ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চোখ গেল আজমিরের

প্রকাশিত: ১৯:৫২, ২২ অক্টোবর ২০২১

চোখ গেল আজমিরের

চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় ৫ বছরের আজমিরের ডান চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে গেল। ঢাকার ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা তথা কর্নিয়া অস্ত্রোপচারের পরেও ফেরানো গেল না আজমিরের দৃষ্টিশক্তি। বিশেষজ্ঞ চক্ষু চিকিৎসকরা বলে দিয়েছেন, আজমির আর কোন দিন দেখতে পারবে না ডান চোখে। শিশুটির বাবার ভাষ্যে জানা যায়, ১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনে ডোমার থেকে সৈয়দপুরে ফিরছিল আজমির। স্টেশনের কাছেই পুরনো মুন্সীপাড়ায় তাদের বাসা। সৈয়দপুর রেল স্টেশনে হোম সিগন্যালের কাছে হঠাৎ বাইরে থেকে ছুড়ে মারা পাথর আঘাত হানে আজমিরের চোখে। রক্ত ঝড়তে থাকে অবিরত। রেলওয়ে পুলিশের সহায়তায় সৈয়দপুর ১০০ শয্যার হাসপাতাল, রংপুুর মেডিক্যাল কলেজ সবশেষে ঢাকার বিখ্যাত ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অস্ত্রোপচার করেও বাঁচানো গেল না শিশুটির চোখ। অতঃপর প্রশ্ন, এই অপরাধ ও অপঘাতের দায় নেবে কে? সামান্য হ্যাচারি ব্যবসায়ী আজমিরের বাবা-মায়ের এখন শুধুই বুক ফাটা কান্না। কি হবে শিশুটির ভবিষ্যত? মাত্র একটি চোখের দৃষ্টিশক্তি নিয়ে দীর্ঘ অনিশ্চিত জীবনে কতদূর যেতে পারবে পাঁচ বছরের শিশু আজমির? দুঃখজনক হলো ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা চলছেই। বরং আরও বেড়েছে ইদানীং। ২৫ সেপ্টেম্বর রাত ৯টায় রাজশাহী থেকে গোপালগঞ্জে ট্রেনে আসছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামান্না তন্বী। বোয়ালমারী স্টেশন অতিক্রমের সময় ঘটে পাথর নিক্ষেপের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। মাথায় মারাত্মক আহত তন্বী জীবন মৃত্যু সন্ধিক্ষণে লড়েছে গোপালগঞ্জ সদর হাসপাতালে। চলন্ত ট্রেনে পাথর, ইটপাটকেল অথবা অন্যবিধ বস্তু নিক্ষেপের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। তবে ইদানীং এর উৎপাত-উপদ্রব বেড়েছে বহুলাংশে। গত ৫ বছরে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ২ হাজারেরও বেশি। আহত হয়েছেন শতাধিক। এমনকি মৃত্যুর খবরও আছে। ২০১৩ সালে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপে নিহত হন প্রকৌশলী প্রীতি দাশ নামের এক নারী। চলতি বছর ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে ১১০টি। আহত হয়েছেন ২৯ জন। যার মধ্যে রয়েছেন রেলের কর্মচারীও। ট্রেনের জানালা ভেঙ্গেছে ১০৩টি। যেগুলোর মেরামতে রেলের খরচ হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। বিভিন্ন সময়ে তদন্ত কমিটি গঠনসহ সুপারিশ সত্ত্বেও তেমন শাস্তি বা সাজা পাওয়ার ঘটনা নেই বললেই চলে। রেল কর্তৃপক্ষ দেশের ১৬টি জেলার ৭৫টি স্পট চিহ্নিত করেছে, যেসব স্থানে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। তবে এর বাইরেও সারাদেশে সুবিস্তৃত ২ হাজার ৯শ’ কিলোমিটার রেলপথের অন্যত্রও যে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটবে না এর কোন নিশ্চয়তা নেই। ফলে বিষয়টি রেল কর্তৃপক্ষকে রীতিমতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছে। চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের অপরাধে ১৮৯০ সালের আইনে ১২৭ ধারায় ১০ হাজার টাকা জরিমানা, যাবজ্জীবন কারাদ- এবং মৃত্যু হলে ৩০২ ধারায় ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। তবে এ পর্যন্ত তেমন সাজা পায়নি কেউ। অধিকাংশ পাথর নিক্ষেপকারী শিশু-কিশোর, ভবঘুরে, মাদকাসক্ত ও চোরাচালানকারি। চলন্ত ট্রেন থামিয়ে এদের ধরাও মুশকিল। সে অবস্থায় রেল কর্তৃপক্ষ সবিশেষ গুরুত্বারোপ করছে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপর। কাচের জানালার বাইরে ধাতব তারের বহিরাবরণও লাগানো যেতে পারে। স্থানীয় জনসাধারণেরও এক্ষেত্রে সবিশেষ দায়িত্ব ও করণীয় রয়েছে। এর বাইরেও ইদানীং ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-চট্টগ্রামের লাইনে উৎপাত বেড়েছে ঠগীদের, যারা রেললাইনের ছাদে যাত্রীদের প্রলোভিত করে নিয়ে গিয়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে অথবা ছুরি-চাপাতি দিয়ে হত্যা করে কেড়ে নেয় সর্বস্ব। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি তো রয়েছেই। রেল পুলিশের এসব ক্ষেত্রে সবিশেষ দায়িত্ব রয়েছে নিরাপত্তা বিধানের। যে কোন উপায়ে বন্ধ করতে হবে চলন্ত ট্রেনে পাথর-ইটপাটকেল নিক্ষেপের মতো ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর খেলা, যা মূলত শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।
×