ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শাকিল আহমেদ মিরাজ

শিরোপা তুমি কার?

প্রকাশিত: ০০:২৪, ২০ অক্টোবর ২০২১

শিরোপা তুমি কার?

গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট। যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে রহস্য। তাই তো যুগ যুগ ধরে ব্যাট-বলে দ্বৈরথের আবেদন এতটুকো কমেনি। বরং সংক্ষিপ্ত ফরমেটের টি২০’র প্রচলনে আকর্ষণ আরও বেড়েছে, বেড়েছে উন্মাদনা। শেষ বলের আগে যেমন বলা যাচ্ছে না কোন দল জিতবে, অনুমান করা যাচ্ছে না কারা জিতবে শিরোপা? তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, টি২০ মাস্ল নির্ভর পাওয়ার ক্রিকেটের খেলা। তাই তো হিসেবের বাইরে থেকেও গত ছয় বিশ্বকাপে দুইবার চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০১২, ২০১৬)। যে দেশের বোর্ড তাদের ক্রিকেটারদের ঠিক মতো বেতন দিতে পারে না, অন্যদের থেকে ধার করে চলতে হয়! অথচ অর্থ, প্রতিপত্তি সব দিক দিয়ে বিশ্বকে শাসন করা ভারত ২০০৭ সালে প্রথম বিশ্বকাপজয়ের পরই বড় প্রজেক্ট হাতে নিয়ে আইপিএলের প্রচলন করে। দুনিয়ার সব পাওয়ার ক্রিকেটারের পসরা সাজিয়ে বসা মোড়ল দেশ তবু আর ট্রফি পুনরুদ্ধার করতে পরেনি। গত অর্ধ যুগে আইপিএলে তাদের কত শত ধুন্ধুমার ক্রিকেটার এলো-গেল, কিন্তু আসল কাজটাই হলো না! এই বিশ্বকাপের (সপ্তম) আয়োজক ভারত। ইতিহাসের ‘সেরা’ আয়োজনের আগাম ঘোষণা দিয়েছিলেন বোর্ড (বিসিসিআই) প্রেসিডেন্ট সৌরভ গাঙ্গুলী। প্রথমেই ধাক্কা খায় কিংবদন্তি ক্রিকেটারের সেই ইচ্ছা। করোনার কারণে মধ্যপথে বন্ধ হয়ে যাওয়া আইপিএলের বাকিং অংশ এবং বিশ্বকাপ দুটিই সরে যায় মরুর দেশ আরব আমিরাত ও ওমানে (সহ-আয়োজক)। আয়োজনের দায়িত্ব অবশ্য আছে ভারতের হাতে। আইপিএল শেষ হওয়ার একদিন পরই মাঠে গড়িয়েছে বিশ্বকাপ। চতুর সৌরভ এটাও পরিকল্পনা করেই করেছেন। যাতে প্রস্তুতির চরম শিখরে থেকে মাঠে নামতে পারে বিরাট কোহলি ও তার দল! হারানো শিরোপা পুনরুদ্ধারের মিশনে নামছে দলটি, যে মঞ্চ আবার অধিনায়ক কোহলির শেষও। আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, এ বিশ্বকাপ শেষেই দলটির টি২০ অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেবেন। সুপার উইলোবাজ কি পারবেন নিজ অধিনায়কত্বে প্রথম ও শেষ বিশ্বমঞ্চে ভারতকে হারানো গৌরব ফিরিয়ে দিতে? দু’দুটি বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনিকে (২০০৭ টি২০, ২০১১ ওয়ানডে) এবার মেন্টর হিসেবে পাশে পাচ্ছেন তিনি। টস করতে নামবেন কোহলি, ডাগআউট থেকে ইনিংসের শুরুতে-মাঝপথে টোটকা দেবেন ধোনি, এমন কিছু যেন ভারতীয় সাফল্যের রেসিপিই! ভারতীয় দলে আছেন বেশ কিছু টি২০র জন্য মানানসই পারফর্মার, যা দলটির শক্তি হিসেবেই বিবেচ্য। