ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী আবদুল রাযাক গুরনাহ

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ১৭ অক্টোবর ২০২১

সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী আবদুল রাযাক গুরনাহ

প্রখ্যাত সুইডিস সাংবাদিক গ্রেটা থারফজেলের হিসাব অনুযায়ী ২০২০ পর্যন্ত সর্বমোট ১১৭ জন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯৫ জন ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাবাসী এবং ১৬ জন নারী সাহিত্যিক। এই পটে আবদুল রাযাক গুরনাহ সমকালীন এক যুগের একমাত্র আফ্রিকান, যিনি ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। তার আগে ১৯৯৩ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্ত আফ্রিকান হলেন টম মরিসন। আফ্রিকা থেকে তারও আগে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৮৬ সালে নাইজিরিয়ার ওল সইনকা, ১৯৮৮ সালে মিসরের নাগিব মাহফুজ, ১৯৯১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার নাদিন গর্ডিনার এবং ২০০৩ সালে একই দেশের জন ম্যাকসওয়েল কোয়েটজি, এরপরে ব্রিটিশ জিম্বাবুইয়ের উপন্যাসিক ডোরিস লেসিং ২০০৭ সালে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত ও স্বীকৃত হয়েছিলেন। গুরনার জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তানজানিয়ার জানজিবারে। ১৯৬৪ সালে জানজিবারের তৎকালীন আরব শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের সময় তিনি ১৮ বছর বয়সে ইংল্যান্ডে দরিদ্র ও অসহায় শরণার্থী হিসেবে চলে আসেন। তিনি ক্যানটারবারির ক্রাইস্ট চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ তে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করে নাইজিরিয়ার বায়েরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮৩ পর্যন্ত বক্তা-শিক্ষক হিসেবে কাজ করে ইংল্যান্ডের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীর অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণকালীন পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেছেন। গুরনাহ ছোটগল্প ও নিবন্ধ- সমালোচনার বাইরে ইংরেজীতে ১০টি উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাসগুলো হলো (১) প্রস্থানের স্মৃতি (১৯৮৭), (২) তীর্থ যাত্রীর পথ (১৯৮৮), (৩) ডটি (১৯৯০), (৪) স্বর্গ (১৯৯৪), (৫) নিস্তব্ধতার প্রশংসা (১৯৯৬), (৬) সাগর তটে (২০০১), (৭) ছেড়ে যাওয়া (২০০৫), (৮) শেষ উপহার (২০১১), (৯) প্রস্তর হৃদয় (২০১৭) এবং (১০) জীবনের পরে (২০২০)। এগুলোর মধ্যে ‘স্বর্গ’ ও ‘সাগর তটে ’ প্রখ্যাত বুকার পুরস্কারের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে বিবেচিত হয়েছিল, কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে পুরস্কার পায়নি। গুরনাহকে ২০২১ সালের নোবেল দেয়ায় বিবেচনার উপকরণ ছিল ‘ঔপনিবেশিকতার প্রতিক্রিয়ার অপরাজেয় ও সহানুভূতিশীল প্রতিফলন এবং সংস্কৃতি ও মহাদেশের বিভাজনে শরণার্থীদের ভাগ্য বিষয়ে গভীর আনুভৌতিক দর্শন’। ‘প্রস্থানের স্মৃতি’, ‘তীর্থ যাত্রীর পথ’ ও ‘ডটি’তে তিনি ইংল্যান্ডে পূর্ব আফ্রিকা থেকে শরণার্থী হয়ে আসার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। ‘স্বর্গ’ এ তিনি পূর্ব আফ্রিকার ঔপনিবেশকতায় অত্যাচারিত এক বালকের অনুভূতি ও স্মৃতি তুলে ধরেছেন। ‘নিস্তব্ধতার প্রশংসা’য় তুলে ধরা হয়েছে এক যুবকের কথাÑ যিনি জানজিবার ছেড়ে ইংল্যান্ডে আশ্রয় নিয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তার সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘জীবনের পরে’ এ তিনি তানজানিয়ায় জার্মান ঔপনিবেশিকতার প্রজন্মান্তর চিত্র তুলে ধরে কিভাবে তা সমাজকে বিভিন্নতর করেছে, তা সাহসিকতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। সাহিত্যে নোবেল নির্বাচন কমিটির এবারকার চেয়ারম্যান আন্ডারস ওলসন বলেছেন যে, তার লেখায় গুরনাহ ঔপনিবেশিতাউত্তর লেখকদের মধ্যে পৃথিবীর প্রসিদ্ধতর অবদানকারী হিসেবে বৃহত্তর পরিসরে চিত্রটি তুলে ধরেছেন। তার কথায়, গুরনাহ গভীর সহানুভূতি নিয়ে ব্যতিক্রমবিহীন অবয়বে পূর্ব আফ্রিকার ঔপনিবেশিকতা ও শিকড়চ্যুত দেশান্তরী মানুষের জীবন, সুখ, দুঃখ ও আশার বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া পরিস্ফুটিত করেছেন। গুরনাহর মাতৃভাষা ও প্রথম ভাষা সোয়াহিলী। ইংল্যান্ডে শিক্ষার শুরু