ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মহিমান্বিত ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী

প্রকাশিত: ২০:৫৩, ২০ অক্টোবর ২০২১

মহিমান্বিত ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী

মহান আল্লাহতালার প্রেরিত রসুল যিনি শুধু আধ্যাত্মিক সাধনায় নির্বিষ্ট ছিলেন না বরং মানবিক মানুষ হিসেবেও তাঁর চারিত্রিক শৌর্য অম্লান ও মহীয়ান। একজন পরিপূর্ণ মানুষ রূপে তাঁর সর্ববিধ গুণাবলীর অভাবনীয় প্রকাশ সত্যিই মুগ্ধতার বিস্ময়। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট, ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার হযরত মুহাম্মদ (সা.) মাতা আমিনার কোল আলো করে ভ‚মিষ্ঠ হন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর মৃত্যুও হয় ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল, মৃৃত্যুর দিনও ছিল সোমবার। অন্ধকারাচ্ছন্ন এক কালো অধ্যায়ে আলোকবর্তিকা হাতে সারা বিশ্ব দ্যুতিময় করার মহান ব্রতেই রাসূল (সা.)-এর দুনিয়াতে শুভাগমন। কোরায়েশ বংশে জন্ম নেয়া মহানবী (সা.) হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর বংশানুক্রমিক ধারায় জন্ম নেন বলে ইতিহাসে বিধৃত আছে। ধারণা দেয়া হয় হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর উত্তরসূরি হিসেবে মহানবী (সা.)-এর জন্ম। আমরা জানি ইব্রাহীম (আ.) এর পুত্র ইসমাইল (আ.) কে আল্লাহ্র ইচ্ছায় কোরবানি দিতে চাইলে রাব্বুল আলামিন পশু কোরবানি দেয়ার নির্দেশ জারি করেন। মহানবী (সা.)-এর জন্মের আগেই তাঁর পিতা আবদুল্লাহ্্ মারা যান। পিতামহ আবদুল মোত্তালিব অভিভাবক হিসেবে পৌত্র শিশু মুহাম্মদের দায়িত্ব নেয়াও প্রচলিত নিয়ম বিধির এক আবশ্যকীয় পর্যায়। আলোয় ঝলমল করা নৈসর্গিক অপূর্ব সম্ভারে মহানবী (সা.)-এর জন্ম সময় আজও আরববাসীকে উদ্বেলিত করে। মরুভ‚মির কঠিন মাটিতে প্রকৃতির অকৃত্রিম বৈভবে রাসূলুল্লাহ (সা.) পৃথিবীর আলো দেখেন। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী বৃদ্ধ আবদুল মুত্তালিব শিশুর আকিকা করার পর নাম রাখেন মুহাম্মদ। পিতামহ ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন আমার এই ফুটফুটে নাতিটি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করবে। উত্তরকালে এমন শুভ আগাম বার্তা অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। আবার মা আমিনাও জঠরে থাকা অবস্থায় ছেলের নাম ঠিক করেছিলেন আহম্মদ। দুই নামেই নবীজী (সা.) পরিচিত ছিলেন। বাংলায় অর্থ দাঁড়ায় প্রশংসিত আর প্রশংসাকারী। দুটো চমৎকার বৈশিষ্ট্যে নবীজী (সা.) বরাবরই উদ্ভাসিত হতেন। বিশ্বজুড়ে অরাজকতা, নাশকতা, ব্যভিচার অনৈতিক কর্মযোগ ছাড়াও অর্ধাংশ নারী জাতির চরম অবমাননায় মধ্যযুগীয় এই সমাজ এক তমসাচ্ছন্ন। সেই ধূসর আঙিনায় নবীজী (সা.)-এর শুভাগমন। তৎকালীন আরবের রীতি রেওয়াজ অনুযায়ী ধাত্রীর হাতে সদ্যভ‚মিষ্ঠ শিশুর লালন পালনের ভার অর্পণ করা হতো। শিশু সন্তান জন্মের সংবাদ পাওয়া মাত্রই মরুভ‚মি থেকে বেদুঈন ধাত্রীরা ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হতো। শুধু তাই নয়, এখানে ব্যবসায়িক লেনদেনে শিশু যতেœর মাধ্যমে বেশ কিছু অর্থ সংস্থান হওয়াও এক প্রকার নিয়ম ছিল। সঙ্গতকারণে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের শিশু সন্তানের জন্য অনেক ভাল ধাত্রী পেতে অসুবিধা হতো না। পিতৃহীন মহানবী (সা.)