ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লোক ও কারুশিল্পের গৌরব বঙ্গবন্ধুর বহুমাত্রিক উপস্থাপনা

প্রকাশিত: ২৩:২০, ১৭ অক্টোবর ২০২১

লোক ও কারুশিল্পের গৌরব বঙ্গবন্ধুর বহুমাত্রিক উপস্থাপনা

মোরসালিন মিজান ॥ লোক ও কারুশিল্পের বিচিত্র মাধ্যম। জাতির জনকের বহুমাত্রিক উপস্থাপনা। নিজস্ব শিল্পরীতি ও ঐতিহ্য বজায় রেখেই বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতাকে উপস্থাপন করেছেন তৃণমূলের শিল্পীরা। আর তাদের খুঁজে নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে জাতীয় জাদুঘর। জন্মশতবর্ষে শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানাতেই এমন আয়োজন। শনিবার জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। আরও উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবুল মনসুর, জাদুঘরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কিপার আসমা ফেরদৌসি। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় প্রদর্শনী। ১০ দিনের আয়োজনে যোগ দিয়েছেন ১৫ জন শিল্পী। তাদের মধ্যে রয়েছেন আবেদুর রহমান, অরুণ চন্দ্র দাশ, ইলোরা পারভীন, গোপেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী, হোসনে আরা, মানিক সরকার, রফিকুল ইসলাম, শাহ আলম, মোঃ শোয়েব, নাজির হোসেন, রফিকুল ইসলাম, মোঃ রফিকুল ইসলাম, শামীমা খাতুন, শেখ মোঃ আমিরুল ইসলাম, সুবোধ চন্দ্র পাল ও তপন চন্দ্র দাশ। জাদুঘরের নিচতলার গ্যালারিতে শিল্পীদের জন্য আলাদা আলাদা স্টল করে দেয়া হয়েছে। শিল্পীদের নিয়মিত কাজ তো আছেই। সেইসঙ্গে মুজিবের উপস্থাপনা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন লোক ও কারুশিল্পের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। জন্মশতবর্ষে শিল্পীরা যেন সে কথাটিও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। প্রদর্শনীর পাশাপাশি কোন কোন শিল্পী স্টলে বসে কাজ করেছেন। রাজধানী শহরে এমন লোক চর্চা দেখে অন্যরকম এক আবেগ কাজ করে ভেতরে। প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে মৃৎশিল্প, সূচিশিল্প, ধাতবশিল্প, দারুশিল্প, সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং, পটচিত্র, শোলাশিল্প, বাঁশ বেত শিল্পসহ নানা মাধ্যমের কাজ। সূচিশিল্পী ইলোরা পারভীনের কথাই আগে আসে। তার হাতে রং তুলি কিছু নেই। এসবের প্রয়োজনও হয় না তার। সুই সুতো দিয়েই দিব্যি চিত্রকর্ম গড়েছেন। দূর থেকে দেখে মনে হয় খ্যাতিমান কোন শিল্পীর আঁকা ছবি। একটু কাছে গেলেই বিস্ময়। তখন বোঝা যায় ছবিগুলো আসলে সুই সুতোর কাজ। গ্রামীণ ঐতিহ্যের সুই সুতো দিয়ে অনেক ফিগারেটিভ কাজ করেছেন তিনি। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নানা অভিব্যক্তি প্রায় হুবহু ফুটিয়ে তুলেছেন। বঙ্গবন্ধুর দ্রোহ, হাসিমুখ, দু একখানা উড়তে থাকা চুল, চিবুকের ভাঁজ, কাঁচাপাকা গোঁফ, আলো আঁধারি সবই সুই সুতোয় বুনা! কী করে সম্ভব? কবে কিভাবে এ চর্চার শুরু? জানতে চাইলে কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের প্রসঙ্গ টানেন তিনি। বলেন, বিখ্যাত এ শিল্পীর পাশেই আমাদের বাড়ি। আমি পাশে বসে তার ছবি আঁকা দেখেছি। কিছু না কিছু হয়ত শিখেছিও। সে শিক্ষা থেকেই সুই সুতোয় বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরেছেন বলে জানান তিনি। পাট দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরেছেন আরেক শিল্পী আবেদুর রহমান। এ শিল্পীর কাজগুলোও বেশ সূক্ষ্ম ও সুন্দর। এদিকে, পটচিত্রে বঙ্গবন্ধুর ছবি এঁকেছেন শহুরে পটুয়া নাজির