ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পৃথিবী নিরাপদ হোক শিশুদের জন্য

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ১৮ অক্টোবর ২০২১

পৃথিবী নিরাপদ হোক শিশুদের জন্য

১৯৬৪ সাল। সময়টা ছিল লড়াই আর যুদ্ধের উত্তেজনায় মুখর। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে চলেছে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ওই সময় সমগ্র পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল। একদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, অন্যদিকে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী কায়দে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ। অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারের মাঝেও এ অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে। যিনি এই স্বপ্নের রূপকার সেই অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘর আলো করে জন্ম নিল এক ছোট্ট দেবশিশু। ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িতে জন্ম হয় শেখ রাসেলের। সেদিন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশগ্রহণের জন্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন বঙ্গবন্ধু। জন্মের সময় বাবা কাছে না থাকলেও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পিতা-পুত্রের চিরপ্রস্থান ঘটেছিল একসঙ্গেই। ছোট ছেলের রাসেল নাম রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজে। তাঁর প্রিয় লেখক ছিলেন পৃথিবীখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক সাহিত্যে নোবেল পুস্কারপ্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেল। পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের জন্য সুন্দর ও শান্তিময় করার লক্ষ্যে নিরলস কাজ করে গেছেন তিনি । এই নামটিকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর মহৎ কোন স্বপ্ন ছিল। আশা ছিল তাঁর ছেলে বড় হয়ে জগদ্বিখ্যাত হবে একদিন। শিশু রাসেলের ভুবন ছিল তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং ভাই শেখ কামাল এবং শেখ জামালকে ঘিরে। তাদের সকলের ভালবাসার ধন ছিলেন ছোট্ট রাসেল। রাসেলের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে বাবা মুজিবকে ছাড়া। রাজনৈতিক বন্দী হয়ে তার বাবা মুজিব কারাগারে ছিলেন দিনের পর দিন। শেখ রাসেল বেশ কয়েকবারই কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁর প্রথম কারাগার দেখা ১৯৬৬ সালের ৮ মে। পিতার গ্রেফতারের পর। কারাগারে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই তাঁর বাবাকে রেখে আসতে চাইত না। এ কারণে তাঁর মন খারাপ থাকত। কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের দিনলিপিতে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পযর্ন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়িয়ে ওকে আদর করলাম। একটু পরে ভেতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল, আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।’ শিশু রাসেল ছিল অভিমানী। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই লিখেছেন কারাগারের রোজনামচায়। ১৯৬৭ সালের ১৪-১৫ এপ্রিল অন্যান্য প্রসঙ্গ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু রাসেলকে নিয়ে লিখেছেন, ‘জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম, ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়িয়ে নাই দেখে আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভেতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে গিয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, ‘বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে। রাসেল ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা।’ আমার ওপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।’ শিশু রাসেলকেও কাটাতে হয় বন্দী জীবন। অত্যন্ত কষ্টকর ছিল তার দিনগুলো। তার বন্দিত্ব সম্পর্কে বোন শেখ হাসিনা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ছোট্ট রাসেলও বন্দী জীবনযাপন শুরু করে। ঠিকমতো খাবার-দাবার নেই। কোন খেলনা নেই, বইপত্র নেই, কী কষ্টের দিন যে ওর জন্য শুরু হলো। বন্দীখানায় থাকতে আব্বার কোন খবর আমরা জানি না। কোথায় আছেন কেমন আছেন কিছুই জানি না। প্রথমদিকে রাসেল আব্বার জন্য খুব কান্নাকাটি করত। তার ওপর আদরের কামাল ভাইকে পাচ্ছে না, সেটাও ওর জন্য কষ্টকর।’ (ইতিহাসের মহানায়ক, পৃষ্ঠা-২১)। শেখ রাসেল ছিল বন্ধুবৎসল, গরিবদের জন্য ছিল তার দরদ, মমতা। জাতির পিতার গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়াতে যখন সে যেত তখন গ্রামের ছেলেদের জন্য সে জামা নিয়ে যেত। তাদের উপহার দিত। আজ শেখ রাসেল বেঁচে থাকলে দেশ একজন মানবদরদী মানুষ পেত। শেখ রাসেলের এই ছোট্ট জীবন আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয়। আমাদের শিশুরা যদি শেখ রাসেলকে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে তার মতো বেড়ে ওঠে, তাহলে আমরা আদর্শ শিশু পাব। যাদের হাত ধরে বিনির্মিত হবে আগামী দিনের চেতনার নাগরিক। জীবনের পথ, ইতিহাসের গতিধারা সব সময় স্বাভাবিক সূত্র ধরে এগোয় না। অনভিপ্রেত বহু ঘটনা এসে সেই যাত্রাপথ বিপদসঙ্কুল করে তোলে, বাঁক ঘুরিয়ে দেয়, ভিন্ন খাতে নিয়ে যায়। তখন আবার সঠিক পথে ফিরতে প্রয়োজন হয় কঠিন সংগ্রামের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকা-ের ভেতর দিয়ে এমনি এক ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করা হয়েছিল এই দেশকে। এরই নির্মম শিকার হয়েছিল শিশু শেখ রাসেল। ফলে তার জন্মদিনটি আনন্দ নয়, বরং বেদনাই বয়ে আনে বিবেকবান মানুষের কাছে। শেখ রাসেলের জন্মদিন ১৮ অক্টোবর এ বছর থেকে ‘জাতীয় দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ শেখ রাসেল দিবস পালনের প্রস্তাব এবং যৌক্তিকতা মন্ত্রিসভায় পেশ করে। গত ২৩ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে দিবসটি ‘ক’ শ্রেণীভুক্ত দিবস হিসেবে পালনে অনুমোদন দেয়া হয়। এর জন্য আমরা আইসিটি বিভাগের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। শিশু শেখ রাসেলের অকাল প্রয়াণের শোক-দুঃখ কোন দিন শেষ হওয়ার নয়। শেখ রাসেলের জন্মদিনে আমাদের কামনা, শুধু আমাদের দেশ নয়, সারা পৃথিবীই শিশুদের জন্য নিরাপদ হয়ে উঠুক। হানাহানির অবসান হোক, প্রতিষ্ঠিত হোক চিরকাক্সিক্ষত শান্তি। লেখক : এমপি, প্রতিমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ
×