থেকে তিনি তার সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ইংরেজীকে গ্রহণ ও ব্যবহার করেছেন। তার ইংরেজী গদ্যে সোয়াহিলী, আরবী ও জার্মান ভাষার ভাবধারার চিহ্ন বিদ্যমান। তিনি কোরান, আরবী ও ফার্সি পদ্য, বিশেষত আরব্য রজনী থেকে কাহিনী ও কল্পিক উপকরণ গ্রহণ ও ব্যবহার করেছেন। তার লেখা ইংরেজী পাঠক মহলে যেমন সমাদৃত তেমন আফ্রিকান সমাজে এখনও নয়। উপন্যাসিক মাজা মেলজিসটে এই প্রেক্ষিতে বলেছেন যে, গুরনাহ যেসব মানুষের কাহিনী বলেছেন তাদের কাহিনী সচরাচর শোনা হয় না সত্তে¡ও পাঠককে জোর দিয়ে শুনতে হয়। ১৯৯৬ সালে নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রখ্যাত লরা উইনটারস তার ‘নিস্তব্ধতার প্রশংসা’র বিষয়ে বলেছেন যে, গুরনাহ কুশলীর মতো এক মানুষের কষ্টের কথা তুলে ধরেছেন, যিনি দুই সংস্কৃতির মাঝখানে আটকে পড়ে আছেন এবং সেই সংস্কৃতি দুটির একটি অন্যটির সঙ্গে তার সংস্রবতা সত্তে¡ও তাকে আপন করে নেয় না। তথাপি একথা অনস্বীকার্য যে, গুরনাহ সমকালীন আফ্রিকান লেখকদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে আছেন। গুরনাহ তার লেখায় ঔপনিবেশিকবাদ যেভাবে বিশ্বের সবকিছুতে পরিবর্তন এনেছে এবং যেসব জনগণ এই সমাজ ব্যবস্থায় এখনও বেঁচে থেকে এর অভিঘাতের শিকার হচ্ছে, তাদের কথা ও কাহিনী বলতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন যে, ঔপনিবেশিকতার আবরণে আগে ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে যারা ভিন্নতর দেশে আস্তানা নিয়েছিল, তাদের তুলনায় ঐসব দেশ থেকে সমকালে সম্পদশালী দেশে আসা মানুষের সংখ্যা অনেক কম। সেই প্রেক্ষিতে ইউরোপ ও আমেরিকায় সমকালীন শরণার্থী ও অভিবাসীদের প্রতিক‚লে স্থানীয় জনগণের বিরোধিতা ক্ষুদ্র মানসিকতার পরিচায়ক এবং অগ্রহণীয়। তার কতিপয় ছোটগল্পের মধ্যে ‘আমার মা আফ্রিকার এক কৃষি খামারে থাকতেন’ (২০০৬), বা ‘আগমনকারীর গল্প’ (২০১৬) কিংবা ‘ রাষ্ট্রবিহীন ব্যক্তির কথা (২০১৯), ‘বন’ (২০০১) ও ‘মধ্যপ্রাতের চাঁদ’ (২০১১) এই উপলব্ধিকে শাণিত করেছে। সাহিত্য সমালোচক ব্রæস কিং-এর বীক্ষণে সব লেখাতেই গুরনাহ আফ্রিকানদের বৃহত্তর ও পরিবর্তনশীল পৃথিবীর অংশ হিসেবে তুলে ধরেছেন। জেমস বল্ডইনের বহুসমাদৃত উপলব্ধিতে সেই পটে বলা যেতে পারে, ‘তুমি যদি জান কোথা থেকে তুমি এসেছ, তাহলে তুমি যেখানে যেতে চাও বা পার তার কোন সীমানা থাকে না’ (দ্রষ্টব্য: ‘এশিয়ান আমেরিকান পরিচিতির ধাঁধা’-জে কাসপিয়ান কাঙ্গ, নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন, অক্টোবর ১০, ২০২১)। এই অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনে বসে এসব পড়ে ও দেখে গুরনাহর উপলব্ধির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহীতা এশিয়ান হিসেবে আমার ভাবনা-চিন্তাগুলো এদেশে নবাগতদের ভাবনাগুচ্ছের সঙ্গে মিশে গেছে বলেই মনে হয়। গতবছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন মার্কিন কবি লুইসে গুলুক, যিনি নোবেল কমিটির মূল্যায়নে স্বল্প অবয়বের সুন্দরকে সৌন্দর্য আবরিত করে ব্যক্তি-অস্তিত্বকে বিশ্বায়িত করেছেন। ২০১৮ এ বিলম্বিত নোবেল দেয়া হয়েছিল পোলিশ উপন্যাসিক ওলগা তোকারচযককে। ২০১৯-এ দেয়া হয়েছিল অস্ট্রিয়ান নাট্যকার লেখক পিটার হান্ডককে। অস্ট্রিয়ান পিটার হান্ডক ১৯৯০-এর দশকে ইউরোপের তার এলাকার গণহত্যাকে অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন। সেই গণহত্যায় বলকান যুদ্ধের পথক্রমে প্রায় ৮০০০ মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল বলে পরবর্তীকালে জানা গেছে। আলবেনিয়া, বসনিয়া এবং কসোভোতে এর প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। ২০১০ এর দিকে কসোভোতে সফরকালীন এর কাহিনী কসোভোর নেতৃবৃন্দ থেকে আমি শুনেছি। এই সকল পুরস্কার প্রাপ্তদের মধ্যে ২০২১ এর নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক আবদুল রাযাক গুরনাহ (৭২) নিজেকে সকলের কাছে গ্রহণ ও সমর্থনযোগ্য প্রাপক হিসেবে প্রতিভাত করতে সমর্থ হয়েছেন। বস্তুত ১৯৮৮ সালে মিসরের নাগিব মাহফুজ এবং ১৯৯১ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার নাদিন গর্ডিমারের পৃথিবীব্যাপী গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে তানজানিয়ার আবদুল রাযাক গুরনাহ নিজেকে সেই পর্যায়ে স্বীকৃতির দাবিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। লেখক : এমপি ও সাবেক মন্ত্রী
×