হোসেন। ভাল কাজ। তবে এ কাজগুলোকে পটচিত্র না বলে পটের ফর্মে আঁকা ছবি বলা যেতে পারে। ঢাকার বাইরে থেকে যারা পটচিত্রের ধ্রুপদী চর্চাটি করছেন তাদের কাউকে প্রদর্শনীতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেলে হয়ত আরও ভাল কাজ দেখার সুযোগ হতো। সিনেমা ব্যানার পেইন্টিংয়ে বাঙালী নেতার মুখ এঁকেছেন শিল্পী মোঃ শোয়েব। নবাবপুরের এ শিল্পী কাজ শুরু করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পর পর। ফলে সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ছবি যেমন এঁকেছেন, তেমনি এঁকেছেন বাঙালীর মুক্তির মহানায়ক শেখ মুজিবের ছবিও। অভিন্ন অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে তার বর্তমান সময়ের চিত্রকর্মে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ছবি এঁকেছেন তিনি। টিনের পাতের ওপর বঙ্গবন্ধুর এমন রিয়ালিস্টিক এবং জোরালো উপস্থাপনা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। নারিন্দার রিক্সাচিত্রী মোঃ রফিকুল ইসলামও ভীষণ যতেœ প্রিয় নেতাকে এঁকেছেন। খুব চেনা এবং ঐতিহ্যবাহী ফর্মে আঁকা শেখ মুজিবুর রহমানকে কৌতূহল নিয়ে দেখছেন দর্শনার্থীরা। প্রদর্শনীতে কাশা ও পিতল শিল্পের নিদর্শন নিয়ে এসেছেন এ কাজের জন্য সুনাম কুড়ানো মানিক সরকার। ঢাকার শিল্পী। কাশা পিতলের গায়ে তার হাতের নিখুঁত এবং ডিটেইল কারুকৃতি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষের লগোটিকে কাশার প্লেটে অবিকল তুলে এনেছেন শিল্পী। সিলেটের শীতলপাটিও প্রদর্শিত হচ্ছে গ্যালারিতে। ইউনেস্কোর ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া শীতলপাটি নিয়ে এসেছেন মৌলভীবাজারের শিল্পী অরুণ চন্দ্র দাশ। মুর্তা দিয়ে বুনা পাটি যারপরনাই নরম। আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দিতেও ভাল লাগে। ঐতিহ্য মেনে শীতলপাটিতে নানা ফুল পাখি লতা পাতার নক্সা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে লোককথা। প্রদর্শনী উপলক্ষে যুক্ত হয়েছে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ চাইলে যে কেউ এটি কিনে নিয়ে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতে পারবেন। তবে সেই ক্রেতা তেমন পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানান অরুণ। দুঃখ করে বলেন, আমাদের গ্রাম দুলিজোড়ায় ১৫০টির মতো পরিবার শীতলপাটি তৈরির কাজ করত। এখন আছে কয়েক ঘর। বলাগঞ্জ নামের একটি বাজারে সপ্তাহে ৪০০ থেকে ৫০০ শীতলপাটি বিক্রির জন্য আসত। এখন পাটির বাজারই বন্ধ বলে জানান তিনি। দুঃখ করেন ঝিনাইদহের শোলাশিল্পী গোপেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীও। শোলার উপাদান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি গড়েছেন তিনি। এত সংবেদনশীল উপাদান দিয়ে ফিগারেটিভ কাজ মুশকিলের বৈকি। তবুও কাজটি তিনি অবলিলায় করেছেন। সেইসঙ্গে ময়ূরপঙ্খী নৌকা, পালকি, পাখি ইত্যাদি তৈরি করছেন চোখের সামনেই। কিন্তু কথা প্রসঙ্গে বললেন, লোকজন প্লাস্টিক পছন্দ করে। এসব ভালবাসে না। শিল্প সচেতন কিছু মানুষ কদর করেন বলেই বৃদ্ধ বয়সেও পেশাটি ধরে রেখেছেন বলে জানান তিনি। মৃৎশিল্পীদের মধ্যে সুবোধ চন্দ্র পাল তপন রিলিফ ওয়ার্কে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরেছেন। চন্দ্র দাস গড়েছেন ভাস্কর্য। এভাবে অল্প পরিসরে বড় এক উপস্থাপনা। গ্রামীণ মেলার আমেজ। শিল্পকর্ম দেখার পাশাপাশি আছে কেনার সুযোগ। সব মিলিয়ে বেশ লাগে। ‘বঙ্গবন্ধু লোকশিল্প প্রদর্শনী’ চলবে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত।
×