ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাম্প্রদায়িক হামলা ॥ উস্কানিদাতাদের খুঁজছে পুলিশ

প্রকাশিত: ২৩:১৫, ১৯ অক্টোবর ২০২১

সাম্প্রদায়িক হামলা ॥ উস্কানিদাতাদের খুঁজছে পুলিশ

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ কুমিল্লায় ধর্মীয় গ্রন্থ অবমাননার অভিযোগকে কেন্দ্র করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, রংপুর, কিশোরগঞ্জ, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও পূজাম-পে হামলা, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় বিভিন্ন জেলায় একাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় কয়েক হাজার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে কয়েক শ’। গ্রেফতারকৃত অনেককে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে হামলার নেপথ্যের নেতৃত্বদানকারী ও উস্কানিদাতাদের নাম বলেছে রিমান্ডপ্রাপ্তরা। রিমান্ডে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে যেসব উস্কানিদাতার নাম এসেছে, সেসব সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের খুঁজছে পুলিশ। বেশ কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) ও থানার অফিসার ইনচার্জের (ওসি) সঙ্গে কথা বলে এমনটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা বলছেন, গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের কর্মী। এদের কেউ মাদ্রাসার ছাত্র, ছাত্রদল কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, দোকানি ও দোকানের কর্মচারী হলেও প্রত্যেকে বিএনপি-জামায়াত মতাদর্শের। রিমান্ডপ্রাপ্তরা হামলার পেছনে তাদের নেতাদের নাম বলছে। অনেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে। সম্প্রতি পবিত্র কোরান অবমাননার ঘটনাকে কেন্দ্রে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজাম-পে হামলা ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হামলাকারী ও উস্কানিদাতাদের ধরতে পুলিশ সদর দফতর থেকে সব কটি ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ঘটনায় জড়িতদের ধরতে আটঘাট বেধে মাঠে নেমেছে পুলিশ, র্যাব, সিআইডি, এসবিসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এসব হামলার ঘটনায় সোমবার পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় দায়ের হওয়া মামলায় কয়েক শ’কে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, হামলাকারী ও উস্কানিদাতাদের ধরতে পুলিশের সব কটি ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রেঞ্জ ডিআইজি, জেলার পুলিশ সুপার ও মেট্রো পুলিশ কমিশনাররা আলাদাভাবে বৈঠক করে নির্দেশনা পাঠাচ্ছেন থানার ওসিদের। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিন পুলিশের মিডিয়া সেন্টার সূত্র জানায়, ঢাকার সহিংসতার ঘটনায় রমনা, পল্টন ও চকবাজার থানায় দায়ের হওয়া মামলায় আসামি চার হাজারের বেশি। গত শুক্রবার ঢাকার কাকরাইলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হয়েছে রমনা ও পল্টন থানায়। এসব মামলায় ২১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে ৪০০০ জনকে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর কয়েক শ’ মানুষ বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় রমনা থানার মামলায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ১৫০০ মানুষকে আসামি করা হয়েছে। রমনা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, শুক্রবার সংঘর্ষের সময় যে ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, মামলায় তাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে মাদ্রাসার ছাত্র, দোকানের কর্মচারী ও রাজনৈতিক দলের লোক রয়েছে। তাদের দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। আজ মঙ্গলবার তাদের আদালতে হাজির করা হবে। রিমান্ডপ্রাপ্তরা হামলার পেছনে তাদের লিডারদের নাম বলেছে। তদন্তের স্বার্থে এখন নাম বলা সম্ভব হচ্ছে না। সেদিনের ঘটনায় পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ছয়জনকে। পল্টন থানার ওসি সালাউদ্দিন মিয়া জানান, গ্রেফতার ছয়জন ঢাকার মাদ্রাসার ছাত্র। তাদের একদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা তাদের লিডারের নেতৃত্বে এ হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে। উস্কানিদাতা ওইসব লিডারদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ইতোমধ্যে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে নানা তথ্য আসছে। তাদের অধিকাংশই কারো না কারো ইন্ধনে এ হামলা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে। আবার তাদের দেখাদেখি সর্বজনীন হামলাও চালিয়েছে কেউ কেউ। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে উস্কানিদাতা হিসেবে যাদের নাম আসবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। ইতোমধ্যে ক্রসচেক করে যাদের বিরুদ্ধে সত্যতা পাওয়া গেছে, তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। তারা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য সীমান্ত এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কুমিল্লায় ৮ মামলায় ৩ কাউন্সিলরসহ আসামি ৭৯২, গ্রেফতার ৪৩ ॥ কুমিল্লার কোতোয়ালি, সদর দক্ষিণ, দাউদকান্দি থানায় সোমবার পর্যন্ত ৮টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। এসব মামলায় ৭৯২ জনকে আসামি করা হয়। এদের মধ্যে সিটির তিন কাউন্সিলর যথাক্রমে গোলাম কিবরিয়া, মোশারফ হোসেন, ইকরাম হোসেন বাবুসহ ৯২ জনের নাম এজাহারে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব মামলায় ৩৯ আসামি বর্তমানে কারাগারে আছে। কুমিল্লার পুলিশ সূত্র জানায়, হামলার হোতা, নেপথ্য নায়কসহ দুষ্কৃতকারীদের ধরতে ঢাকা থেকে আসা সোয়াত, এন্টি-টেররিজম, জেলা পুলিশ-ডিবি, সিআইডি, র্যাব, পিবিআইসহ পুলিশের সকল ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থা কুমিল্লায় কাজ করছে। এর মধ্যে ঘটনার পর পর ফেসবুকে লাইভসহ ভিডিও, ছবি ভাইরাল করে জনমনে উত্তেজনা সৃষ্টির ঘটনায় পুলিশ ফয়েজ নামে একজন ও র্যাব গোলাম মাওলা নামে এক ভিডিও এক্সপার্টকে গ্রেফতার করেছে। কুমিল্লার পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বলেন, গ্রেফতার কয়েকজনের বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। আদালত রিমান্ডের তারিখ ধার্য করেছেন। কোরান অবমাননা ও হামলার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে হামলার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরের পক্ষ থেকে ৩টি এবং পুলিশ বাদী হয়ে ২টি মামলা করেছে। এসব মামলায় ২০০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে ১৬ জনকে। এর মধ্যে একজন ছাত্রদল কর্মী রয়েছে। বাকিরা ব্যবসায়ী, ফুটপাথের হকার। হাজীগঞ্জ থানার ওসি ইব্রাহিম জানান, গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। আদালত শুনানির দিন ধার্য করেছেন। তবে প্রাথমিক জিজ্ঞসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছেন, তারা সর্বজননীভাবে হামলা করেছেন। কিন্তু তারা কারো না কারো নেতৃত্বে এ হামলা করে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়েছে। তাই অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের রিমান্ডে নেয়া হবে। নোয়াখালী জেলার এসপি মোঃ শহীদুল ইসলাম জানান, জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, দোকানপাট লুটের ঘটনায় সোমবার পর্যন্ত ১৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৮৫ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে, অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে পাঁচ হাজার জনকে। সোমবার পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে ৯০ জন। এছাড়া চৌমুহনীতে পুলিশ ফাঁড়ির ওপর হামলার ঘটনায় ২৪৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আড়াই হাজার জনকে আসামি করে আরেকটি মামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে ৩২ জনকে। ইসকনের দুই ভক্ত নিহতের ঘটনায় মন্দিরের পক্ষ থেকে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ২০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে আরেকটি মামলা হয়েছে। এ মামলা গ্রেফতার করা হয়েছে ১২ জনকে। গ্রেফতারকৃতদের যাচাই-বাছাই করে আদালতে প্রেরণ করা হবে। চট্টগ্রামে ৬ মামলায় ১২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ১৫৯ জনকে। পুলিশ বলছে, গ্রেফতারকৃতরা সরকারের বিরুদ্ধে কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিল। এদের মধ্যে মাদ্রাসার শিক্ষক থেকে শুরু করে মসজিদের ইমাম এবং স্থানীয় সাবেক অনেক জনপ্রতিনিধি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাড়িত। শুক্রবার জেএমসেন হল পূজাম-পে হামলার ঘটনায় ৮৭ জনকে, কর্ণফুলী এলাকার মন্দিরে হামলার ঘটনায় চারজন, সাতকানিয়ার কাঞ্চন ইউনিয়নে মন্দিরে হামলার ঘটনায় ৪২ জন এবং বাঁশখালীর ঘটনায় ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাঁশখালী থানার ওসি মোঃ কামাল উদ্দিন জানান, তার থানায় ৬২ জন এজাহারনামীয় ও ৭০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করা হয়েছে। ২টি ক্ষতিগ্রস্ত পূজা কমিটির পক্ষ থেকে এবং একটি পুলিশ বাদী হয়ে। গ্রেফতার ১৬ জনের রিমান্ড শুনানি হয়নি। ওসি বলেন, গ্রেফতারকৃতরা বিএনপি ও জামায়াতের কর্মী। কেউ কেউ আছেন ব্যবসা করেন, তবে বিএনপি-জামায়াতের মতাদর্শের লোক। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, কোরান অবমাননা, হামলা ও গুজব রটিয়ে যারা উস্কানি দিয়েছে, তাদের ধরতে থানা, রেঞ্জ ও গোয়েন্দা পুলিশ মাঠে কাজ করছে। ইতোমধ্যে অনেকের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। মামলায় অনেককে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় উস্কানিদাতা হিসেবে যাদের নাম আসবে, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে। রংপুরে অগ্নিসংযোগ, গ্র্রেফতার ৪১ ॥ পূজাম-পে হামলার ঘটনায় সারাদেশ উত্তপ্তের মধ্যেই রবিবার রাতে নতুন করে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর কসবা হিন্দু জেলে পল্লীতে আগুন দিয়ে প্রায় ৬৫টি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় সোমবার বিকেল পর্যন্ত ৪১ জনকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। রংপুর জেলা পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, ফেসবুকের একটি পোস্টে মন্তব্যের ঘরে কাবাঘরের ব্যঙ্গ ছবি দেয়। এ ঘটনায় স্থানীয়দের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। বান্দবানের লামা থানার ওসি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার লামা কেন্দ্রীয় হরি মন্দিরে হামলার ঘটনায় ১৪৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে ২টি মামলা হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
×