-এর আর্থিক সঙ্গতির বাহুল্য সেভাবে ছিল না। শেষমেশ হালিমা নামে এক ধাত্রী শিশু মুহাম্মদের লালন পালনের ভার নেন। হালিমা ছিলেন বনিসাদ গোত্রের রমণী। সে বংশের বিশেষ কৃতিত্ব ছিল অত্যন্ত প্রাঞ্জল এবং নান্দনিক ভাষায় কথা বলা। আরবরা তখন সভ্যতার অনেক কিছু আয়ত্তে আনতে না পারলেও তাদের সাহিত্যচর্চা এবং সুললিত ভাষা জ্ঞান ছিল অত্যন্ত প্রখর। আল্লাহ্র অসীম কৃপায় শিশু নবীর লালনপালনের ভার এমন পরিবারে চলে আসে যারা বিশুদ্ধ আরবী ভাষা, মার্জিত রুচি এবং শৈল্পিক মন সম্পদে ভরপুর ছিল। উত্তরকালে মহানবী (সা.)-এর ওপর এমন শৌর্য বীর্যের প্রভাব পড়া বাঞ্ছনীয়ও ছিল। আর বেদুঈনরা ছিল লড়াকু এক সমর জাতি। ইসলাম প্রবর্তনের পর পরই রাসূলুল্লাহ (সা.) কেও সংগ্রামী অভিযাত্রায় অনেক বিপরীত ¯্রােত মোকাবেলা করতে হয়েছিল। জয়-পরাজয় যাই আসুক না কেন সুংসহতভাবে দৃঢ় মনোশক্তিতে অনেক যুদ্ধবিগ্রহ সামলানো নবীজী (সা.)-এর লড়াকু অভিগামিতা ইসলামের ইতিহাসে ঐতিহ্যিক পর্ব। যা সময় সময় স্বর্গীয় দ্যুতিতে আলোকময় হয়ে উঠাও মহানবী (সা.)-এর অনন্য শৌর্য। নবীজী (সা.) বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার সময় বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করার ঘটনাও তাঁকে অনেক পরিস্থিতির মোকাবেলা করায়। পবিত্র মক্কার কাবা শরীফ তখন জগত বিখ্যাত তীর্থস্থান হিসেবে আদৃত হতো। বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেকে কাবা শরীফ দর্শন করে সওয়াব অর্জন করতো। হযরত (সা.) এসব দেখে দেখেই পূর্ণ যৌবনে উপনীত হলেন। তৎকালীন সামাজিক প্রথাসিদ্ধ নিয়মে ব্যবসা বাণিজ্যের যে অবাধ বিস্তার সেখানে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জোরালো ভ‚মিকা ইসলামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় পর্ব। এভাবে হযরতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে বিবি খাদিজার। খাদিজার বয়স তখন ৪০, প্রৌঢ়ত্বের সীমানায়। আর হযরত মোহাম্মদ (সা.) ২৫ বছরের উদ্দীপ্ত যুবক। ১৫ বছরের ফারাক কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেনি। দু’জনেই পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। ঘর আলো করে পুত্র এবং কন্যা সন্তানের জন্ম জীবনকে পরিপূর্ণ করে দিল। মক্কার পাদদেশে হেরা পর্বতের গুহায় নবীজী (সা.) ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বিশ্ব পালকের সাধনায় নির্বিষ্ট হতেন। জীবনের ৪০টা বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল আল্লাহ্্র ঐশী বার্তার জন্য। এক সময় সেটা যখন হাতের নাগালে তেমন মুহূর্ত অনেক আনন্দদায়ক আর সুখকর হলেও বাস্তব দুনিয়াতে নবীজী (সা.)