ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রতিবাদ প্রতিরোধ চলছে

সাম্প্রদায়িক হামলা নয় শুধু- মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কুঠারাঘাত

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ২০ অক্টোবর ২০২১

সাম্প্রদায়িক হামলা নয় শুধু- মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কুঠারাঘাত

জনকণ্ঠ ফিচার ॥ আবারও বড়সড় ধাক্কা। আবারও প্রশ্নেরমুখে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবিকতার বোধ নিয়ে কত না চর্চা এখানে। হঠাৎই যেন সব থমকে গেল। দুর্গোৎসবের মধ্যেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরে হামলা, ভাংচুর। কোথাও কোথাও বাড়ি-ঘর- ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন। এমন বর্বর আক্রমণের ঘটনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানবিক মানুষদের লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। গøানি ঘৃণা হতাশা ভর করেছে তাদের মনে। তবে যখনই আঘাত এসেছে তখনই দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাঙালী। এবারও এর ব্যতিক্রম ঘটছে না। সাম্প্রদায়িক হামলার বিরুদ্ধে সারাদেশেই চলছে প্রতিবাদ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা গর্জে উঠেছে। গত কদিনের মতো মঙ্গলবারও আলাদা আলাদা মঞ্চ থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে। বিশেষ এবং ব্যতিক্রমী আয়োজন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এদিন অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে নাটকের ভাষায় সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদ জানানো হয়। এতে অংশ নেন থিয়েটার এ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের একদল শিক্ষার্থী। নাট্যায়োজন হলেও এর মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক হামলার যে বীভৎস রূপ ফুটে ওঠে তাতে স্তম্ভিত না হয়ে পারা যায় না। পরিবেশনাটির মুখ্য তত্ত¡াবধায়ক তানভির নাহিদ খান বলেন, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ নয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। অথচ আজ হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়া হয়েছে। দেশকে বাঁচাতে হলে এই হামলা, সহিংসতা, উগ্র-ধর্মান্ধ আচরণকে প্রশ্রয় না দিয়ে যার যার অবস্থান থকে প্রতিহত করার আহ্বান জানান তিনি। বিভাগের চেয়ারম্যান আশিকুর রহমান লিয়ন বলেন, মানুষ হিসেবে, সচেতন নাগরিক হিসেবে এবং সর্বপরি শিল্পী হিসেবে দেশ ও মানবতার স্বার্থে আমাদের বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয়। এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে নতুন করে জেগে ওঠার আহ্বান জানাই আমরা। বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহমান মৈশান বলেন, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, এথনিক জাতীয়তাবাদ ও বুর্জোয়া শ্রেণীবাদ সবই মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শের পরিপন্থী। এ দেশে একজন মুসলমান ঠিক যতটুকু বাঁচার অধিকার রাখে, একজন হিন্দুও ততটুকুই অধিকার রাখে। এই দেশ যেমন মুসলমানের, তেমনি হিন্দুর, সাঁওতালেরও। বহু জাতি ও ধর্মের বাংলাদেশকে বীভৎস সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদ থেকে রক্ষার জন্য সবাইকে একসঙ্গে আওয়াজ তোলার আহ্বান জানান তিনি। পরিবেশনার সময় বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইসরাফিল সাহিন, ড. সাইদুর রহমান লিপন, মোহাম্মদ আহসান খান এবং নাভেদ রহমানসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। একই দিন আক্রান্ত চৌমুহনী এলাকা পরিদর্শনে যান সাংস্কৃতিক জোটের একটি প্রতিধি দল। জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ছাড়াও প্রতিনিধি দলে ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দীন ইউসুফ, লেখক প্রাবন্ধিক মফিদুল হক, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট ও পথনাটক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহাম্মদ গিয়াস। সকালে টিএসসি থেকে যাত্রা শুরু করে দুপুরের পর ঘটনাস্থলে পৌঁছান তারা। সেখান থেকে মানজার চৌধুরী সুইট জানান, চৌমুহনীতে যে বর্বর আক্রমণ করা হয়েছে তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আমরা পুড়ে যাওয়া বাড়ি-ঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঘুরে ঘুরে দেখেছি। বাতাসে এখনও পুড়া গন্ধ। আক্রান্তদের চোখে জল। সব দেখে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেছে আমাদের। বিকেলে সেখানে একটি প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তৃতা করেন সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা। তারা বলেন, এ আক্রমণ শুধু হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপরে নয়, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের ওপর। তাই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তারা। আক্রান্তদের আশ্বস্ত করে তারা বলেন, আমরা আপনাদের পাশে আছি। যে কোন মূল্যে বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তিকে রুখা হবে। ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে দুঃখ প্রকাশ করছেন। গত সোমবার নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক পেজে আক্ষেপ করে ক্রিকেট তারকা ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা লিখেছেন, ‘কাল দুইটা হার দেখেছি, একটা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের, যেটায় কষ্ট পেয়েছি। আর একটি পুরো বাংলাদেশের, যা হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার। এ লাল সবুজ তো আমরা চাইনি। কত স্বপ্ন, কত কষ্টার্জিত জীবনযুদ্ধ এক নিমিষেই শেষ। আল্লাহ আপনি আমাদের হেদায়েত দিন।’ কণ্ঠ শিল্পী সানী জুবায়ের লিখেছেন, ‘শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসবে যা কিছু এবার ঘটে গেল একজন মুসলিম হিসেবে আমি পৃৃথিবীর সমস্ত জায়গায় আমার হিন্দু বন্ধুদের এবং শ্রদ্ধেয়জনদের কাছে আমার লজ্জা প্রকাশ করছি। আরেক জনপ্রিয় গায়ক রাহুল আনন্দ কবিতায় নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, রংপুর নয় বাহে-/পুড়ছে মাতৃভূমি/রুখে দাঁড়াও!/আজ পুড়ছে অসহায় জন/কাল,তুমি না হয় আমি! এভাবে নানাভাবে প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে।
×