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, লোকেশ রাহুলরা বিশ্বের যে কোনো টি২০ দলে অনায়াসে ঢুকে যেতে পারেন। স্পিন আক্রমণে বৈচিত্র্যও বড় একটা সুবিধা বয়ে আনবে দলটির জন্য। সঙ্গে যোগ করুন মোহাম্মদ শামি, যশপ্রীত বুমরাহ, ভুবনেশ্বর কুমারদের মতো অভিজ্ঞ পেসারদের। এই দল ফেভারিট না হয়ে যায় কোথায়! তবে শক্তির পাশাপাশি দলের দুর্বলতাও বুঝি ব্যাটিং লাইনআপই। প্রতিভাবান হলেও মিডল অর্ডার যে এখনও দলটাকে কাক্সিক্ষত ভরসাটা দিতে পারেনি! ইষান কিশান, হার্দিক পান্ডিয়া, ঋষভ পন্থ, রবীন্দ্র জাদেজারা সবাই নিজেদের দিনে প্রতিপক্ষকে দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারবেন বটে, কিন্তু নির্দিষ্ট একটা ভূমিকায় দলে একটা বড় সময় ধরে খেলার সুযোগ পাননি কেউ, ফলে এ একটা জায়গায় দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে ভারতের। বিশ^ ক্রিকেটে পাকিস্তান এমন এক দল যাদের কখনোই হিসাবের বাইরে রাখা সম্ভব নয়। তার ওপর এবারের টি২০ বিশ^কাপ আমিরাতে। গত প্রায় দশ বছর নিজেদের দিপক্ষীয় সিরিজগুলো তারা এখানেই খেলে এসেছে। শারজাহ, দুবাই, আমিরাত- প্রতিটি মাঠ তাদের ভালমতো চেনা, ‘আমিরাতে আমরা প্রচুর ক্রিকেট খেলছি, এখানকার কন্ডিশন, উইকেটের আচরণ কেমন হবে এবং ব্যাটসম্যানদের কিভাবে মানিয়ে নিতে হবে আমরা তা ভালভাবে জানি। অধিনায়ক হিসেবে এটি আমার প্রথম আইসিসির বৈশ্বিক কোন টুর্নামেন্ট। এর আগে খেলোয়াড় হিসেবে ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সাফল্য পেয়েছি, ২০১৯ বিশ্বকাপে হতাশ হয়েছি, দুই ফাইনালিস্টকে লীগ ম্যাচে হারানোর পরও আমরা সামান্য পয়েন্টের জন্য সেমিতে উঠতে পারিনি। এবার পারর্মেন্স দিয়ে দলকে অনুপ্রাণিত করতে চাই, লক্ষ্য যেন এশিয়ায় আইসিসির মেজর ট্রফিজয়ী প্রথম পাকিস্তান দল হতে পারি।’ বলেন অধিনায়ক বাবর আজম। শাদাব খান, ফখর জামান, ইমাদ ওয়াসিম, মোহাম্মদ হাফিজ, শোয়েব মালিক, মোহাম্মদ রিজওয়ান, শাহিন শাহ আফ্রিদি, হাসান আলিদের নিয়ে গড়া পাকিস্তান দল সত্যি ভয়ঙ্কর। ২০০৯ সালের পর শিরোপা পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব এবার বাবরের কাঁধে। ২৪ তারিখ দুবাইয়ে চিরপ্রতিদ্ব›দ্বী ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু পাকিস্তানের বিশ^কাপ মিশন। কোন ফরমেটের ক্রিকেটেই বিশ^কাপে এখন পর্যন্ত ভারতকে হারাতে পারেনি পাকিস্তান, ‘ভারতের বিপক্ষে বলে নয়, বিশ^কাপে প্রথম ম্যাচ যেকোন দলের জন্যই তীব্র চাপের। নির্দিষ্ট দিনে যারা ভাল ক্রিকেট খেলবে তারাই জিতবে। আমার কাছে যদি জানতে চান, বলব আমরাই জিতব।’ যোগ করেন বাবর। গত কয়েক দশক ধরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট তলানির দিকে। আর্থিক সঙ্কট, মাঠ ও মাঠের বাইরে খেলোয়াড়দের সঙ্গে বোর্ডের দ্ব›দ্ব। তারকা ক্রিকেটারদের অনেকের দেশের খেলা বাদ দিয়ে বিদেশী ঘরোয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগে অংশগ্রহণ। এমনি হাজারও সমস্যা লেগেই আছে। টেস্ট-ওয়ানডেতে দলটির অবস্থান নিচের সারিতে। অথচ টি২০ বিশ্বকাপে সাফল্য ঈর্ষণীয়। ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে আয়োজক লঙ্কানদের হারিয়ে প্রথম ট্রফি জেতে ড্যারেন সামির ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সর্বশেষ ভারতে অনুষ্ঠিত ২০১৬ সালের ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে এক আসর পরই ট্রফি পুনরুদ্ধার করে ক্যারিবীয়রা। গতবারও নেতৃত্ব দেন সামি। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নদের নেতৃত্ব ভার এবার কাইরন পোলার্ডের ওপর। রোমাঞ্চ নিয়ে অপেক্ষায় আছেন বিগ ম্যান পোলার্ড, ‘শিরোপা ধরে রাখার লক্ষ্যে মাঠে নামতে অধীর হয়ে আছি। টি২০ ক্রিকেট দারুণ রোমাঞ্চকর আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তো এটা খুবই প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ, ক্রিকেটাররা প্রতিনিয়ত উদ্ভাবনের সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে দর্শনীয় একটি আসরের আশা করছি।’ বলেন ক্যারিবীয় অধিনায়ক। আছেন ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেল, ডোয়াইন ব্রাভোর মতো পারফর্মার। রঙিন পোশাকে ধারাবাহিক উন্নতিকে হাতিয়ার করে ইয়ন মরগানের নেতৃত্বে ইংল্যান্ডও ২০১০-এর পর শিরোপা পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখছে। যারা ২০১৬ সর্বশেষ টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডজের সঙ্গে পেরে ওঠেনি, তবে ২০১৯-এ ঘরের মাটিতে ওয়ানডের শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়ে মরগান-বাহিনী। ‘প্রায়’ চেনা কন্ডিশনে এশিয়ান ক্রিকেটের উদীয়মান শক্তি আফগানিস্তান এবং ২০১৪-এর চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাকে নিয়েও আগাম মন্তব্য সম্ভব নয়। খেলাটা যেহেতু ২০ ওভারের অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দ.আফ্রিকাকেও কী হিসাবের বাইরে রাখা যায়! ২০০৭ সালে দ.আফ্রিকায় বসেছিলো আইসিসির টি২০ বিশ্বকাপের প্রথম আসর। জোহানেবার্গের ফাইনালে চিরপ্রতিদ্ব›দ্বী পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল ধোনির ভারত। পাকিস্তান সেই দুঃখ ভুলেছিল পরের আসরেই, ইংল্যান্ডে ২০০৯ সালে। লন্ডনে দ্বিতীয় আসরের ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে ৮ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ইউনুস খানের দল। ওয়েস্ট ইন্ডিজে অনুষ্ঠিত ২০১০ তৃতীয় আসরে অস্ট্রেলিয়াকে ৭ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জেতে পল কলিংউডের ইংল্যান্ড। কলম্বোয় ২০১২ সালে আয়োজক শ্রীলঙ্কাকে কাঁদিয়ে ট্রফি নিয়ে ফেরে ড্যারেন সামির ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশে পরের আসরেই অবশ্য ভারতকে হারিয়ে কষ্ট ভুলেছিল লাসিথ মালিঙ্গার দল। মিরপুরের ফাইনালে তারা ভারতকে হারায় ৬ উইকেটে। ২০১৬ সর্বশেষ ষষ্ঠ আসরেও পারেনি আয়োজক ভারত। কলকাতার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ৪ উইকেটে হারিয়ে এক মৌসুম পরই শিরোপা পুনরুদ্ধার করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
×