ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম -সামাজিক পুনর্বাসনে মহানবী (সা.)-এর ভ্রাতৃ কর্মসূচী

প্রকাশিত: ২০:০৬, ২২ অক্টোবর ২০২১

প্রসঙ্গ ইসলাম -সামাজিক পুনর্বাসনে মহানবী (সা.)-এর ভ্রাতৃ কর্মসূচী

একতা ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন : তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, তোমাদেরকে মানবকল্যাণের জন্য আবির্ভূত করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজে আদেশ দেবে অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে...।’ কুরআন শরীফে আরও ইরশাদ হয়েছে : তায়ালাউ ইলা কালিমাতিন সিওয়াইন বাইনানা ওয়া বাইনাকুম...। অর্থাৎ এসো আমরা একতার স্বার্থে কতিপয় বিষয়ে পারস্পরিক ঐকমত্য পোষণ করি...। এসব মূলনীতির মাধ্যমে আমরা ইসলামী ভ্রাতৃত্বের গুরুত্ব ও একটি রূপরেখা অনুধাবন করতে পারি। আরবীতে ভ্রাতৃত্বকে বলা হয় মুয়াখাত। ইসলামের ইতিহাসে এটি রীতিমতো একটি পরিভাষাও বটে। তবে আজ মুসলিম সমাজ কিংবা দেশগুলোর মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ কমে এসেছে। বরং পরস্পর অবিশ্বাস, কলহ এবং অন্যের প্ররোচনায় উম্মাহর চিন্তা-চেতনাকে ধ্বংস করার এক হীন ও ভ্রান্ত মন-মানসিকতার ছড়াছড়ি দেখা যায়। অথচ মুসলিম সমাজে এখনও যে মেধা ও সম্পদ রয়েছে তা যদি ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে ব্যবহৃত হতো প্রতিটি মুসলিম সমাজ আজ শান্তি ও সমৃদ্ধির দৃষ্টান্ত হতে পারত। যেমনটি ছিল মহানবী (সা.)-এর যুগের আদর্শ সমাজে। সমাজ সংস্কারে মহানবী (সা.) যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন এর মধ্যে দ্বীনি মুয়াখাত প্রতিষ্ঠা ছিল একটি। মহানবী (সা.) চিন্তা করেছিলেন, সবকিছু আইন করে নয়, বরং মানসিকতার পরিবর্তন এনে, পরস্পর সহানুভূতি-সহমর্মিতার শিক্ষা দিয়েও সমাজের অভূতপূর্ব কল্যাণের কাজে হাত দেয়া যায়। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ৬২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেছিলেন বুকভরা আশা নিয়ে। কিন্তু এ হিজরতের সময় যেসব সাহাবী ছিলেন তারা সবাই সমস্ত ধন-সম্পত্তি রেখে কোন মতে দেহটা নিয়ে মদিনায় পৌঁছতে সক্ষম হন। মদিনায় যাওয়ার পর সাহাবীদের এ নিঃস্ব অবস্থাটা মহানবী (সা.)কে বেশ চিন্তায় ফেলে দেয়। হিজরত করার পর মহানবী (সা.) দেখলেন মদিনার কিছু নও মুসলিম বিশেষত মুহাজিরদের থাকা-খাওয়ার সমস্যা প্রকট। তিনি ধনীদের এ ব্যাপারে ভ্রাতৃত্বের মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে অভাবনীয় সাড়া পড়ে। তিনি ধনীদের সঙ্গে গরিবদের, আনসারদের সঙ্গে মুহাজিরদের সুনির্দিষ্ট ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন। ফলে দেখা গেল, তিনি সমাজের আবাসন সমস্যা সমাধানে এবং সহায়-সম্বলহীন মানুষদের পুনর্বাসনে খুব দ্রুত সফলতা অর্জন করেন। ইসলামের ভ্রাতৃত্বে হজরত সা’দের এ দৃঢ় আস্থা ও অতুলনীয় উদারতার দৃষ্টান্ত তামাম মুসলিম উম্মাহ তথা মানব জাতির ইতিহাসে বিরল। অন্যদিকে হজরত আবদুর রহমানের মহত্ব, আত্মনির্ভরতা ও নিজ পায়ে দাঁড়ানোর দৃঢ় সঙ্কল্পও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সমাজের ধণিক শ্রেণী থেকে গরিব শ্রেণী মুয়াখাত বা ভ্রাতৃসুবিধা পওয়ার দরুন অভাবী মানুষগুলো খুব সহজে সমাজে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এবং শির উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ পায়। ধনীদের দেয়া সাহস, অর্থ ও ঋণ সুবিধা গরিবদের দাঁড়াবার একটি ভিত্তি রচনা করে। তাদের মনে সঞ্চার হয় নয়া আশা, নয়া স্বপ্নের। নবী (সা.) ও তাঁর মহান সাহাবাদের জীবনে আমরা দেখি ভ্রাতৃত্বের সুবিধা পাওয়াতে অভাবী লোকগুলো কখনও অতি লোভ লালসা পোষণ করতেন না। তারা চাইতেন অন্যের আশীর্বাদ আর সাহস জোগানোর ভেতর নিজেকে কঠিন পরিশ্রমী হিসেবে প্রদর্শন করে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াবার শক্তি সঞ্চয় করতে। ধনীদের সম্পদে অভাবী দুস্থ মানুষের অধিকারের ঘোষণা দানের সঙ্গে সঙ্গে মহানবী (সা.) এও ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, উপরের হাত নিচের হাত হতে উত্তম। অর্থাৎ কারও কাছে হাত পেতে ভিক্ষা করার চেয়ে কাউকে দান করার যোগ্যতা অর্জন করা হলো বড় কথা। এভাবে রাসূলে মাকবুল (সা.) সমাজে একটি অর্থনৈতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত ধনীরা যেমন মুসলিম ভাইদের উদ্দেশ্যে অকাতরে দান করার ইচ্ছা পোষণ করতেন তেমনি অভাবগ্রস্ত সাহাবীগণ চাহিদা ও প্রয়োজনকে খুব সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতেন। ইসলামের হুকুমÑআহকাম, বিধিবিধানগুলোর মাধ্যমে বারে বারে উম্মাহর শিক্ষা ও দর্শনের দিকে ধাবিত করা হয়েছে। যেমন কালেমায়ে তাইয়্যেবার মাধ্যমে ইসলাম চায় মানুষের সমুদয় প্রভুত্ব, বিভেদ দূরীভূত করতে, অভিন্ন চিন্তা-চেতনা মনমানসিকতা ও আদর্শগত আভিজাত্যে উজ্জীবিত করতে। জামায়াতে নামাজ আদায়ের তাগিদ দেয়ার মাধ্যমে ইসলাম চায় সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর মানুষকে একই কাতারে শামিল করতে এবং পারস্পরিক সুবিধা-অসুবিধাসমূহ সহমর্মী ভাইবোনদের কাছে প্রকাশ করতে। রোজার মাসে রাখা হয়েছে সম্মিলিত দহন ও সহন অনুভব-অনুভূতি সৃষ্টি করতে, ইফতারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সময়ের গুরুত্ব ও অন্যকে কাছে টানার শিক্ষায় উজ্জীবিত এবং সবশেষে পবিত্র হজের আনুষ্ঠিকতার মাঝে নিহিত রাখা হয়েছে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, বিশ্ব মানবাধিকারের শিক্ষা, বিশ্ব শান্তির শিক্ষা সর্বোপরি পরকালীন পোশাকে নিষ্পাপ জীবন ধারণের অনুশীলন ও শপথ। ১০ম হিজরীতে এমনি একটি প্রতীকী হজের মৌসুমে আরাফাত ময়দানের বাতনে ওয়াদী নামক স্থানে কাসওয়ার পিঠে দঁাঁড়িয়ে সফল মহাসংস্কারক হুজুরে আকরাম (সা.) ঘোষণা করেছিলেন : সাবধান হে মানুষেরা তোমাদের পিতা এক, তোমরা এক আদমের সন্তান, আর আদম (আ.) মাটি থেকে সৃষ্টি। নিশ্চয়ই প্রত্যেক মুসলমান একে অপরের ভাই আর সকল মুসলমান এক অখন্ড ভ্রাতৃ সমাজ।’ - (ভাষণের অংশ বিশেষ)। বস্তুতপক্ষে মহানবীর (সা.)-এ নির্দেশনামা তাঁর সাহাবায়ে কেরাম পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তির সঙ্গে অনুসরণ করেছেন। শুনলে বাস্তবিকই বিস্ময় লাগে, ভ্রাতৃ সম্বন্ধের ওপর নির্ভর করে মদিনার আনসারগণ নিজেদের জমিজমা , ধন-দৌলত ও ঘরবাড়ি সমস্তই নতুন ভাইদের উদ্দেশে বণ্টন করেছিলেন। মুহাজিরগণ কৃষিকর্ম জানতেন না বলে আনসারগণ নিজেরাই তাদের অংশের জমিজমা চাষবাস করে ফসল উৎপন্ন করে দিতেন, মুহাজিরগণ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে যা উপার্জন করতেন তারও ন্যায্য অংশ দিতে লাগলেন তাদের মাদানী আনসার ভাইদের। কারও মৃত্যু ঘটলে তার ‘ধর্ম ভাই’ রীতিমতো হিস্যা পেতে লাগলেন। (বিশ্বনবী : ১৯০)। অথচ আজকাল নিজ ভাইদের মাঝে সুষ্ঠু মনমানসিকতার অভাবে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিরোধের অন্ত নেই। জমিজমা নিয়ে হাঙ্গামা তো লেগেই আছে। উল্লেখ্য, আনসার-মুহাজির সমস্যা যে মক্কা মদিনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। মানব গোষ্ঠীর এ এক চিরন্তন সমস্যা। যুগে যুগে প্রত্যেক জাতিই এরূপ সমস্যার সম্মুখীন হয়। রাজনৈতিক বিপ্লবের ফলে এক দেশের অধিবাসী আরেক দেশের স্বজাতীয় ভাইদের স্মরণ নিতে বাধ্য হয়। আনসার-মুহাজির সমস্যা তখনই জেগে ওঠে। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব [email protected]
×