ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম আহমেদ

টরোন্টোর চিঠি ॥ কবিতায় ডুবে ডুবে

প্রকাশিত: ২০:৫৪, ২০ অক্টোবর ২০২১

টরোন্টোর চিঠি ॥ কবিতায় ডুবে ডুবে

সপ্তাহ শেষে আমি কবিতা পড়ি। পড়তে পড়তে কবিতার মধ্যে ডুবে যাই। আপনি যদি কবিতায় ডুবে না গিয়ে থাকেন কখনও, তবে আপনি অনন্য সুন্দর একটি অনুভ‚তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কবিতায় ডুবে যাওয়ার খুব কাছাকাছি অনুভ‚তি হতে পারে প্রেমে পড়ার মতো। বাংলা ভাষায় আমরা জেনেছি, ‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না’, কিন্তু কবিতায় ঠিক ঠিক ডুবে মরা যায়। কবিতায় ডুবে মরার সুবিধা হচ্ছে আপনি আবার বেঁচে উঠবেন, সেই বেঁচে থাকার আনন্দ ভিন্নতর হবে, মনে হবে শরীরের মধ্যে যেন একটি নতুন বৃক্ষের জন্ম হয়েছে। আপনি টের পাবেন সেই বৃক্ষ আপনার মেরুদণ্ড বেয়ে বড় হচ্ছে, তার শেকড়ে আপনার অনুভ‚তির খেয়াল, কাণ্ডে বাজছে বিসমিল্লাহ খানের সাহনাই, পাতায় পাতায় শিহরন জাগাচ্ছে কমল দাশগুপ্তের সুর। কবিতার প্রসঙ্গে অবাক হবেন না। জনস্বাস্থ্য নিয়ে উচ্চতর গবেষণায় ব্যস্ত থাকলেও এই শরতে আমি ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর শিক্ষার্থীদের একটা মজার বিষয় নিয়ে পড়াচ্ছি সহকারী শিক্ষক হিসেবে। বিষয়টি কিঞ্চিত নতুন, ‘স্বাস্থ্য ও মানবিকতার সূত্রপাত’। কবিতা, গান, চলচ্চিত্র, থিয়েটার ইত্যাদি মাধ্যম কীভাবে জনস্বাস্থ্যের শিক্ষাকে প্রভাবিত করতে পারে, কীভাবে শিল্পকলার নানা জ্ঞান, জনস্বাস্থ্যকে সমৃদ্ধ করতে পারে, সেই বিষয়ের অবতারণা করছি শিক্ষার্থীদের কাছে। এই বিষয়ে যিনি মূল শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করার আগে তিনি মঞ্চ অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন, বিশ্বের নানাপ্রান্তে। তার সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা হয় পড়ানোর বিষয়বস্তু নিয়ে। একটি লেখা পড়লে মনের মাঝে যে অনুভ‚তি হয়, তার সঙ্গে সেই একই লেখাটি যদি লেখক পাঠকদের উপস্থিতিতে পড়ে শোনানো যায়, তবে তার অনুভ‚তি ভিন্ন হতে বাধ্য। তবে পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করে উপস্থাপনার ওপর। কানাডিয়ান কবি রুপি কউর এই কাজটি করে যাচ্ছেন গত এক দশক ধরে। তরুণ এই কবি, তার অভিবাসী বাবা-মায়ের কানাডায় সংগ্রাম করা জীবন দেখে বড় হয়েছেন। তার মনের মাঝে জড়ো হয়েছে অনেক ঝড়ের, সেই ঝড়কে তিনি আত্মস্থ করেছেন, কবিতায় রূপান্তরিত করেছেন। তারপর যেটি করেছেন সেটি বিরল, তিনি তার কবিতার পঙ্ক্তিমালাকে ডানা দিয়েছেন, তাদের স্বর্গের আলোকচ্ছটায় সাজিয়ে নিয়ে উত্তাল সমুদ্রে ছোট্ট নৌকায় ভাসিয়েছেন; তারপর কল্পনার