ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রকাশিত: ২০:২৩, ২৩ অক্টোবর ২০২১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

আল্লাহ জাল্লা শাহনুহু আম্মান আল্লাহু, আল্লাহ হাফেজ ও হুজুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম- এসব কথা আজকাল বেশ প্রচলিত। এক সময় এসব শব্দ আলেমদের কথায় এবং লেখনীতে তেমন উচ্চারিত হতো না। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে আশির দশকের শুরুতে যার লেখনী ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তিনি হলেন সমকালীন বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, আধ্যাত্মিকতা ও ইলমে তাসাউফ শিক্ষার অগ্রদূত, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলাম লেখক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল কাইয়ূম রহমাতুল্লাহি আলায়হি। তিনি বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর লেখায় আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর শান মান ও মর্যাদা বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম একটি নাম, একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হাক্কানী আলেম। তিনি ১৯৪৪ সালের ৩০ এপ্রিল বর্তমান মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার দ্বারিয়াপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত পীর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলিয়ে কামেল ফুরফুরা শরীফের পীর মুজাদ্দীদে যামান মুহ্ইয়স সুন্নাহ, আমীরুশ শরীয়ত হযরত মাওলানা শাহ সূফী আলহাজ আবু বকর সিদ্দিকী রহমাতুল্লাহি আলাইহির অন্যতম প্রধান খলিফা নায়েবে মুজাদ্দীদে যামান হযরত মাওলানা শাহ সূফী আলহাজ তোয়াজউদ্দীন আহমদ (রহ.) এবং মাতা বাংলার তাপসী রাবেয়াখ্যাত মোছাঃ জোহরা খাতুন (রহ.)। জনশ্রুতি আছে যে শিশু আবুল হাসান মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় তার মায়ের পেট থেকে আল্লাহু আল্লাহু শব্দ শোনা যেত। রত্নগর্ভা মা ও ওলিয়ে কামেল পিতার চাঁদমুখো এই অলি শিশুকে সবাই আদর করতে দূর-দূরান্ত থেকে দেখতে আসত। তিনি ছিলেন মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান। তার বড় ভাই হুজুর কিবলার প্রথম সন্তান আবুল বাশার মুহম্মদ আবদুল হাই (রহ.)। যিনি শৈশবেই দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন। সেহেতু শিশু আবুল হাসান একটু বেশিই স্নেহাশীর্বাদ ও আদর যত্ন পেয়েছেন। ছোটবেলায় তার শিক্ষার হাতেখড়ি মা মোছাঃ জোহরা খাতুনের কাছে। তিনি শৈশবেই মাতার কাছে কোরআন শিক্ষা গ্রহণ করেন। আর আব্বা আলেমে হাক্কানীর কাছে বাল্যকাল থেকেই আধ্যাত্মিকতা শিক্ষার মাধ্যমে শৈশবের পাঠ শেষ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় গ্রামের দ্বারিয়াপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। ছাত্র অবস্থায় তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি পিতার কাছে ইলমে তাসাউফের শিক্ষা গ্রহণ করেন। এরপর খুলনা বিকে ইনস্টিটিউট ও মাগুরা হাই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা সরকারী ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের মাদ্রাসা শাখা থেকে মাদ্রাসা শিক্ষায় চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর জেনারেল শিক্ষা লাভের জন্য তিনি কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে জগন্নাথ কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে ভর্তি হন। পরে ১৯৭০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওই বিষয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ছাত্রজীবনে তিনি প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে পিতা উপমহাদেশের প্রখ্যাত সূফী তোয়াজউদ্দীন আহমেদ (রহ.) তাকে উচ্চস্তরের আধ্যাত্মিক শিক্ষা ইলমে লাদুনীর ছবক দেন। আর যারা এ ছবক লাভ করেন তারা আল্লাহ প্রদত্ত নিগূঢ় জ্ঞানের অধিকারী হন। তাই তো তার লেখনী ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা ও বক্তৃতায় বিজ্ঞজনরা এসব অনুধাবন করতেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায় তার বিশেষ অবদান স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। তিনি ছিলেন সমকালীন বাংলাদেশের পীরদের পীর, আলেম সমাজের অহঙ্কার। বর্তমান সময়ের হাক্কানী আলেম ওলামাগণ তার কাছে আধ্যাত্মিক জ্ঞান আহরণ করতেন এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতেন। হাসান আব্দুল কাইয়ূমের পেশাগত জীবন শুরু হয় কলেজে অধ্যাপনার মাধ্যমে। তিনি মাগুরার শ্রীপুর ডিগ্রী কলেজ, মাগুরার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকার হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৮০ সালে জানুয়ারি মাসে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করে খুব অল্প দিনেই পরিচালক পদে উন্নীত হন এবং ২০০২ সালে সফলতার সঙ্গে কর্মজীবন শেষ করে অবসর নেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত অবস্থায় তার মাধ্যমে ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ যেমন- তাফসিরে