ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গ্লাসগোই হোক টার্নিং পয়েন্ট

প্রকাশিত: ২০:২৫, ২২ অক্টোবর ২০২১

গ্লাসগোই হোক টার্নিং পয়েন্ট

জাতিসংঘের ২৬তম জলবায়ু সম্মেলন শুরু হচ্ছে ৩১ অক্টোবর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে। যাকে সংক্ষেপে কপ টোয়েন্টি সিক্স হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি চরম পর্যায়ে উঠে গেছে। যার নানা প্রভাব দেখা যাচ্ছে পৃথিবীতে। আগামী দিনগুলোতে আমাদের নিত্যদিনের জীবনযাপনেও বড় রকমের পরিবর্তন আসতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়তে পারে জীবনহানি, বাড়তে পারে সহায়-সম্পত্তির ক্ষয়-ক্ষতি। ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে এই পৃথিবীকে রক্ষার জন্য এবারের সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক ইউরোপ, চীন এবং ভারতে প্রলয়ঙ্করী বন্যা, কানাডায় রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত পরিলক্ষিত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি সত্যিই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ পৃথিবীর বুকে একের পর আঘাত হানছে। ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমটে চেঞ্জের (আইপিসিসির) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন শ’ বছরে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং পরবর্তী ২০ বছরে এই তাপমাত্রা উন্নীত হবে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। বৈশ্বিক এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের দেশে দেশে দেখা দিচ্ছে তাপপ্রবাহ ও খরা। পাশাপাশি, অতি বৃষ্টির প্রভাবে বন্যাও ভাসিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর নানা প্রান্ত। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে এই মুহূর্ত থেকে যদি জরুরী ভিত্তিতে বিশ্বজুড়ে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো বন্ধ করে দেয়া হয়, তা হলেও বাড়তে থাকবে বিশ্বের তাপমাত্রা এবং আগামী ৬০ বছর পর গড় তাপমাত্রা বাড়বে ১ দশমিক ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস, তারপর তা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে। আর বর্তমানে যে হারে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৬০ সালের মধ্যে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বাড়বে ২ ডিগ্রী সেলিসিয়াস এবং এই শতাব্দীর শেষ নাগাদ তা পৌঁছাবে ২ দশমিক ৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। প্রাকৃতিক কারণেই জলবায়ুতে স্বাভাবিকভাবে কিছু পরিবর্তন হয়। কিন্তু যে মাত্রায় এখন তাপমাত্রা বাড়ছে তার জন্য মানুষের কর্মকা-ই প্রধানত দায়ী। মানুষ যখন থেকে কল-কারখানা এবং যানবাহন চালাতে বা শীতে ঘর গরম রাখতে তেল, গ্যাস এবং কয়লা পোড়াতে শুরু করল সেই সময়ের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা এখন ১.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বায়ুম-লে অন্যতম একটি গ্রিন হাউজ গ্যাস-কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ঊনবিংশ শতকের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। গত দুই দশকে বেড়েছে ১২ শতাংশ। বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণেও বায়ুম-লে গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে। গাছপালা কার্বন ধরে রাখে। কিন্তু সেই গাছ যখন কাটা হয় বা পোড়ানো হয়, তখন সঞ্চিত সেই কার্বন বায়ুম-লে নিঃসরিত হয়। পৃথিবীর ভবিষ্যত নিয়ে জাতিসংঘের ‘রেড-এ্যালার্ট’ জারি করেছে। জাতিসংঘের একটি বিজ্ঞানী প্যানেল হুঁশিয়ার করে বলেছেন, মানুষের নানা কর্মকা-ের পরিণতিতে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এখন দ্রুত হারে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে এবং বরফ গলছে। বরফের আচ্ছাদন বিলীন হওয়ার কারণে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। যার ফলে, পরিস্থিতি দিনকে দিন বিপজ্জনক হয়ে পড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে পুরো বিশ্বের প্রাণিজগতের ওপর। ফলে জীবজন্তুর বিভিন্ন প্রজাতি তাদের আবাসস্থল বদলাচ্ছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে