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করবে। এতে প্রায় ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশ এ্যাভিয়েশন খাত নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। নতুন নতুন বিমানবন্দর স্থাপনের অনুমোদন, বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট বৃদ্ধি, বিমানবন্দর আধুনিকায়নে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় একযুগ ধরে কাজ করছে। বাংলাদেশ পর্যটনকে আধুনিকায়নে ও আন্তর্জাতিকমানের পর্যটন সেবা প্রদানের জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে সরকারী ও বেসরকারী সংস্থাগুলো। যে কোন ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড সম্পাদনের লক্ষ্যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ব্যবহার হতে পারে টেকসই উন্নয়ন সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে। তাই গবেষণাধর্মী কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে উপযোগী তথ্যের উদ্ঘাটন ও সংরক্ষণ প্রয়োজন। এগুলো নিঃসন্দেহে জনকল্যাণে সমৃদ্ধি আনয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। অপার সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিকভাবে সৌন্দর্যমন্ডিত হওয়া সত্ত্বেও মহান স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশত বছর পূর্তির দ্বারপ্রান্তে এসেও আমরা পুরোপুরি সক্ষম হয়নি দেশের পর্যটন খাতকে ঢেলে সাজাতে। তবে বর্তমান বছরগুলোতে সরকারসহ বেসরকারী অনেক প্রতিষ্ঠান পর্যটনকে অর্থনৈতিক একটি কার্যকরী খাত হিসেবে রূপান্তরে সচেষ্ট হয়েছে। তাই পর্যটন শিল্পের বিকাশে গবেষণাধর্মী কর্মকান্ড বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যটনের ওপর উচ্চশিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থাসহ বেসরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় পর্যটন শিল্পের সংযোজন শুধু আর্থিক সুফল বয়ে আনবে না, সেইসঙ্গে প্রান্তিক পর্যায়ে এর সুফল ছড়িয়ে দিবে স্থানীয়দের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পর্যটন শিল্প বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠতে পারে অন্যতম হাতিয়ার। এজন্য প্রয়োজন সরকারের উন্নয়ন ভাবনায় পর্যটন শিল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×