কে নামতে হয়েছিল এক অসহনীয় সম্মুখ সমরে। পবিত্র কাবা শরীফ নিয়েও তখন অবধি লড়াই, কলহ বিবাদের অন্ত ছিল না। হেরা পর্বতে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় প্রথম যখন হযরত জিব্রাইল (আ.) আল্লাহ্র ওহী নিয়ে রাসূলের কাছে আসেন- প্রথম শব্দটিই ছিল ‘পড়’। অর্থাৎ জ্ঞানই ইসলামের মূল শক্তি। কম্পিত কণ্ঠে নবীজী (সা.) কোন মতে উচ্চারণ করলেন- আমি পড়িতে জানি না। অভিভ‚ত মুহাম্মদ (সা.) এক অতিন্দ্রীয় সম্পদের অবগাহনে নিজেকে সমর্পণ করতেও দেরি করলেন না। সম্বিত ফিরে পাবার পরও দূরে বিলীন হওয়া আকাশপথে হযরত জিব্রাইল (আ.)কে দেখতে পেলেন। ঘরে এসে স্ত্রী খাদিজাকে সব খুলে বললেন। স্ত্রী তাঁকে মুহূর্তে বিশ্বাস করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করলেন না। ইসলামের ইতিহাসে রাসূলুল্লাহ্ (স.) প্রবর্তিত ইসলাম ধর্মের প্রথম মুসলমান হলেন এই বিবি খাদিজা। এভাবে একের পর এক কোরানের পবিত্র আয়াত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর নাযিল হতে থাকে। মক্কাবাসীরা বিশ্বাসী মুহাম্মদ (সা.)কে অবিশ্বাস করতে শুরু করল। অসম্মানে, অপবাদে ক্ষতবিক্ষত থাকল। এরপর থেকেই শুরু হলো জীবনের আর এক লড়াকু অভিযাত্রা। ইসলাম ধর্মকে শুধু মানতে না পারাই নয় নেতৃস্থানীয় মক্কাবাসীরা হযরত (সা.) কে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করল। নিজ বংশের কোরায়েশরাও কোনভাবেই তাদের পূর্ব পুরুষদের ধর্মীয় মতবাদকে পরিত্যাগ করার বিপরীতে হযরতের ওপরই খড়গহস্ত হয়ে উঠল। এভাবেই হযরত মোহাম্মদ (সা.) নতুন প্রবর্তিত ধর্ম ইসলামকেও সর্বমানুষের দ্বারে নিয়ে যেতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্তি। বাকি ২০ থেকে ২২ বছর সংগ্রামী বৈতরণী পার হওয়াও মহিমান্বিত দ্যুতিময় জীবনের এক অবর্ণনীয় সংঘাত। কত অত্যাচার, উৎপীড়ন আর পাশবিক নির্যাতনে প্রতিদিনের জীবন অসহনীয় হলেও রাসূলে কারিম (সা.) নির্বিকার, নিলিপ্তই শুধু নন তারচেয়েও বেশি আপন ঐশ্বর্যিক সম্ভারে উন্নত মস্তকে ইসলাম ধর্ম প্রচারকে কোনভাবেই বিপত্তির আবর্তে পড়তে দিলেন না। আবার ঘটে গেল আরও এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। ‘মি-রাজ’ বা আকাশে ভ্রমণ, সর্বশক্তিমান আল্লাহতালার একান্ত নৈকট্য লাভ। স্বর্গীয় তেজোদ্দীপ্ত দ্যুতিময় আলোয় নবীর সমৃদ্ধ জীবন যতই পূর্ণ হতে লাগল সেখানে বিভীষিকাময় অন্ধকার জগতও নবীজীর পিছু ছাড়েনি। লড়াই, সংগ্রাম নিত্য জীবনের অনুষঙ্গ ছিল। মানবীয় গুণাবলীতে সমৃদ্ধ এক আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ পৃথিবীময় যে সত্যের বাণী প্রচারে অনড় আর অনমনীয় থাকলেন শেষ অবধি সেই অভীষ্ট লক্ষ্য নবীজী (সা.) কে পরম সান্ত¡নার প্রলেপও বুলিয়ে দেয়। কোরান, সুন্নাহ ও হাদিসকে একাত্ম করে মানবজাতির ইতিহাসে ইসলামের প্রবর্তক হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (সা.) স্বমহিমায়, আপন মর্যাদায়, অনন্য উচ্চতায় যুগ থেকে যুগান্তরে তাঁর উম্মতদের হেদায়েত করে যাচ্ছেন। বিরতিহীন এ যাত্রা আরও কতদূর যাবে ধারণারও অতীত। শুধু কি আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জন করা বরং সর্বমানুষের কল্যাণ আর হেদায়েতে যে অমৃত বাণী তিনি মানব সমাজকে উপহার দিলেন, সেই মহামানব আজও তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে চির অ¤øান, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে চিরস্থায়ী শৌর্যে মহীয়ান। লেখক : সাংবাদিক
×