বৈঠায় ছন্দ মিলিয়ে তাদের সৈকতে পৌঁছুতে সাহায্য করেছেন। কবিতার সঙ্গে জীবনের গল্প মেলানো কী খুব কঠিন? টরন্টো থেকে সত্তর কিলোমিটার দূরে একটা নয়নাভিরাম জায়গা আছে, নাম ‘চেলটেনহ্যাম ব্যাডল্যান্ডজ’। শরতের এই সময়টায় সবাই ‘পুষ্প-বৃক্ষ-বৃহন্নলার’ রূপ-গুণের মাধুর্যে মশগুল হতে চায়, চায় বন-বাদাড়ে ঘুরে প্রকৃতির রঙিন আবেশে বিলীন হতে। টরন্টোরিয়ানদের পছন্দের গন্তব্য এই সময়ে এলগনকুইন পার্ক। প্রায় আট হাজার স্কয়ার কিলোমিটার জায়গাজুড়ে এই পার্কটি বানানো হয় ১৮৯৩ সালে। তবে শুরুতে অত বড় ছিল না এটি। গর্জিয়ান বে আর অটোয়া নদীর মাঝে বিস্তৃত হতে হতে আজকের এই সুবিশাল এলগনকুইন পার্ক। আমার বাসা থেকে ছুটির দিনে গাড়ি চালিয়ে এই পার্কে পৌঁছুতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা। ফিরতি পথেও মোটামুটি একই সময়। এক বছর আগে থেকেই এখানকার সব হোটেল-মোটেল বুকড হয়ে যায় ভ্রমণপিয়াসুদের তীব্র আগ্রহের কারণে। এয়ারবিএনবিতেও ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে না। যদি যেতেই হয়, তবে সাত ঘণ্টা গাড়িতেই স্টিয়ারিং ধরে কাটিয়ে দিতে হবে, এর ফাঁকে ঘণ্টাখানেকের জন্য এদিক-ওদিক ঘোরা। ও আমাতে পোষাবে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনকে উপভোগ করার সংজ্ঞা পাল্টে গেছে বেশ অনেকটাই। করোনা মহামারীর আগে ২০১৯ সালে সপ্তাখানেক সময় ধরে কানাডার রাজধানী অটোয়া, ফ্রেঞ্চ রাজধানী খ্যাত কুইবেক প্রদেশ, কুইবেকের কেন্দ্রে মন্ট্রিয়াল সিটি থেকে ছুটি কাটিয়ে আসার পর যখন আমার কানাডিয়ান বন্ধুকে বললাম আমি খুবই ক্লান্ত বোধ করছি, সে অবাকই হলো। আমি যখন তাকে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মতো ভ্রমণ বৃত্তান্ত জানালাম, তখন তার অবাক হবার মাত্রা বেড়ে গেল আরও বেশি। সে বলল, ‘আমি যখন কোথাও ছুটি কাটাতে যাই তখন সমুদ্রের পাশে একটা কটেজ বেছে নিই। দিনের বেলা কটেজের পাশে সমুদ্র সৈকতে আরাম কেদারায় শুয়ে বসে বই পড়ি, গান শুনি, প্রিয়জনের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটাই। ভাল খাবার খাই, স্কুবা ডাইভিং করি, প্যারাগøাইডিং করি, পাশে পাহাড় থাকলে হাইকিং করি। এই, ব্যাস। সব মিলে দু-চার কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে যাই না, হাইকিং ছাড়া মোটেও হাঁটি না। এই সময়টা আমার নিজেকে খুঁজে পাবার সময়, ‘রিচার্জ’ করে নেবার সময়। অথচ তুমি কিনা সাতদিনে তিনটি শহরে গেছ, এসব শহরে যত দর্শনীয় স্থাপনা সব ঘুরেছ, স্বাভাবিক সময়ের চাইতেও বেশি হেঁটেছ, তুমি ক্লান্ত হবে না তো কে হবে?’ আসলেই তাই। আমরা যারা দক্ষিণ এশিয়ায় বড় হয়েছি, তারা বড্ড উসুল করে নিতে চাই। মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে পকেট থেকে এত টাকা গচ্চা দিয়ে ছুটি কাটাতে যাচ্ছি সব দেখে আসতে হবে। ওই যে শুরুতেই আমাদের মাথায় ঢোকে ছুটি কাটাতে যাওয়া আদতে টাকার গচ্ছা দেয়া, অর্থের শ্রাদ্ধ করা! আমরা ছুটি কাটাতে গেলে জীবন দিয়ে সব জায়গা দেখে আসি ওই পয়সা উসুল করার জন্য। কিন্তু শরীরকে দুদণ্ড বিশ্রাম দিই না, পয়সা বাঁচানোর জন্য অনেকে আবার সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া চাল-ডাল রাঁধতে বসে যাই রান্না ঘরে। আরে ভাই, ঘুরতে গেলে বিশ্রাম তো করতে হবে, শহরের সুন্দর রেস্তরাঁগুলোয় ঢুঁ দিয়ে ঘ্রাণ নিতে হবে নতুন রান্নার, নতুন মসলার। তা না হলে সে আবার ছুটি হলো কীভাবে? তো সেই বিবেচনায় এবার আর আমার এলগনকুইন পার্কে যাওয়া হলো না। ঘুরে এলাম চেলটেনহ্যাম ব্যাডল্যান্ডজ থেকে। কুইন্সটোনের বহিরাবরণে ঢাকা এক স্কয়ার কিলোমিটারেরও কম জায়গায় এই দর্শনীয় স্থানটি। খুবই বিরল এই কুইন্সটোন পাওয়া যায় আমেরিকা আর কানাডার অল্প কিছু জায়গায়। এর যেমন রঙ, বর্ণ, তেমনই অদ্ভুত উঁচু-নিচু গঠন। মনে হয় হঠাতই বুঝি পাথুরে সমুদ্রে ডুব দেয়া। আর আশপাশের শত শত মাইলজুড়ে তখন পাতায় পাতায় রঙের খেলা, ডালে ডালে যেন শোনা যায় আদি কীর্তনাঙ্গের রাগ, শেকড়ে শেকড়ে রাগাশ্রিত ছন্দের অদ্ভুত মান অভিমান। ফেরার পথজুড়ে আকাশে কালো মেঘের ভেলা। শীত আসবার আগেই এ এক অদ্ভুত খেলা প্রকৃতির। সূর্য সলাজে হাসে, মেঘেদের জায়গা ছেড়ে দেয় ভালবেসে। জন ডেনভারের গানের লাইনগুলো বাংলা হয়ে ভেসে চলতে দেখা যায় আশি কিলোমিটারে ছুটে চলা গাড়ির পাশ দিয়ে। ‘ও একাকী রাস্তা, আমায় বাড়ি পৌঁছে দাও, যেখানে আমার গন্তব্য আমি তার কণ্ঠ শুনি প্রত্যুষে, সে যেন ডাকে আমায়, বেতারে জানান দেয় বহুদূরে একাকী ঘর, রাস্তা দিয়ে গাড়ি হাঁকাতে হাঁকাতে ভাবি, আমার ওই বাড়ি, যেখানে গতকালই পৌঁছানোর কথা আমার কান্ট্রি হোম, টেক মি হোম’। আমি টুপ করে ভেসে ওঠা স্মৃতির পেয়ালায় চুমুক দিই। সরে ভাসা দুধের পেয়ালায় আমার শৈশব সাঁতার কাটে, লম্বা কেশের ঘোড়াগুলো দৌড়ে ছুটে চলে পাশ দিয়ে, আমাকে মনে করিয়ে দেয় জীবন কেবলই তবে ছুটে চলা নাকি! এদিকে সূর্য ডুবে আসে, ছাদখোলা গাড়ির হুড দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে টুপ-টাপ। আমি মনে মনে বলি, আমাকে ভিজিয়ে দাও ঈশ্বর। আমাকে ডুবিয়ে দাও। অন্ধকার রাস্তায় বহমান বাতাসে ভাসতে ভাসতে একান্তেই শব্দ ভেজে চলি ‘তারপর অমন এক জোছনা রাতে, প্রিয় সব কবির কবিতার পঙ্তিমালায়, হারানো প্রেমিকার মুখশ্রী জেগে উঠবে এক এক করে, আর যেমনটি চেয়েছিলাম তেমনই, আমি মরে যাব ঠিক ঠিক, অদ্ভুত সুখে থাকা কিছু কবিতায় ডুবে ডুবে।’ টরন্টো, কানাডা ২০ অক্টোবর ২০২১
×