আমাদের ব্লু-প্ল্যানেট অর্থাৎ পৃথিবী এখন মহাসঙ্কটে। এই সঙ্কট তৈরির জন্য পৃথিবীর মানুষই দায়ী। সবচেয়ে বেশি দায়ী উন্নত দেশগুলো। যাদের ভোগবিলাস আর উন্নত জীবনযাপনের জন্যই পৃথিবীর এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এখন এর সমাধান মানুষকেই করতে হবে। এখানে মানুষ বলতে উন্নত দেশের নেতৃবৃন্দকেই এই মহাসঙ্কট সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। বিলম্বে হলেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এখন অনুধাবন করছেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছে গেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধির কারণেই পৃথিবীতে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে, এই উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস হলে তার পরিণাম কী ভয়াবহ হবে? এ কারণে বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে দেখিয়েছেন যে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে ২০৫০ সালের মধ্যেই ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। এ জন্যই এবারের সম্মেলন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশ মিলে ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে পৃথিবীকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যা পারিস জলবায়ু চুক্তি নামে পরিচিত। সিদ্ধান্তটি ছিল, শিল্প-বিপ্লব পূর্ববর্তী পৃথিবীর যে তাপমাত্রা ছিল তার চেয়ে ১.৫ ডিগ্রী বা বড়জোর ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা বাড়তে দেয়া যাবে না। এ জন্য ওই চুক্তিতে সব দেশ অঙ্গীকার করেছিল, ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনবে। ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে সব দেশই মেনে নেয় যে এটা না করতে পারলে পৃথিবী এবং মানবসভ্যতা মহা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। প্যারিস চুক্তির পর পুরো জলবায়ু আলোচনাই গাতি হরিয়ে ফেলে। এর কারণ মার্কিন প্রশাসনে পরিবর্তন। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিশ্ব নেতাদের মধ্যে একটি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পরের বছরই মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি ক্ষমতায় আসায় সেই আগ্রহে ভাটা পড়ে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো এক ব্যবসায়ী ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় জলবায়ু আলোচনায় হতাশার মাত্রা আরও বেড়ে যায়। কারণ নির্বাচনের আগেই বলে আসছিলেন জলবায়ু পরিবর্তন তিনি বিশ্বাস করেন না এবং বিজয়ী হলে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যাবে। ঘটেছেও তাই। নির্বাচনের পর বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ কার্বন নির্গমনকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়। ফলে প্যারিস চুক্তির অঙ্গীবার বাস্তবায়ন দূরের কথা পুরো জলবায়ু আলোচনাই থমকে দাঁড়ায়। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরে বৈশ্বিক উষ্ণতা আরও বৃদ্ধি পেয়ে সার্বিক জলবায়ু পরিবর্তন পারিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। যার নজির পৃথিবী বাস্তবে দেখছে। জাতিসংঘ এবং আইপিসিসির প্রতিবেদনগুলোতেও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ানক অবনতির চিত্র উঠে এসেছে। মার্কিন প্রশাসনে ডেমোক্র্যাটদের ফিরে আসায় জলবায়ু আলোচনায় আবার গতি পেয়েছে। ক্ষমতায় এসেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে বিশ্বকে রক্ষার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে নিয়ে লিডার্স সামিটের আয়োজন করেন। বাইডেন প্রশাসন নিজে থেকেও জলবায়ু পরিবর্তন রোধ ও পরিবেশ রক্ষায় বেশ কিছু কর্মসূচী গ্রহণ করেন। এতে জলবায়ু আলোচনা নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়। ফলে গত প্রায় এক বছর ধরে জাতিসংঘসহ প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফোরামেই জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুটি আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে। (বাকি অংশ আগামীকাল সমাপ্য) লেখক : সাংবাদিক
×