ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে...

প্রকাশিত: ২০:৫০, ২০ অক্টোবর ২০২১

তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে...

বারোই রবিউল আউয়াল। কুল মাখলুকাতের জন্য এক অবিস্মরণীয় দিন। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে তিমির আকাশে উদিত হয়েছিল এক অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র- আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (সা.) এ বিশ্বচরাচরে তশরীফ আনেন। তাঁর শুভাগমনে এ পৃথিবী থেকে হাজার বছরের গোমটবাঁধা জুলমাত ও অন্ধকার বিদূরিত হয়। সমুদয় অজ্ঞতা ও পাপাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত আরব আযমে বর্ষিত হয় রহমতের বারিধারা। মানব-দানব, পশু-পাখি তামাম সৃষ্টিকুলে সেদিন নেমে এসেছিল পরম স্বস্তি, শৃঙ্খলা, সাম্য, শান্তি ও পারস্পরিক মমত্ববোধের পরিবেশ। আমাদের ঐতিহ্যের ভাষায় এদিন পবিত্র মিলাদুন্নবী (সা.)। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-এর মহান জন্মোৎসব। এ উৎসব অবিস্মরণীয়, অতুলনীয়, চিরঞ্জীব, চিরসজীব। সেদিন পৃথিবীতে যেমন রাহমাতুল্লিল আলামিনের শুভ আগমনে ঈদের আনন্দ বয়ে গিয়েছিল, উদ্বেলিত-উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল গোটা কায়েনাত; আমরাও আজ সেদিনের স্মরণে পরম আনন্দ উপলব্ধি করছি, শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি আল্লাহপাক সুবহানাহু তায়ালার। অযুত কণ্ঠে সালাত ও সালাম জানাই নবী করিম (সা.)-এর পাক চরণে। হযরত মুহম্মদ (সা.) এই দিনেই মদিনায় হিজরত করেছিলেন এবং এই দিনে আবার তামাম মাখলুকাতকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ওফাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। হাদিস শরীফে এসেছে : নবীজির পয়দায়েশ উপলক্ষে আজ থেকে প্রায় ১৪শ’ বছর আগে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল মানব-দানব, জীবজন্তু, গাছপালা সবকিছু আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। ৬৩ বছর পর ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের এই দিন তিনি আবার ওফাতপ্রাপ্ত হন। আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্যে চলে যান। হাদিস শরীফে এসেছে : হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর তিরোধানে সেদিন আকাশ-বাতাস হয়ে পড়েছিল মেঘাচ্ছন্ন ও শোকাতুর। মহানবী (সা.)-এর জন্ম ও ওফাতের এ দিবসে আমরা মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন করে থাকি। এদিন, এ মৌসুমে স্মরণ করি তাঁর পবিত্র জীবনাদর্শ, ত্যাগ ও মহত্ত¡। তিনি গোটা জীবন তাওহীদ বা মহান আল্লাহ্তায়ালার কালেমার দাওয়াত দিয়ে মানুষকে সৎ পথের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর হাতে পূর্ণতা পেয়েছিল মানব জাতির আদর্শ ও হিদায়াত। দূর করেছিলেন শিরক, বিদআত, গোমরাহি আর জুলমাতের কালিমা। আমরা আজ স্মরণ করি তাঁর হাতে গড়া মদিনা রাষ্ট্র, তাঁর পুণ্যাত্মা সাহাবাদের আত্মত্যাগে প্রতিষ্ঠিত খেলাফতে রাশেদা। আমরা উপলব্ধি করি তাঁর রেখে যাওয়া কুরআন, সুন্নাহ ও সাহাবাদের আদর্শের মধ্যেই আমাদের সকলের জন্য নিহিত রয়েছে অফুরন্ত দুনিয়াবী কল্যাণ ও শান্তি এবং আখিরাতে নাজাত ও পুরস্কার। মহান আল্লাহপাক ইরশাদ করছেন : তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তাঁর পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়। এতদসত্তে¡ও যদি তারা বিমুখ হয়ে থাকে তবে হে প্রিয় নবী ! আপনি বলে দিন : আল্লাহ্ই আমার জন্য যথেষ্ট, তিনি ব্যতীত আর কারও বন্দেগী নেই। আমি তাঁরই ভরসা করি এবং তিনি মহান আরশের অধিপতি। (সূরা তাওবা আয়াত ১২৮ ও ১২৯)। এ আয়াত দুটোতে মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর দুনিয়াতে তশরীফ আনার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি তামাম জাহানের জন্য রহমত ও দয়ার আধার হয়ে প্রেরিত। বিশেষ করে বিশ্বাসীদের জন্য একজন মহা মঙ্গলকামী পথনির্দেশক। আমাদের উচিত মহান আরশের অধিপতি আল্লাহ্পাকের সন্তুষ্টি পাওয়ার লক্ষ্যে এবং দুনিয়া, আখিরাতের