তাবারি, বুখারী শরীফ, ইসলামী বিশ্বকোষ প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। ইসলামী বিশ্বকোষে তার অনেক মৌলিক ও অনূদিত প্রবন্ধ,-নিবন্ধ রয়েছে। তিনি ছোট-বড় বিভিন্ন বয়সী পাঠকদের জন্য লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হলো অনুপম আদর্শ, ফুরফুরার চাঁদ, প্রসঙ্গ ইসলাম, ইসলাম ও জীবন, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী, খোকা-খুকুর ছড়া, জিহাদ, কাদেরিয়া তরিকা, তা’লীমে তাসাউফ ইত্যাদি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘অগ্রপথিক’, শিশু পত্রিকা ‘সপ্তডিঙ্গা’ ও সাহিত্য সাময়িকী ‘ঐতিহ্য’-এর সম্পাদক ছিলেন তিনি। এ ছাড়া তার সম্পাদনায় ১৯৭২ সালে ‘নবকাল’ নামে মাগুরা থেকে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ছয় সহস্রাধিক। তিনি তার পিতার স্মরণে আঞ্জুমানে তোয়াজিয়া নামে একটি জনকল্যাণমূলক সংস্থা গড়ে তুলেছেন। দ্বারিয়াপুর দরবার শরীফে তিনি গড়ে তুলেছেন আঞ্জুমানে তোয়াজিয়া নামে একটি এতিমখানা। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফুরফুরা সিলসিলার দ্বারিয়াপুর দরবার শরীফের গদিনশিন পীর ছিলেন। অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম (রহ.) গত বছর মহামারী করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রফিকুল আ’লার ডাকে সাড়া দিয়ে অগণিত মুরিদ ভক্ত ও শুভাকাক্সক্ষীদের চোখ পানিতে ভাসিয়ে এ নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ইসলামের সৌন্দর্যকে তিনি সব সময় সমুন্নত রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। কেউ এসব বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলে তিনি কোরান হাদিসের আলোকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন। বিশেষ করে মিলাদ কিয়াম ও ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর ব্যাপারে তিনি ছিলেন সোচ্চার এবং রসূল (সা.)-এর শান মান মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে ছিলেন অবিচল। তিনি ছিলেন এক কথায় সত্যিকার অর্থে ফানাপিস শায়েখ ও ফানাফির রসূল। তিনি আফ্রিকার লিবিয়া ও গাম্বিয়ায় ৪/৫ বার পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে বিশ্ব পীরদের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন অনেক বিখ্যাত আলেম ওলামাদের উপস্থিতিতে। তিনি মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও আরবি, ফারসি, উর্দু, ইংরেজী ও হিন্দী ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি ইত্তেফাক, ইনকিলাব, জনকণ্ঠ ও ইংরেজী ডেইলি সান পত্রিকায় বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ে কলাম লিখতেন। ১৯৮০-এর দশক থেকে তিনি ইত্তেফাক পত্রিকায় নিয়মিত মাহে রমজানের ওপর লিখতেন। এমন একজন জ্ঞানতাপসকে হারানোর বেদনা সত্যি কষ্টদায়ক, ভোলার নয়। পীর-মুরিদীতে কম সময় দিলেও বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখির মাধ্যমে তিনি জ্ঞানপিপাসুদের তৃষ্ণা অনেকটা নিবারণ করেছেন। আরও অবদান রেখেছেন টিভি- রেডিওতে বক্তৃতা ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনার মাধ্যমে। তার আব্বা হুজুর হযরত মাওলানা শাহ সূফী তোয়াজউদ্দীন আহমদ (রহ.) তাকে ১৯৮৬ সালে ফুরফুরা শরীফ নিয়ে যান এবং ফুরফুরার মুজাদ্দীদে যামান (রহ.)-এর মেজ সাহেবজাদা মুফতিয়ে আযম বাংলা ও আসাম পীর আল্লামা আবু জাফর মোহাম্মদ অজীহুদ্দীন মুস্তফা সিদ্দিকী সাহেবের হাত দিয়ে তাকে দেয়া দাদা হুজুর কিবলা (রহ.)-এর খেলাফতনামা ও পাগড়ি হস্তান্তর করেন। সঙ্গে ছিলেন তাদের প্রিয় খন্দকার হাসেম আলী। এই মুহূর্তে এক হৃদয়বিদারক ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ দৃশ্যের অবতারণা হয় যা উপস্থিত সকলে অবলোকন করেন। এরপর ১৯৯২ সালের ১৬ জুন হুজুর কিবলা (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম তার পিতার স্থলাভিষিক্ত (কায়েম মাকাম) হন এবং আমৃত্যু গদিনশীন পীর হিসেবে দ্বারিয়াপুর দরবার শরীফে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, গদিনশীন পীর সাহেব ২০০৬ সালে সস্ত্রীক হজব্রত পালনের সময় হুজুর (সা.)-এর রওজা মোবারকের সামনে তার একমাত্র সাহেবজাদা আলহাজ শাহ আরিফ বিল্লাহ মিঠুকে খেলাফতের স্মৃতিস্বরূপ পাগড়ি পরিয়ে দেন এবং তার অবর্তমানে দ্বারিয়াপুর দরবার শরীফের গদিনশীন মনোনীত করেন। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন ইসলামী তাৎপর্যপূর্ণ দিনগুলোতে তেমন কোন প্রবন্ধ নিবন্ধ দেখা যায় না। অথচ অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম (রহ.)-এর জীবদ্দশায় এসব দিনে বিশেষ ক্রোড়পত্রসহ অনেক লেখা দেখা যেত। সে কারণে অগণিত পাঠক, ভক্ত ও অনুরাগীর কাছে তিনি অনেক দুষ্প্রাপ্য। তার অভাব আমরা প্রতিনিয়ত অনুভব করি। প্রথম ওফাত বার্ষিকীর এই দিনে আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত ও জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকাম কামনা করছি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলের দোয়া ও নেক বাসনা পূরণ করুন। আমিন। লেখক : সাংবাদিক
×