ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শীঘ্রই পূর্বের অবস্থায় ফেরার আশাবাদ

রেমিটেন্স হঠাৎ কমছে

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ১৯ অক্টোবর ২০২১

রেমিটেন্স হঠাৎ কমছে

রহিম শেখ ॥ করোনা শুরুর পর এক ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে অনেকে জমানো টাকা দেশে পাঠাচ্ছিলেন। কেউ কেউ চাকরি হারিয়ে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে সব অর্থ পাঠিয়ে দেশে ফিরেছেন। বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতির কারণে হুন্ডি চাহিদা কম থাকায় পুরো অর্থ আসছিল ব্যাংকিং চ্যানেলে। গত অর্থবছরে রেমিটেন্স বেড়েছিল ৩৬ শতাংশ। কিন্তু হঠাৎ করে গত তিন মাস রেমিটেন্স ধারাবাহিকভাবে কমছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের যে কোন খারাপ অবস্থা কিংবা উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রবাসীরা সব সময় বেশি অর্থ পাঠিয়ে থাকেন। করোনার অনিশ্চয়তার মধ্যেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আবার করোনার স্থবিরতার কারণে হুন্ডি প্রবণতা একেবারে কমে যায়। শিক্ষা, চিকিৎসা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন কারণে সব সময় অবৈধ চ্যানেলের অর্থের চাহিদা থাকে। করোনার স্থবিরতার মধ্যে এসব বন্ধ থাকলেও এখন সব খুলতে শুরু করায় ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে চাহিদা বেড়েছে। এ ছাড়া জমানো টাকা না পাঠিয়ে অনেকে আবার জমাতে শুরু করেছেন। আবার সশরীরে যাওয়া-আসা শুরু হওয়ায় কাছে করেও হয়তো অনেকে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসছেন। তবে রেমিটেন্স পরিস্থিতি শীঘ্রই আবার আগের অবস্থায় ফিরবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসীরা ৪২ কোটি ডলার কম পাঠিয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে তারা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ১৭২ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ২১৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ৫ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর-এই তিন মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ৫৪০ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ে (২ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর) পাঠিয়েছিলেন ৬৭১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছরের তুলনায় প্রবাসী আয় কমেছে ১৩০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশে ১৮৭ কোটি ১৪ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা জুনের চেয়ে ৬ কোটি ৯৩ লাখ ডলার কম এবং আগের বছরের (২০২০ সালের জুলাই) একই সময়ের তুলনায় ২৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ কম। গত বছর জুলাইয়ে এসেছিল ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, গত আগস্টে এসেছে ১৮১ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ কোটি ডলার কম। ২০২০ সালের আগস্টে এসেছিল ১৯৬ কোটি মার্কিন ডলার। পর পর তিন মাস টানা প্রবাসী আয় কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, ব্যাংক ব্যবস্থায় আগের চেয়ে প্রবাসীরা রেমিটেন্স কম পাঠালেও দেশে আগের মতোই রেমিটেন্স আসছে। কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ ছিল। তখন হুন্ডিও বন্ধ হয়ে যায়। প্রবাসীরা বাধ্য হয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে উড়োজাহাজ চলতে শুরু হওয়ায় আবার হুন্ডি বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, ‘হুন্ডি বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স কমেছে। তবে দেশে ফেরা প্রবাসীদের অনেকেই বিদেশে যেতে পারেননি। এ কারণে প্রবাসী আয় কমেছে। এর আগে এক সংলাপে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেছিলেন, ‘রেমিটেন্সের যে জাদু সেটি সম্ভবত শেষ হতে চলেছে। কারণ, মানুষ বিদেশে গেছে কম, এসেছে বেশি। সরকারী প্রণোদনার কারণে হুন্ডি ছেড়ে মানুষ ব্যাংকিং খাতে টাকা পাঠিয়েছিল। এ অবস্থায় জাদু শেষ হয়ে যাচ্ছে কিনা সেটিই বোঝার বিষয়।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বর মাসে সৌদি আরব প্রবাসীরা ৪০ কোটি ৯৪ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার। আর সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে ১৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, প্রতিবছর দেশে যে রেমিটেন্স আসে তার প্রায় অর্ধেক পাঠান সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশীরা। স্বাধীনতার পর থেকেই সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসছে সৌদি আরব থেকে। এতদিন দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। তবে গত সাত মাস ধরে আমিরাতকে ডিঙ্গিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকছে যুক্তরাষ্ট্র। রেমিটেন্সের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, বেশি রেমিটেন্স আসে এ রকম সব দেশ থেকেই রেমিটেন্স কমছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে হ্রাসের হার তুলনামূলকভাবে কম। রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, প্রতিটি জিনিসের উত্থান-পতন থাকে। রেমিটেন্স ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির পর কিছুটা কমে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে শ্রম রফতানি শুরু হওয়ায় শীঘ্রই আবার বাড়বে বলে তিনি মনে করেন। জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, করোনায় কাজ হারিয়ে অনেকে জমানো অর্থ নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। এখন পরিস্থিতি ভালর দিকে যাচ্ছে। এতে করে দেশের বাইরে খরচ বেড়েছে। তবে ইতোমধ্যে আবার বিদেশে যাওয়া শুরু হয়েছে। ফলে রেমিটেন্স পরিস্থিতি শীঘ্রই আবার আগের অবস্থায় ফিরবে বলে আশা করা যায়।
×