ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ॥ অসাম্প্রদায়িক মানস

প্রকাশিত: ২০:২২, ২৩ অক্টোবর ২০২১

মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ॥ অসাম্প্রদায়িক মানস

মনস্বী অনুমেয় যে, ১৩৪৬ সালে সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহর শাসনকালে বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার ভ্রমণ তথ্যে চট্টগ্রামের আদিরূপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। প্রায় একই সময়ে চৈনিক লেখক ওয়াংতা-ইউয়ান রচিত ‘তাও-য়ি-চি-লিয়েহ’ গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত বিবরণী চট্টগ্রামের স্বীকৃত উপস্থাপন। অনবদ্য বিবরণ রয়েছে ১৪১৫ সালে বাংলার শাসক জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহের সাক্ষাতপ্রার্থী চীন সম্রাটের দূত ফেই-শিনের লেখা ‘শিং-ছা-শ্যাং-লান’ গ্রন্থসহ বিপুল সংখ্যক পর্যটন লেখনীতে অধিকতর গুরুত্ব বহন করেছে চট্টগ্রামে আরাকানী শাসন। একদিকে মুসলিম জনবসতি এবং অঞ্চল শাসনে মুসলিম প্রভাব, অন্যদিকে সম্ভ্রান্ত আরাকানীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের যুগান্তকারী উত্তরণ ছিল চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নিরন্তর রশ্মি। হাজার বছরের ইতিহাস পর্যালোচনায় চট্টগ্রামে সংঘটিত নানাবিধ সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের সমীকরণ সমার্থক বিদ্রোহ-বিপ্লবের যুগসন্ধির সঞ্চার সর্বত্রই সমাদৃত। ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে বজ্রকঠিন সিপাহী বিদ্রোহের প্রেরণায় চট্টগ্রামে সিপাহীদের বিদ্রোহ, কারাভাঙ্গা বন্দীমুক্তি এবং সরকারী কোষাগার দখল বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। এজন্যই সিপাহীদের ফাঁসি, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রত্যয়িত দৃষ্টান্ত। ১৮৯২ ও ১৮৯৬ সালে ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রামকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে অসম প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্তির প্রতিবাদে চট্টগ্রাম এ্যাসোসিয়েশন, ১৯০১ সালে ‘চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্মিলন’, ১৯০২ সালে বিপ্লবী যাত্রামোহন সেনের সভাপতিত্বে ২৯ ও ৩০ মার্চ প্রথম বার্ষিক সভা, ১৯০৩ সালে ১৩ ও ১৪ মার্চ কুমিল্লা টাউন হলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্মিলন অনুষ্ঠান চট্টগ্রাম-নেতৃত্বের অভূতপূর্ব অহিংস প্রেরণার প্রভাব উন্মোচন করে। দেশপ্রেমের অভিযাত্রায় শ্রদ্ধাভাজন যাত্রামোহন সেন, এইচ.এম. পার্সিভ্যাল, শশাঙ্কমোহন সেন, মৌলবি আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী, কাজেম আলী মাস্টার প্রমুখের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। ১৯০৫ সালে রাউজানের কোয়েপাড়ায় শ্রদ্ধেয় যামিনী সেন প্রতিষ্ঠিত ‘চট্টল হিতসাধিনী সভা’ বঙ্গভঙ্গবিরোধী ও ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে কবি শশাঙ্কমোহন সেন, কাজেম আলী মাস্টার, মহিমচন্দ্র দাশ, বিপিনবিহারী চৌধুরী কৃতীমানবের সম্মানে ভূষিত হন। ১৯২০ সালে কাজেম আলী মাস্টার, মহিমচন্দ্র দাশ, অম্বিকা চক্রবর্তী, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মওলানা নজির আহম্মদ প্রমুখ কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করেন। কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত অসহযোগ আন্দোলন বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুলের ছাত্ররা প্রথম ক্লাস বর্জন করে। পরবর্তীতে অন্যান্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ধর্মঘট ও মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সভাপতিত্বে সমাবেশ আয়োজন করেন। দীপ্যমান উল্লেখ্য, ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রিকতায় উজ্জীবিত হয়। মাস্টারদা সূর্যসেন গোপন বিপ্লবী দলের উন্মেষ ঘটিয়ে অসহযোগ আন্দোলনকে বেগবান করেন। সমাজসংস্কারক মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ১৮৭৫ সালের ২২ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলা, বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলা বরমা ইউনিয়ন আড়ালিয়া গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। কালের যাত্রায় সার্থক উজ্জীবন পরিচয়ে মহান সাধক ও চিন্তক মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী স্বকীয় ঋদ্ধ বলয়ে হয়েছেন নিষিক্ত উদ্ভাসিত। বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য ও অভিধায় অভিষিক্ত এই চট্টল মনীষা অনুগ্র চিন্তা-চেতনা-ভাবনার প্রকীর্ণ দৃষ্টান্ত হিসেবে ভারতবর্ষের ইতিহাসে অনন্য মর্যাদায় সমাসীন হয়েছেন। ভারতবর্ষের দুই মহান বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের অগ্রগণ্য অভিভাবক ও প্রক্ষোভ বিবেকখ্যাত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও অধ্যাপক আবুল ফজল ‘মওলানা ইসলামাবাদী’ শিরোনামে তাঁদের অমূল্য লেখনীতে এই মহান কৃতীমানবের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর লেখনীতে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯১০ সালে মওলানা সাহেবের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ প্রথম বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে তাঁদের পরিচিতির গাঢ়ত্ব পরিণতরূপ ধারণ করে ১৯২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। এ সময় মওলানা ইসলামাবাদী ও অন্যান্য সাহিত্যিকের সম্মিলিত চেষ্টায় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যার প্রথম সম্পাদক ছিলেন স্বয়ং ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনিসহ মওলানা আকরম খাঁ প্রমুখের সঙ্গে ১৯১৩ সালে মওলানা ইসলামাবাদী ‘আঞ্জুমান-এ-ওলামা-এ বাঙ্গালা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এ সমিতির মুখপাত্র ‘আল-এসলাম’-এ মওলানা ইসলামাবাদী এবং ড. শহীদুল্লাহ বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ড. শহীদুল্লাহর তীক্ষè বিবেচনায় তাঁরা উভয়েই ছিলেন যুক্তিবাদী ইসলামে বিশ্বাসী। ১৯১৪ সালে ড. শহীদুল্লাহ বি.