ভালোর জন্য তঁাঁকে শ্রদ্ধা করা, সর্বাধিক ভালবাসা নিবেদন করা এবং জীবনে, সর্বক্ষেত্রে তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনাচরণ অনুসরণ করা। সূরা আহযাবের ৫৬ ও ৫৭ আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে : আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর জন্য রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি যথাযথ সালাম প্রেরণ কর। যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের প্রতি ইহকালে ও পরকালে অভিসম্পাত করেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন অবমাননাকর শাস্তি। উপরোক্ত আয়াতের আসল উদ্দেশ্য, মুসলমানদের রাসূল (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ করার আদেশ দান করা। কিন্তু তা এভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, প্রথমে আল্লাহ্ স্বয়ং নিজের ও তাঁর ফেরেশতাগণের দরুদ পাঠানোর কথা উল্লেখ করেছেন। অতঃপর সাধারণ মুমিনগণকে দরুদ প্রেরণ করার আদেশ দিয়েছেন। তাঁর মাহাত্ম্য ও সম্মানকে এত উচ্চে তুলে ধরা হয়েছে যে, নবী (সা.)-এর শানে যে কাজের আদেশ মুসলমানদের দেয়া হয় সে কাজ স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণও করেন। অতএব যে মুমিনগণের প্রতি রাসূল (সা.)-এর অনুগ্রহের অন্ত নেই তাদের তো এ কাজে খুব যতœবান হওয়া উচিত। এ বর্ণনাভঙ্গির আরও একটি উপকারিতা এই যে, এতে করে দরুদ সালাম প্রেরণকারী মুসলমানদের একটি বিরাট শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়েছে। কেননা আল্লাহ্তায়ালা তাদের এমন এক মহতী কাজে শরিক করে নিয়েছেন যা তিনি নিজেও করেন এবং তার ফেরেশতাগণও। আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, কিয়ামতের দিন সেই আমার নিকটতম ব্যক্তি হবে যে আমার প্রতি অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ করেছে। সাহাবি উবাই ইবনে কা’ব (রা.) বর্ণনা করেন : আমি হুজুর (সা.)-এর খিদমতে আরজ করলাম যে, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.)! আমি আপনার খিদমতে অনেক দরুদ পাঠ করি। আপনি বলে দিন যে, নিয়মিতভাবে আমি আপনার প্রতি কতবার দরুদ পাঠ করব? হযরত (সা.) জানালেন; যত তোমার ইচ্ছা। অতঃপর আমি আরজ করলাম যে, আমার অজিফার জন্য নির্ধারিত সময়ের এক-চতুর্থাংশ সময় আমি আপনার ওপর দরুদ পাঠ করতে চাই। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করলেন : যতক্ষণ তোমার খুশি পাঠ কর। তবে আরও কিছু সময় বৃদ্ধি করতে পারলে তা তোমার জন্য হবে কল্যাণকর। আমি আরজ করলাম : তা হলে মোট সময়ের অর্ধেক। জবাবে আল্লাহ্তায়ালার প্রিয় হাবীব বললেন : যা তোমার ইচ্ছা। তবে যদি আরও কিছু সময় বৃদ্ধি কর, তা তোমার জন্য আরো ভাল হবে। আমি আরজ করলাম যে, তাহলে দুই-তৃতীয়াংশ সময় ধরে পড়ব। হযরত (সা.) এবারও জানালেন : যা তোমার খুশি। তবে আরও কিছু সময় বাড়াতে পারলে তা তোমার জন্য আরও ভাল হয়। আমি এবার জানালাম : আমার ওপর অজিফার সবটুকু সময় আপনার ওপর দরুদ পড়ে অতিবাহিত করতে চাই। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করলেন : এমন অবস্থায় তোমার সকল ভাবনা ও প্রয়োজনীয় হাজত পূরণ করা হবে এবং তোমার সকল গুনাহ মাপ করা হবে। (তিরমিজী শরীফ)। রাসূল (সা.)-এর পবিত্র পয়দায়েশ, ওফাতের এ মহান দিবসে আমাদের নবীজি (সা.)-এর জীবনাদর্শ সম্পর্কে জানার জন্য নতুন করে প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে। তাঁর হায়াতে তাইয়্যিবা আমাদের জন্য ‘উসওয়ায়ে হাসানাহ’-দুনিয়ার জন্য সর্বোত্তম কল্যাণকর আদর্শ ও পথনির্দেশ। তাঁর স্মরণ আমাদের জন্য বরকত, তাঁর ওপর দরুদ ও সালাম পেশ করা আমাদের দুনিয়া, আখিরাতে নাজাতের উসিলা। মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর পবিত্র বিলাদাত ও ওফাতের পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত মাহে রবিউল আউয়ালে আমরা বেশি বেশি করে তাঁর শানে, তাঁর আহলে বায়ত ও সাহাবা কেরামের শানে দরুদ ও সালাম নিবেদন করব। লেখক : অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতিব [email protected]
×