ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ

প্রকাশিত: ১৯:৫৭, ২৪ অক্টোবর ২০২১

বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস, জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসান, যুদ্ধ বন্ধ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টিতে জাতিসংঘের ভূমিকা বারবার আলোচনা হয়ে আসছে। জাতিসংঘের এ ভূমিকার পাশাপাশি যোগ হয়েছে পরিবেশগত সমস্যা কিংবা নারী উন্নয়ন সম্পর্কিত সমস্যাবলী। ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ দিবস বিশ্বের সকল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে উদযাপন হয়। ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল আটলান্টিক চার্টার সনদে স্বাক্ষর করেন। এ সনদে বিশ্বের সকল জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার, বাকস্বাধীনতা, স্থায়ী শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে আক্রমণকারীদের নিরস্ত্রীকরণের কথা বলা হয়েছিল। এসব আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই পরে জাতিসংঘ সনদ রচিত হয়। তবে জাতিসংঘ নামটি এসেছে ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছিল সেই ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে। এ চারটি দেশ এক ঘোষণাপত্রে আটলান্টিক চার্টারে বর্ণিত নীতি ও আদর্শের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছিলেন, যা ‘জাতিসংঘ ঘোষণা’ নামে পরিচিত। পরে ২ জানুয়ারি আরও ২২টি রাষ্ট্র এ ঘোষণার প্রতি সমর্থন জানায়। জাতিসংঘ গঠনের প্রেক্ষাপট হিসেবে মস্কো ঘোষণা, তেহরান সম্মেলন, ডুম্বারটন ওকস সম্মেলন ও ইয়াল্টা সম্মেলন উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৩ সালের নবেম্বর মাসে তেহরানে বিশ্ব রাজনীতির তিন শীর্ষ নেতা, রুজভেল্ট, স্ট্যালিন ও চার্চিল অপর এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা জানান যে, একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগদানের জন্য বিশ্বের সকল ছোট ও বড় দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। সম্মেলনে একটি বিশ্ব সংস্থা গঠন ও এর কাঠামো সম্পর্কে প্রস্তাব গৃহীত হয়। নিরাপত্তা পরিষদ গঠনে স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্যের প্রস্তাব করা হয়। বলা হয় পাঁচটি দেশ স্থায়ী সদস্য ও ছয়টি দেশ অস্থায়ী সদস্যপদ পাবে। স্থায়ী সদস্যদের ভেটোর অধিকার দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে ভেটো দানের পদ্ধতি সম্পর্কে কোন ঐকমত্য হয়নি। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইয়াল্টায় একটি শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে যোগ দেন রুজভেল্ট, স্ট্যালিন ও চার্চিল। ওই সম্মেলনে বৃহৎ পাঁচটি শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, চীন ও ফ্রান্সকে ভেটো ক্ষমতা দেয়া হয়। ইয়াল্টা শীর্ষ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি সনদ রচনা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো শহরে ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত ৫০টি দেশের প্রতিনিধিরা মিলিত হন। ২৬ জুন ১১১টি ধারা সংবলিত সনদটি অনুমোদন হয় এবং তাতে বৃহৎ পঞ্চশক্তির ভেটো ক্ষমতা স্বীকার করে নেয়া হয়। তবে সর্বসম্মতভাবে সনদটি স্বাক্ষর হয় ২৪ অক্টোবর। মোট ৫১টি দেশ মূল সনদে স্বাক্ষর করেছিল। এ কারণে প্রতি বছর ২৪ অক্টোবরকে জাতিসংঘ দিবস হিসেবে উদ্যাপন করা হয়ে থাকে। এভাবেই দীর্ঘ চার বছরের পরিকল্পনা ও বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাড়ানোর প্রয়োজনে জাতিসংঘ আত্মপ্রকাশ করে। জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হওয়ার পর ১৯৪৬ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডনের ওয়েস্ট মিনিস্টারের সেন্ট্রাল হলে প্রথমবারের মতো সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসে। জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হওয়ার পর এ পর্যন্ত সনদের চারটি ধারা সংশোধন করা হয়েছে। ১৯৬৫ সালে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যপদ ১১ থেকে বাড়িয়ে ১৫ করা হয়েছে এবং বিভিন্ন পদ্ধতিগত ও অন্য সকল বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের হ্যাঁ সূচক ভোটের সংখ্যা ৭ থেকে বাড়িয়ে ৯ করা হয়েছে। জাতিসংঘের মূল সনদে ৫১টি দেশ স্বাক্ষর করলেও বর্তমানে জাতিসংঘের সদস্যসংখ্যা তিনগুণের ওপরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিশ্ব সংস্থার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। মূলত দুটি বিশ্বযুদ্ধের কারণে সমগ্র মানবজাতির জীবনে যে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা সৃষ্টি হয়েছিল তার ভয়াবহতা অনুধাবন করেই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ জাতিসংঘের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে যেসব বিষয় তখন প্রাধান্য পেয়েছিল তা হলো, যে কোন ধরনের যুদ্ধকে নিরুৎসাহিত করা, ছোট ছোট দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আগ্রাসী দেশগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, একটি নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করা, আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারে দেশগুলোকে ধারণা দেয়া এবং ছোট ছোট দেশের প্রগতি ও উন্নয়ন সাধনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা ইত্যাদি। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এসব লক্ষ্যকে সামনে রেখেই জাতিসংঘের সনদ রচনা করেন। জাতিসংঘ সনদে বলা হয়েছে, এসব লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে প্রতিটি রাষ্ট্র সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করবে। প্রতিটি রাষ্ট্র সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করবে এবং শান্তিতে বসবাস করবে। নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার না করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ যাতে একটি রাষ্ট্রের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে জাতিসংঘের সনদে এই বিষয়টিরও উল্লেখ আছে। জাতিসংঘ প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার স্বীকার করে এবং সমতার ভিত্তিতে প্রতিটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার নীতিতে বিশ্বাসী। জাতিসংঘ কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করবে না। কিন্তু যদি ওই রাষ্ট্র বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হয়ে দেখা দেয় তাহলে ওই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিষদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা। প্রতিটি সংস্থারই সাফল্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ব্যর্থতা। জাতিসংঘের ক্ষেত্রেও এই কথাটা প্রযোজ্য। জাতিসংঘের সাফল্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে এর ব্যর্থতাও। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা জাতিসংঘের অন্যতম উদ্দেশ্য। অথচ দেখা গেল বিভিন্ন দেশের মধ্যে যেসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, বিশেষ করে চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধ, আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন, ভিয়েতনাম কর্তৃক কম্পুচিয়ায় আগ্রাসন কিংবা কিউবার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চাপ, ইরান-ইরাক যুদ্ধ এসব প্রতিরোধ করতে জাতিসংঘ প্রায় ব্যর্থ হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুটি বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে আন্তঃপ্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে যে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হয়েছিল সেই স্নায়ুযুদ্ধ রোধ করা কিংবা উত্তেজনা হ্রাস করার ব্যাপারে জাতিসংঘ কোন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তবে তুলনামূলক বিচারে জাতিসংঘের সাফল্য বেশি। বিশেষ করে শান্তিরক্ষা, পরিবেশ কার্যক্রম কিংবা উন্নয়ন কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত হয়ে জাতিসংঘ উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষী পাঠিয়ে জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসানের উদ্যোগ নিয়েছে জাতিসংঘ। লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
×