এ পাস করে মওলানা ইসলামাবাদীর পরামর্শক্রমে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে যোগদান এবং সেখান থেকেই ১৯১৫ সালে বসিরহাটে ওকালতি আরম্ভ করেন। ১৯১৮ সালে চট্টগ্রামে আঞ্জুমান-এ-ওলামা-এ বাঙ্গালার দ্বিতীয় সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ইসলামাবাদী। ড. শহীদুল্লাহর ভাষায়, ‘মওলানা ইসলামাবাদী ছিলেন একজন আলেম; কিন্তু অন্ধ বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন যুক্তিবাদী-জ্ঞান-বিজ্ঞানের পক্ষপাতী, সমাজসেবক ও সমাজের কর্মী। নানা অর্থকষ্টের মধ্যেও তিনি সাহিত্য সাধনা ও সমাজসেবা করে গিয়েছেন। তাঁর শেষ কার্য ছিল চট্টগ্রামে একটি এতিমখানা স্থাপন, আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা এবং স্থাপনার জন্য চট্টগ্রামের নিকটবর্তী দেয়াং পাহাড়ে বিস্তৃত জমিও সংগ্রহ করেছিলেন। বর্তমান সময়ে তাঁর অভাব আমরা বিশেষভাবে অনুভব করি। আল্লাহ্তায়ালা তাঁর রুহের মাগফেরাত করুন- এই প্রার্থনা আমরা সকলে সমবেতভাবে করি।’ আমাদের সকলেরই জানা যে, ব্রিটিশ ভারতের প্রায় সকল প্রদেশই স্বতন্ত্র অস্তিত্বে বিকশিত। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্ম-শিক্ষা, অনগ্রসর-প্রাগ্রসর অঞ্চল হিসেবে বহুধা সত্তায় খন্ডিত ও বিভাজ্য। জনসংখ্যার দিক থেকে মুসলিম অধ্যুষিত বর্তমান বাংলাদেশ ছিল ভাষা-সংস্কৃতি-জীবনপ্রবাহ ও কর্ম-শিক্ষায় বহুলাংশে সমৃদ্ধ। এতদঅঞ্চলে ধর্মান্তর বা অন্যান্য বিভেদ সৃষ্টি ও কৃষ্টি-ঐতিহ্য কলুষিত করার মতো তেমন উর্বর পটভূমি তৈরি হয়নি। সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি-ভ্রাতৃত্ব-বন্ধুত্ব ইত্যাদির পাশাপাশি বসবাসকারী পরিবেশ-প্রতিবেশকে অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী অনুষঙ্গে পরিপুষ্ট করতে সহায়ক ছিল। এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, ইংরেজ শাসনের ফলে মুসলমানদের সম্প্রদায়গত অবস্থান, সমাজের নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা অর্জন বা ভোগে নাজুক অবস্থার দৃশ্যপট অবর্ণনীয় দুর্দশা ও অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধে চরম বিশ্বাসঘাতকতা ও নৃশংসতায় মুসলিম শাসনের পরাজয় এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের প্রভাব মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক অবস্থান চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য-শাসন ব্যবস্থায় মুসলিম অস্তিত্ব কঠিন এক সঙ্কটাপন্ন ও যারপরনাই পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছিল। এসব বিষয় সম্পর্কে ডব্লিউডব্লিউ হানটার তাঁর ‘আওয়ার ইন্ডিয়ান মুসলমান’ গ্রন্থে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। একদিকে নিপীড়ন-নির্যাতন যতই বেড়েছে, অন্যদিকে সচেতনতা-প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সংহতির বন্ধনও মুসলমান সমাজকে সুদৃঢ় এবং বৈষম্য মুক্তির অবলম্বন হিসেবে কথিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনিবার্য ভূমিকা পালনে অনুপ্রাণিত করেছে। অধ্যাপক আবুল ফজলের মতে ‘১৮৫৭’-এর বিপর্যয়ের সেই যুগসন্ধিক্ষণে মওলানা মনিরুজ্জামানদের আবির্ভাব। তখন বাঙালী মুসলমান সমাজে মোটামুটি দুই শ্রেণীর নেতৃত্ব দেখা গিয়েছিল। এ দুই নেতৃত্বও সামাজিক চাহিদা ও প্রয়োজনেরই ফল। দুই নেতৃত্বেরই উদ্দেশ্য একই ছিল, যদিও পথ ছিল ভিন্নতর। উভয় নেতৃত্বেরই আদর্শ ছিল সমাজকে আত্মসচেতন করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দেয়া। যুগের মোকাবেলার পরিপ্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র সমাজ হিসেবে মুসলমানকে আত্ম প্রতিষ্ঠার সহায়তা করা। প্রকৃতপক্ষে একটি ধারা ছিল ইংরেজী শিক্ষায় তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে দেশের শাসন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা পালন। ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নির্ধারণ করে সমাজ-মননে মুসলমানদের অবদানকে অগ্রগণ্য করার প্রচেষ্টা একেবারেই যে ব্যর্থ হয়েছে তা বলা যাবে না। এই প্রক্রিয়ায় কলকাতার আলীয়ার মতো উচ্চমার্গের মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা এবং এর সঙ্গে এ্যাংলো এশিয়ান বিভাগ সংযোজন উল্লেখযোগ্য। অন্য ধারায় পরিপূর্ণ সরকারবিরোধী মনোভাব পোষণ এবং যৌথ উদ্যোগে সীমিত নিজস্ব সম্পদের বিনিময়ে মহান আল্লাহ্তায়ালার অপার রহমতনির্ভর আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় ছিল মৌলিক আশ্রয়স্থল। জনসাধারণের মঙ্গল সাধন এবং ধর্ম-জাতীয়তাবোধে জাগ্রত নেতৃত্বের অধিকাংশই ছিলেন আলেম সমাজ। ধর্মভিত্তিক চিন্তা-চেতনায় এঁদের কর্মযজ্ঞ পরিচালিত হলেও সম্যক উপলব্ধিতে ছিল বাংলা ভাষার মাধ্যম ছাড়া বাংলাদেশে কোন উদ্যোগই সফল হতে পারে না। এটিই ছিল ধার্মিক ও অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ দর্শনের অবিস্মরণীয় চিন্তন। কাল পরিক্রমায় মওলানা ইসলামাবাদী এই ধারারই অন্যতম পথপ্রদর্শক এবং ধারক ও বাহক। সমগ্র জনগোষ্ঠীর কার্যকর কল্যাণ সাধন-জাতির উন্নয়ন-জীবনযাত্রার সমস্যা সমাধানে প্রায়োগিক পন্থার স্বরূপ উন্মোচনই ছিল এদের প্রণিধানযোগ্য উদ্দেশ্য। প্রাসঙ্গিকতায় উল্লেখ্য যে, তাঁর সৃজনশীল কর্ম প্রণোদনায় তিনি বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ-প্রবন্ধ-প্রকাশনা রচিত করে মুসলমান সম্প্রদায়কে জ্ঞানাঙ্কুর উদ্দীপনায় প্রজ্বলন করতে পেরেছিলেন। এসব সর্বজন প্রশংসিত লেখনীর মধ্যে ছিল - কোরানের স্বাধীনতার বাণী, তুরস্কের রাজধানী মহানগরী কনস্টান্টিনোপলের বিশেষ বিবরণ, ভারতের মুসলমান সভ্যতা, ভারতে ইসলাম প্রচার, সমাজ সংস্কার, তুরস্কের সুলতান জীবনী, খাজা নেজামউদ্দীন আউলিয়া, মুসলমানদের সুদ সমস্যা ও অর্থনীতির মৌলিক সমাধান, নিম্নশিক্ষা ও শিক্ষাকর, খগোল শাস্ত্রে মুসলমান, ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমান, আওরঙ্গজেব, মোসলেম বীরাঙ্গনা, ইসলামের শিক্ষা, হযরতের জীবনী, রোজনামচা, পৌরাণিক ও বৈদিক যুগ, ইসলাম ও রাজনীতি, তাপসকাহিনী, শিল্পক্ষেত্রে মুসলমান, রাজনীতির ক্ষেত্রে আলেম সমাজের দান, শুভ সমাচার, স্পেনের ইতিহাস, বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের জাতীয় উন্নতির উপায়, আত্মজীবনী পরিশিষ্ট, একটি ইংরেজী ও উর্দু বাংলা প্রবন্ধ উল্লেখযোগ্য। মওলানা ইসলামাবাদী শিক্ষা জীবন শেষে সরকারী চাকরির মোহ পরিত্যাগ করে ১৮৯৬-৯৭ সালে রংপুর শহরের মুনশীপাড়া জুনিয়র মাদ্রাসায় হেড মৌলবি পদে যোগদান এবং পরবর্তীতে ১৯০০ সালে ছয় মাস চট্টগ্রামের মৌলবি আবদুল আজিজ প্রতিষ্ঠিত মুসলিম বোর্ডিংয়ে তত্ত্বাবধায়ক পদে কাজ করেন। তিনি সীতাকুন্ড সিনিয়র মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক পদেও কর্মরত ছিলেন। সত্য-সুন্দর ও মঙ্গল সন্ধানে কুসংস্কারবিহীন সত্যনিষ্ঠ মানুষ গড়ার লালিত স্বপ্নে তাঁর জীবন ছিল ব্যাপৃত। ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলনে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে জাতীয় নেতার মতো অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন। অসহযোগ-বঙ্গভঙ্গ রদ-খিলাফত আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসনীয়। মওলানা ইসলামাবাদী ছিলেন ১৯২৩ সালের ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’-এর অন্যতম স্থপতি। বিশ শতকের ত্রিশ দশকে কংগ্রেস ছেড়ে কৃষক প্রজা পার্টিতে যোগদান এবং দলের মনোনয়নে ১৯৩৭ সালে চট্টগ্রামের সদর দক্ষিণ মহকুমা থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি চট্টগ্রাম টাউন ব্যাংকেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। সাহিত্য-সাংবাদিকতা-সমাজসেবা-সমাজসংস্কার ইত্যাদি যুগান্তকারী কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে তিনি মুসলিম সমাজের অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে এবং নানামুখী অধঃপতন থেকে এদের সুরক্ষা কর্মকৌশল ও প্রেরণার মার্গশীর্ষ দৃষ্টান্ত হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। ১৯২৮ সালে দৈনিক ‘আম্বর’ পত্রিকা প্রকাশ, ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে ইয়াতিমখানা প্রতিষ্ঠা এবং ‘ইসলামাবাদ’ নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা পরিচালনা তাঁর নান্দনিক-মননশীল চিন্তা-চেতনা প্রগতির গৌরবগাথায় অভিষিক্ত। মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও নিখাঁদ দেশপ্রেমে অত্যুজ্জ্বল চিন্তক ও সাধক মওলানা ইসলামাবাদী প্রায় ৭০ বছর বয়সে ১৯৪৫ সালে লাহোর সেন্ট্রাল জেলে কারাবন্দী ছিলেন। সে সময় জেলে বসে নিভৃত কক্ষে রচনা করেছেন অভিমানী পদ্য - ‘ষাটের উপরে আরও দশ বছর বৃথায় কেটেছে জীবন আমার/ দেশে-দেশান্তরে ভ্রমি সমাজ সেবায় রাজনীতি, সমাজনীতি সাহিত্য চর্চায়।/ ধর্ম প্রচারের কাজে, বিস্তারে শিক্ষায়, এসব কাজেতে মোর কেটেছে সময়।/ কিন্তু হায়! জন্মস্থান নিজ বাসভূমে সাধু কার্য করি নাই, নিজ পল্লীধামে,/ সংকল্প করিয়াছি জীবন সন্ধ্যায় জীবনের অবসান করিব এথায়।’ অভূতপূর্ব গৌরব অর্জনে মহিমান্বিত সমাজমানস মওলানা ইসলামাবাদী ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর ৭৫ বছর বয়সে চিরতরে না ফেরার দেশে গমন করেন। অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী স্বপ্রতিষ্ঠিত ইয়াতিমখানা সংলগ্ন কদম মোবারক মসজিদের সম্মুখে প্রাচীন করবস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। চলমান অসংযত ও অসংলগ্ন ধর্মীয় উন্মাদনার নগ্নতা-ব এবং পবিত্র ইসলামবিরোধী হিংস্র কর্মযজ্ঞের বহির্প্রকাশে মওলানা ইসলামাবাদীর মতো দেশপ্রেমিক-অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বের অনুসন্ধান অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে। ধর্মান্ধতাকে পরিপূর্ণ পরিহার করে প্রত্যেক ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মানবতা-পরমতসহিষ্ণুতা এবং সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির অমূল্য বন্ধনকে নিগূঢ় করার উদ্দেশ্যে কদাচার-পাপাচার-নৃশংসতা-সহিংসতা-পাশবিক মনোবৃত্তি নির্মূলে মওলানা ইসলামাবাদীসহ ধার্মিক-অসাম্প্রদায়িক মহান ব্যক্তিদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ সত্যের কাঠিন্যে অতীব জরুরী। মহাপ্রয়াণের দিনপঞ্জি স্মরণে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন এবং মহান স্রষ্টার দরবারে তাঁর আত্মার প্রগাঢ় শান্তি প্রার্থনা করছি। লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×