ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড্রেজার মেশিন তান্ডবে হুমকীতে পাহাড়ি টিলা, ছড়া ও নদী

প্রকাশিত: ১৮:০৪, ১৬ অক্টোবর ২০২১

ড্রেজার মেশিন তান্ডবে হুমকীতে পাহাড়ি টিলা, ছড়া ও নদী

নিজস্ব সংবাদদাতা, হবিগঞ্জ ॥ ড্রেজার মেশিন তান্ডবে হবিগঞ্জ জেলার পাহাড়ি এলাকায় টিলা ধসে পড়ছে। এতে জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। এর প্রতিকারে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। ধসের কারণে দিন দিন টিলাগুলো ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, পাহাড়ি ছড়া ও ছড়ায় সংযোগ নদীগুলোও হুমকীতে রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একশ্রেণীর অসাধু লোক জেলার পাহাড়ি এলাকাখ্যাত মাধবপুর, চুনারুঘাট, বাহুবল ও নবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন টিলা, ছড়া ও ছড়ার সাথে সংযোগ নদীতে ড্রেজার মেশিন স্থাপন করে অবাধে বালু উত্তোলন করছে। এসব বালু বিক্রি করে তারা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এতে ছড়ার পাশে থাকা টিলাগুলো ধসে পড়ছে। হারাচ্ছে নদীর রুপরেখা। আর ছড়াগুলো প্রশস্ত হওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ি এলাকার রাস্তা-ব্রিজ ও কালভার্টগুলোয় বিরূপ প্রভাব পড়ছে। অনেক স্থানে ব্রিজের গোড়ার মাটি সরে যাচ্ছে। ধসে পড়ছে রাস্তার পাশগুলো। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, অবাধে বালু উত্তোলন হচ্ছে। এতে নদী রুপরেখা হারাচ্ছে। টিলা ধসে পড়ছে। পাহাড়ি এলাকার ব্রিজ ও রাস্তা হুমকীতে রয়েছে। জেলার পাহাড়ি এলাকায় মাটির নিচে রয়েছে গ্যাস। আর মাটির ওপর উৎপাদন হচ্ছে চা, রাবার, লেবু, কমলা, মাল্টাসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য। এসব ফল, ফসল উৎপাদনে লাখ লাখ মানুষ নিয়োজিত থাকায় জীবিকার পথ তৈরি হয়েছে। সরকারও পাচ্ছে পর্যাপ্ত রাজস্ব। এর চেয়েও বড় কথা, পরিবেশ রক্ষায় বিরাট ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে এসব পাহাড়, টিলা, ছড়া ও নদী। এখানকার গাছ-গাছালির উপস্থিতি মাটি ও পাহাড়-টিলা ধস ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবাধে ছড়ার বালু তোলায় পাহাড়-টিলার গাছ-গাছালির অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই গাছগুলো পাহাড়-টিলাকে ধরে রাখতে পারে না। এতে অনেক সময় এগুলো ছড়ায় ধসে পড়ে। অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে কার্যকর ভূমিকা প্রয়োজন। এদিকে বালু উত্তোলন নিয়ে দুলাল মিয়া নামে পরিবেশ প্রেমিক বানরের কলা খাওয়ার গল্প শোনালেন। তিনি বলেন, বানর এক সাথে পুরো কলার ছড়া খেতে পারে না। তাই সে কৌশল নেয়। আস্তে ধীরে ছড়া থেকে একটি করে কলা খায়। একসময় পুরো ছড়ার কলা শেষ হয়। এ গল্পটি ভালোভাবে জানেন অবৈধ বালু ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে তারা প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন। তারপরেই বালু উত্তোলনে নামেন। অবৈধ বালু উত্তোলনকারীরা বানরের মতো ধীরে ধীরে জেলার মাধবপুর, নবীগঞ্জ, চুনারুঘাট ও বাহুবল উপজেলার পাহাড়ি টিলা, ছড়া ও নদী থেকে নানা কৌশলে ড্রেজার মেশিনে বালু উত্তোলন করছেন। কিছু দিন চুরি বন্ধ থাকলেও স্থায়ীভাবে বন্ধ হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন কঠোর হন। পাইপ ও ড্রেজার মেশিন জব্দ করে পুড়িয়ে দেন। বালু চোরদের দন্ডও দেয়া হয়। কিন্তু অসাধুদের নগদ টাকা দিয়ে আবারো শুরু হয় ড্রেজার মেশিন তান্ডব। এ তান্ডবে পড়ে পাহাড়ি টিলা ও ছড়া আর নদীগুলো রূপরেখা হারিয়ে বিপন্ন হচ্ছে। সূত্র জানায়, অবৈধ বালু ব্যবসায়ীরা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠায় হুমকির মুখে পড়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। এখানে প্রশাসন অভিযান চালালে থামে। অভিযান শেষ হলেই আবারো শুরু হয় বালু উত্তোলন। এর মধ্যে চুনারুঘাটের পানছড়ি পাহাড়ি টিলার নিচে ড্রেজার মেশিন স্থাপন করে অবাধে চলছে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব। দিনের পর দিন অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে বেহাল হয়েছে ওই এলাকার রাস্তাঘাট। শুধু তাই নয়, টিলা কেটে বালু উত্তোলনের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে পানছড়ি আশ্রয়ণ এলাকাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ। আশ্রয়ণ কেন্দ্রটি চুনারুঘাট উপজেলার শানখলা ইউনিয়নের রঘুনন্দন পাহাড়ি এলাকায় অবস্থিত। জানা গেছে, পাহাড়ি টিলার নিচে ড্রেজার মেশিন স্থাপন করে বালু উত্তোলনকারীরা। এই মেশিনের মাধ্যমে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। তারপর ট্রাক্টর বোঝাই করে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বালুর স্তুপগুলো। বিক্রির সুবিধার জন্য বালু রাখা হচ্ছে বদরগাজী এলাকায়। একইভাবে দেউন্দি, লালচান্দ বাগান এলাকার ছড়া ও টিলা থেকে ড্রেজারে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করা হচ্ছে। আর এতে করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্রটি। বালু উত্তোলনকারীরা খুবই প্রভাবশালী। তাদের প্রভাবের কাছে এখানকার সবাই দুর্বল। এভাবে বালু উত্তোলন করায় অনেক স্থানে টিলা এখন পুকুর হয়ে গেছে। আরো বহু টিলা রয়েছে হুমকিতে। সময় সুযোগে চুনারুঘাট উপজেলার গাদাছড়া, শ্রীবাড়ি এলাকাসহ পাহাড়ি এলাকার স্থানে বালু উত্তোলন চলছে। বাহুবল উপজেলার পাহাড়ি এলাকার ভবানীপুরের একটি টিলার নাম সেগুন টিলা। এখানের টিলায় ছিল সেগুন গাছ। এখন সেগুন গাছ নেই। আর কীভাবে থাকবে, এখানের সেই টিলাই নেই। টিলাগুলো কেটে বালু মাটি বিক্রি করায় এ স্থানে বিশাল বিশাল গর্ত দেখা দিয়েছে। পরিদর্শনকালে এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে। পরিবেশ অধিদফতর হবিগঞ্জের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন- শুধু যোগদান করেছি। কোথায় বালু উত্তোলন হচ্ছে তা জানা নেই। হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান জানান, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন কঠোর ভূমিকা পালন করছে। এ ব্যাপারে কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। হবেও না।
×