ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

সম্প্রীতির বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১৯:৫৪, ২২ অক্টোবর ২০২১

সম্প্রীতির বাংলাদেশ

সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নিয়ে কোন ভেদাভেদ নেই। সবাই যার যার ধর্ম পালন করতে পারবে। কেউ কোন বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র কখনই তার নাগরিকদের মধ্যে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ ও জন্মস্থান ভেদে কোন প্রকার বৈষম্য করবে না। এ জন্যই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এরকম সুন্দর পরিবেশের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেছে এবং বাংলাদেশকে সম্প্রীতির রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এ দেশের মুক্তিযুদ্ধেও সকল ধর্ম, বর্ণের মানুষ অংশগ্রহণ করেছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ রক্ষার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে শত্রুর বিরুদ্ধে। পাক বাহিনী ও তার রাজাকার-আলবদর দোসররা যখন হিন্দুদের দেখে দেখে মেরে ফেলছিল, তখন মুসলিমরাই তাদের নিজের ঘরে আশ্রয় দিয়েছে। এভাবেই সম্প্রীতির মায়াবী বন্ধনে বাংলাদেশের মানুষ আবহমানকাল থেকেই আবদ্ধ। বিশ্বের সকল সৃষ্টির স্রষ্টা একজন। মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা জীব। প্রতিটি মানুষই সৃষ্টির সেরা এবং সে যে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠীর মানুষই হোক না কেন। তাই মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ কাম্য নয়। প্রতিটি মানুষেরই উচিত সবার সঙ্গে সদাচার করা এবং পারস্পরিক সম্মান বজায় রাখা। এ দুনিয়ার সকল জীবকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। কোন মানুষই চিরকাল বেঁচে থাকবে না। এই অতি অল্প সময়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ এবং একজনের ভুলের জন্য অন্যজনকে দোষারোপ করা থেকে দূরে থাকতে হবে। দেশে ক্ষুদ্রভাবে যেসব সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেসব দুষ্কৃতকারী এ ধরনের জঘন্য ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাদের আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ করার সাহস না পায়। এছাড়াও শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। যাতে ধর্মীয় সম্প্রীতিসহ বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠীগত কোন ভেদাভেদ না থাকে, সেই শিক্ষা দেয়া হয়। দেশব্যাপী সরকারিভাবে কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামে গ্রামে ছোট ছোট বৈঠকের মাধ্যমে সুন্দরভাবে অসাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। কোন ধর্মেই যে ধর্মীয়ভাবে অন্য ধর্মের অনুসারীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই বা উগ্রতার সুযোগ নেই, তা রেফারেন্সসহ বুঝিয়ে দিতে হবে। সকল ধর্মের ধর্মীয় উপাসনালয়ে এ ব্যাপারে শিক্ষা দেয়ার কথা বলে দিতে হবে এবং পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে উসকে দিচ্ছে অপকর্ম করার জন্য, তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। যারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ধর্ম নিয়ে কথা বলবে তারা যেন সঠিকভাবে রেফারেন্স দিয়ে কথা বলে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিতে হবে। বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার করে সম্প্রীতি রক্ষায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। কারণ, অল্প কিছু দুষ্কৃতকারী কিছু অজ্ঞ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে অন্যর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে, এগুলো বন্ধ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যাতে কেউ উসকানি না দিতে পারে, সে ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সম্প্রতি কুমিল্লায় পবিত্র কোরান অবমাননা করা হয়েছে- এরকম একটি গুজব ছড়িয়ে এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষ দেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কঠোর পদক্ষেপে তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এ দেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী দেশ। সাংবিধানিকভাবে যে যার ধর্ম নিশ্চিন্ত মনে পালন করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কেউ সংখ্যালঘু নয়, সবাই বাংলাদেশের নাগরিক।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বদাই ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে ছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে এটা নয় যে, কোন ধর্ম কেউ পালন করতে পারবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র ব্যাখ্যা প্রদান করতে গিয়ে তিনি বলেন- ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দেবার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে বেইমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে; আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি।’ প্রতিটি ধর্মেই অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা করার কথা বলেছে। কোন ধর্মেই সহিংসতা, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদের কোন স্থান নেই। আমাদের এই দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঁধনে আবদ্ধ। এখানে কোনরূপ সন্ত্রাস ও জনজীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত কোন অপশক্তির স্থান নেই। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের দৃষ্টান্তই আমরা লক্ষ্য করে আসছি। আসলে কে কোন্ ধর্মের অনুসারী তা মূল বিষয় নয়, বিষয় হলো আমরা সবাই মানুষ। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই এক জাতি। বিদ্রোহী ও অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল জাতি ধর্ম, বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের উর্ধে ছিলেন। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করতেন। কোন ধর্মের বিচারে কাউকে এগিয়ে রাখতেন না। তাই তো তিনি লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান,/যেখানে মিশেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রীস্টান।’ তিনি লিখেছিলেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান/নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,/সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় কোন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন। কোন ধর্মেই যে সহিংসতার কথা নেই, সে ব্যাপারে তারা ধারণা রাখে। যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা প্রদান করে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসে লিপ্ত হচ্ছে, তাদের এ দেশের মানুষ বরদাশত করবে না। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রীতি রক্ষায় সর্বদা বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ যখন বিশ্বসভায় একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ঠিক সে সময়ে একটি চিহ্নিত মহল পরিকল্পিতভাবে দেশে সাম্প্রদায়িক হানাহানি সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। সরকার ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করেছে। ইতোমধ্যে অনেকেই গ্রেফতার হয়েছে এবং বাকিদেরও আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এছাড়াও তিনি আর দল আওয়ামী লীগের সকল নেতাকর্মীকে দেশে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির তৎপরতা প্রতিরোধ করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। যে কোন মূল্যে বাংলাদেশের হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য সমুন্নত রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য নিয়ে এ দেশে বসবাস করবে, এটাই সবার প্রত্যাশা। লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×