ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নাকি দখল আধিপত্যের কৌশল

প্রকাশিত: ২০:৪৮, ২০ অক্টোবর ২০২১

সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নাকি দখল আধিপত্যের কৌশল

সদ্য সমাপ্ত দুর্গা পুজোর ঘটনা এবং তার জেরে একের পর এক যা ঘটছে কি বলা যায় তাকে-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা? দাঙ্গায় তো দু’পক্ষের পাল্টাপাল্টি আক্রমণ থাকে। একে দুর্বলের ওপর সবলের নিপীড়ন বলাই বোধহয় বেশি সঙ্গত। সাম্প্রদায়িক উস্কানির আগুনে ঘি ঢেলে মাঝ থেকে লাভবান হতে চায় তৃতীয় পক্ষ। সেই যে ব্রিটিশরা ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার বীজ বুনে সযত্ম পরিচর্যায় মহীরুহ করে তার ফল ভোগ করে উত্তরাধিকার রেখে গিয়েছিল এ অঞ্চলের দু’সম্প্রদায়ের ঘাড়ে, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আজও মাঝে মাঝেই তা তীব্র ব্যথার ক্ষত তৈরি করে, নাড়িয়ে দেয় সুস্থ চিন্তাকে। এ দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাস্তবতা গ্রহণযোগ্যতা হারালেও দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচারের ধারাবাহিকতা সমানভাবেই অক্ষুণ্ণ রয়েছে। মাত্র দু’দশক আগে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা আমাদের স্মৃতিতে এখনও দগদগে। সিরাজগঞ্জের সেই পূর্ণিমা কিংবা গফরগাঁওয়ের জ্যোৎস্নাকে কি ভোলা সম্ভব সুস্থ বিবেকের পক্ষে? দু’হাজার একের নির্বাচনের পরের বিভীষিকাময় ঘটনা জানিয়ে দিয়েছিল দেশের রাজনীতিতে মৌলবাদ নামের অন্ধ উন্মাতাল উপাদান সংযোজিত হতে যাচ্ছে। আজ এত বছর পর চারপাশে তাকালে তার অনেক স্বাক্ষরই দেখা যায়। শান্তি ও সমর্পণের জায়গা থেকে সরে ধর্ম হয়েছে অনেক বেশি সহিংস ও স্থ‚ল। গ্রেনেড, বোমা হামলা ঘটেছে। হুমায়ুন আজাদের মতো মুক্ত চিন্তার মানুষদের জীবন বিপন্ন হয়েছিল। তবে দু’হাজার একের সেই ভয়াবহ স্মৃতিতে খানিকটা হলেও মমতার প্রলেপ বুলিয়েছে বর্তমান সরকারের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সংঘটিত খুন ধর্ষণ লুণ্ঠন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ সব ধরনের সহিংসতার বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। পূর্ণিমা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে গত বছর। নৃশংসতম ওই ঘটনার বিচারের রায় হওয়া নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। ওই রায়ে এগারো জনের যাবব্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। এসব কিছুর পেছনেই তো রয়েছে আসলে আধিপত্য বিস্তারের খেলা। দুর্বলের ওপর সবলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং তা সংহত রাখার নিরলস প্রচেষ্টা। এ কাজ করতে গিয়ে যত ধরনের কৌশলের আশ্রয় নিতে হয় তার কোনটাই বাদ পড়ে না। এ উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানকে রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›িদ্বতার মুখোমুখি করে দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা। নিজেদের শাসনতান্ত্রিক ও প্রশাসনিক বিধিব্যবস্থার সুবিধার জন্যই তারা ঝগড়া বাধিয়ে দিয়েছিল দেশের নিজস্ব নাগরিকদের মধ্যে। শিক্ষা, চাকরি, পার্লামেন্টের আসন ভাগ ইত্যাদি সব কিছুই এমনভাবে করেছিল যা সংঘাতের অসুস্থ পরিবেশ তৈরি করেছিল। আঠারো শ’ সাতান্ন সালের সিপাহী বিপ্লবের পর এই বৈষম্য ক্রমশ তীব্র হয়। যার ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে উনিশ শতকের বিশ দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এরপর ভারত যতই বিভাজনের দিকে এগিয়েছে দাঙ্গার হার ও ব্যাপকতা ততই বেড়েছে। অথচ ব্রিটিশরা আসার আগে এদেশে হিন্দু-মসুলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। ছোটখাটো মারামারি হয়ত মাঝে মাঝে হতো তবে তা সামাজিক পর্যায়েই সীমিত থাকত। তাকে রাজনীতির খেলায় পরিণত করে ফায়দা লোটার সাক্ষ্য ইতিহাস দেয় না। এ অবদান পুরোপুরি ব্রিটিশের। ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরী তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ফার্সী ঐতিহ্যের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের নমনীয় ধারাটি উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যে এমন এক নগর সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল যা হিন্দু ও মসুলমান নির্বিশেষে সমাজের উচ্চস্তরের সকল মানুষকে প্রভাবিত করে। কিছুদিন আগেও উত্তর প্রদেশের কিছু কিছু কায়স্থ পরিবার নিত্যদিন তাদের পারিবারিক বিগ্রহ পুজোর সময় ফার্সী ভাষা ব্যবহার করত- যেমন ‘বাকানহা এক ফুলূুস বেদেহাম’ অর্থাৎ পুজোয় আমি কৃষ্ণকে একটি পয়সা নৈবেদ্য দেই। এই সেদিন পর্যন্ত উত্তর প্রদেশের হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ভদ্র সমাজে দৈনন্দিনের ব্যবহৃত ভাষাটি ছিল উর্দু যা ফার্সি ভাষার দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত। আর শিখ পরিবারগুলোর পুরুষরাও একই ভাষা ব্যবহার করত। অযোধ্যার নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ হোলি ও রাস-এর মতো অতি প্রমোদময় কৃষ্ণলীলা বেগমদের সমভিব্যহারে উদযাপন করতেন। বঙ্গদেশে জনৈক মুসলসমান রচিত রাজশাহীর এক ইতিহাসে মুসলমানদের দুর্গা পুজো করার উপদেশ দেয়া হয়েছিল। অনেক হিন্দু পরিবার স্থানীয় পীর-আউলিয়ার মাজারে ঐতিহ্যগতভাবে শিরনী দিত এবং এখনও দেয়। আর আমাদের এ অঞ্চলে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের বিকাশ সম্পর্কে ঐতিহাসিক মতামতের সারমর্ম হলো, এখানে কিছু মানুষ শরীয়ত অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে, তবে সম্ভবত বৃহত্তর অংশটা মুসলমান ও তাদের পীরদের সঙ্গে শ্রেফ দীর্ঘদিনের ওঠাবসার মধ্য দিয়ে মুসলমান হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। বঙ্গীয় সমাজের বঞ্চিত-অবহেলিতরা স্থানীয় পরিসরের অসংখ্য দেবদেবীর পুজো করত। যারা আসলে ছিল নানা রকম শক্তি, রোগব্যাধি এবং সাপ, বাঘ, কুমিরের মতো হিংস্র প্রাণীর প্রতিনিধি। এসব শক্তির পুজো করা হতো তাদের প্রসন্ন রাখতে। অভিজাত ব্রাহ্মণরা এই নীচুশ্রেণীর দেবদেবী ও তাদের অনুগতদের হিন্দু ধর্মের বলে স্বীকার করেনি। পরে গরিব ব্রাহ্মণরা নিজেদের রচিত পাঁচালীতে এদের বন্দনা করে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। এবং এদের ভক্তরাও হিন্দু হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর শ্রীচৈতন্যের ভাবান্দোলনে জাতপাতের বিধিনিষেধ আলগা হলে নিম্নবর্ণের এ মানুষরা হিন্দু সমাজের সঙ্গে শক্তভাবে যুক্ত হয়। অর্থাৎ এ অঞ্চলের সাধারণ হিন্দু-মুসলমানরা ধর্মবিশ্বাস ও জীবনাচরণে পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। বাস্তবতা হলো যে কোন সা¤প্রদায়িক আক্রমণের প্রথম শিকার হতো এরাই। আজও তাই কেননা, এরা দুর্বল জনগোষ্ঠী। রাজনৈতিক খেলার ঘুঁটি এরাই হয়। উচ্চশ্রেণীর হিন্দু- মুসলমানদের গায়ে এর আঁচ লাগে খুবই কম। অসম সমাজ ব্যবস্থায় এমন হওয়াই স্বাভাবিক। এই যে ধর্মীয় উৎপীড়ন, বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস, ধর্মের নানা মাত্রার অপব্যবহার সব কিছুর পেছনেই রয়েছে আধিপত্য বিস্তারের খেলা।
×