ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের ছোট রাসেল সোনা

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ১৮ অক্টোবর ২০২১

আমাদের ছোট রাসেল সোনা

শেখ রাসেল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা অঞ্চলের ধানম-িতে ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু ভবনে ১৮ অক্টোবর, ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট ভাই রাসেল। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে রাসেল সর্বকনিষ্ঠ। রাসেলের নামকরণের রয়েছে একটি মজার পটভূমি। দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুব প্রিয় একজন লেখক। বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে শেখ রাসেলের মাকে ব্যাখ্যা করে শোনাতেন বার্ট্রান্ড রাসেলের দার্শনিকতা। এসব শুনে রাসেলের ভক্ত হয়ে ওঠেন মা এবং নিজের ছোট সন্তানের নাম রেখে দেন রাসেল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে একদল তরুণ সেনা কর্মকর্তা ট্যাঙ্ক দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ধানম-ির বাসভবন ঘিরে ফেলে। সেদিন ছিল শুক্রবার। ধানম-ির ৩২ নম্বরের ৬৭৭ নম্বর বাড়িটির চারপাশে তখন ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায়। বাড়ির দোতলায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিপথগামী হিংস্র সেনা সদস্যদের হামলার খবর পেয়েই তিনি নিজ কক্ষ থেকে ইন্টারকম টেলিফোনে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মুহিতুল ইসলামকে বলেন, ‘সেরনিয়াবাতের (তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত) বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন লাগা।’ আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম জানান, তিনি চেষ্টা করেও লাইন পাচ্ছেন না। এক পর্যায়ে গণভবন এক্সচেঞ্জের লাইন পাওয়া গেলেও অপর প্রান্ত থেকে কেউ কথা না বলায় বঙ্গবন্ধু নিজেই টেলিফোন হাতে নিয়ে বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি।’ কিন্তু জাতির পিতার কথা শেষ হওয়ার আগেই একঝাঁক গুলি বাড়িটির দক্ষিণ দিকের জানালার কাচ ভেঙ্গে অফিস কক্ষের দেয়ালে বিদ্ধ হয়। এরপর অবিরত গুলি আসতেই থাকে। এ সময় বঙ্গবন্ধু টেবিলের ওপর শুয়ে পড়ে আ ফ ম মুহিতুল ইসলামকেও হাত ধরে কাছে টেনে শুইয়ে দেন। গুলি একটু থেমে এলে দোতলা থেকে কাজের ছেলে মোহাম্মদ সেলিমের এনে দেয়া পাঞ্জাবি ও চশমা পরে গাড়ি রাখার বারান্দায় আসেন বঙ্গবন্ধু। তিনি পাহারারত সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কি করছ?’ এরপর দোতলায় নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন বাঙালীর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর বঙ্গবন্ধু তাঁর মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিল উদ্দিনকে ফোনে বলেন, ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আস। আর্মির লোক আমার বাসা এ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বল।’ তিনি সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহকেও ফোন করে বলেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি এ্যাটাক করেছে। কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ এর কিছুক্ষণ পরই শহীদ হন জাতির পিতা। ওই সময়ে বঙ্গবন্ধুর পরনে ছিল সাদা গেঞ্জি, পাঞ্জাবি এবং সাদা-কালো চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবির পকেটে ছিল চশমা। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে একে একে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন শেখ জামাল, সুলতানা কামাল খুকু ও পারভীন জামাল রোজী, শেখ আবু নাসের। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবার এবং তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদের সঙ্গে শেখ রাসেলকেও হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে রাসেলকে নিয়ে পালানোর সময় ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ রাসেলকে অভ্যুত্থানকারীরা আটক করে। ব্যক্তিগত কর্মচারী এএফএম মুহিতুল ইসলামের ভাষ্যমতে, রাসেল দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরে। আমাকে বলল, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? ওর সে কণ্ঠ শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এক ঘাতক এসে আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণভাবে আঘাত করতে লাগল। আমাকে মারতে দেখে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিল। এক সৈন্য শেখ রাসেলকে আলাদা করে ফেললে সে তার মা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছে যাওয়ার আকুতি জানায়। ‘আমি মায়ের কাছে যাব’ এটিই ছিল মৃত্যুর পূর্বে শেখ রাসেলের শেষ কথা। এক সৈন্য তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার মিথ্যা প্রবোধ দিয়ে দোতলায় নিয়ে যায়। সেখানে মায়ের রক্তমাখা মরদেহ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে শেখ রাসেল মিনতি করে, ‘আমাকে হাসু (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাকনাম) আপার কাছে পাঠিয়ে দাও।’ কিন্তু সৈন্যদের মন গলেনি। বিন্দুমাত্র দেরি না করে গুলিতে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করে তারা। গুলিতে শেখ রাসেলের চোখ বেরিয়ে যায়। মাথার পেছনের অংশ থেঁতলে থাকে। নিথর দেহটি পড়ে থাকে সুলতানা কামাল খুকুর লাশের পাশে। শেখ রাসেল ছিল ঘাতকের শেষ শিকার। শেখ রাসেল শহীদ হওয়ার পর উদ্ধত কণ্ঠে সৈন্যরা তাদের কর্মকর্তাদের খবর দেয়, ‘স্যার, সব শেষ।’ লেখক : পরিচালক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর
×