ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

প্রকাশিত: ২০:১১, ১৬ অক্টোবর ২০২১

প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

পরিবারে একটু সচ্ছলতা আনতে অনেক নারীই বিদেশে গেছেন, এখনও অনেকে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছেন। কিন্তু কষ্টের প্রবাস থেকে ফিরেও জীবনখাতায় শূন্য দেখছেন বেশিরভাগ। গত পাঁচ বছরে প্রবাস থেকে ৪৮৭ নারীর মৃতদেহ এসেছে দেশে। এর মধ্যে আত্মহত্যা করেন ৮৬ জন। স্ট্রোকে মারা যান ১৬৭ জন ও দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৭১ জন, ১১৫ জনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। লাশ হয়ে ফেরা ছাড়াও শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনসহ প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক নারীই দেশে ফিরে আসেন বলে জানায় বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাক ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)। ‘এক লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিলাম। ১১ মাসের মাথায় ফিরে আসতে হয়েছে। ওরা কাজ করায়, কিন্তু বেতন দেয় না। কোন টাকা নিয়ে আসতে পারিনি। যার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলাম তাকে ফেরত দিতে পারিনি। তিনি এখন হুমকি দিচ্ছেন, মামলা করবেন। স্বামীও ছেড়ে চলে গেছেন। চার মেয়েকে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন পার করছি।’ করোনা মহামারীর মধ্যে সৌদি আরব থেকে কাজ হারিয়ে দেশে ফেরা গাজীপুরের কালিয়াকৈরের রত্না আক্তার ডয়চে ভেলের সঙ্গে বলেছিলেন তার কষ্টের কাহিনী। ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৭৯৩ জন নারী শ্রমিক প্রবাসে মৃত্যুবরণ করেছেন। সম্প্রতি সরকার থেকে প্রকাশিত এক তথ্য বিবরণীতে এ সংখ্যা পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে জর্ডান গিয়েছিলেন মৌসুমি আক্তার। সম্প্রতি তার মৃতদেহ ফিরেছে বাংলাদেশে। ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা ছিল স্ট্রোক করে মারা গেছেন মৌসুমি। পরিবার বলছে নির্যাতনে মারা গেছেন তিনি। মৌসুমির চাচা মোহাম্মদ ইমরান খান বলেন, মৌসুমির মৃতদেহে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। প্রবাস ফেরত এক নারীর তথ্য প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে বাংলাদেশ সংবাদ মাধ্যমে। তাতে বলা হয়েছে, সাত মাস আগে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে গিয়ে নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে দেশে ফিরেছেন। সম্প্রতি রিয়াদ বিমানবন্দরের উড়োজাহাজে বসে এক আরবকে নির্যাতনের বর্ণনা দেন তিনি। তার বক্তব্য ভিডিও করেন ঐ আরব। ভিডিওতে ঐ নারীর এক হাতে ক্ষত চিহ্ন, আরেক হাতে গোটা গোটা ফোস্কা দেখা যায়। এক প্রশ্নের জবাবে ঐ নারী বলেন, সৌদি আরবে কাজে আসার পর প্রতিদিন তাকে ছয় থেকে সাতবার গরম কিছু দিয়ে ছ্যাকা দেয়া হতো। ঐ ছ্যাকাতেই হাতে ফোস্কা হয়েছে। নির্যাতনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশে কারও সঙ্গে, বিশেষ করে স্বামীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে মালিক দিত না। দেশে ফিরতে চাইলে নির্যাতন করা হতো। এভাবে নির্যাতনের পর সৌদি মালিক তাকে বিমানবন্দরে রেখে চলে যায়। এই কয় মাস তাকে কোন বেতন দেয়া হয়নি। কিন্তু বিমানবন্দরে রেখে যাওয়ার সময় বেতন দিয়েছেন মর্মে স্বাক্ষর নিয়ে গেছেন মালিক। ভিসা ও পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী নির্যাতিত ঐ নারীর বাড়ি চুয়াডাঙ্গায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কিশোরী উম্মে কুলসুম (১৪) পাসপোর্টে বয়স ২৬ দেখিয়ে সৌদি আরব যান ২০১৯ সালে। গৃহকর্মী হিসেবে সৌদিতে যাওয়ার পর সাত মাস নিয়মিত টাকা পাঠান। হঠাৎ পরিবারের সঙ্গে তার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ছয় মাস পর কুলসুম ফোন করে জানান মালিক মেরে তার হাত-পা, কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে। ২০২০ সালে ১০ আগস্ট মেয়ের মৃত্যুর খবর পায় কুলসুমের পরিবার। এখন পর্যন্ত পরিবারটি কোন আর্থিক সহায়তা পায়নি। এ নারীদের অনেকেই যাচ্ছেন দালালদের খপ্পরে পড়ে। ফলে বিদেশে যাওয়ার পর তারা দাস-দাসীর মতো আচরণের শিকার হচ্ছেন। যেমন- তাদের ঠিকমত খেতে দেয়া হয় না, বেতন চাইলে তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। সৌদি আরব যখন বাংলাদেশী পুরুষ শ্রমিকের নিয়োগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় তখন বাংলাদেশের একটা বড় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালের এপ্রিলের মাঝে নয় সদস্যের এক সৌদি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সারা খাদ্দামা বা নারী শ্রমিক পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। তখন রটিয়ে দেয়া হয় সৌদি শ্রমবাজার খুলে গেছে। নারী দিয়ে শুরু হবে, পরে পুরুষরাও যাবে। মূলত নারী শ্রমিকদের এক প্রকার ব্যবহার করার উদ্দেশ্যই এখানে প্রকট। নারী কর্মীদের কেউ কেউ আবার ধর্ষণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে বা সন্তান নিয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন। পান না ধর্ষণ-নির্যাতনের বিচার। সন্তান নিয়ে দেশে ফেরা এক নারী একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় জানান, বাড়ির মালিকের ছেলে তাকে ধর্ষণ করেছে একথা ছেলের মা-বাবাকে জানাতে ছেলে নিষেধ করেন। উপায় না পেয়ে জানালে পেটের বাচ্চাকে মেরে ফেলার জন্য আনারসের জুস খাওয়ানো, বড় বড় জাজিম বা তোষক নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করানো, সিঁড়ি থেকে ফেলে দেয়াসহ বিভিন্ন চেষ্টাই করেছেন ছেলের মা। শেষ পর্যন্ত বাড়ির মালিক জেলখানায় পাঠিয়ে দেন। জেলখানায় সন্তানের জন্ম হয়। আদালত বা চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার সময় এই নারীকে হাত ও পায়ে হাতকড়া পড়ানো হতো। প্রবাসে নির্যাতনের মাত্রা এত বেশি যে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফিরেছেন অনেকে। আবার অনেকে বিদেশে মারাও যাচ্ছেন। এরপরও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নারীরা যাচ্ছেন পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে, নিজেদের ভবিষ্যত বদলের আশায়। নারীদের চেয়ে পুরুষদের আয় বেশি হলেও পুরুষ শ্রমিকরা আয়ের ৭০-৮০ শতাংশ দেশে পাঠান। তবে নারী কর্মীরা তাদের আয়ের প্রায় পুরোটাই পাঠান। রিফিউজি ইউনিটের তথ্যমতে, কোভিড-১৯-এর সময় নারী শ্রমিকরা বেশি হারে টাকা পাঠিয়েছেন, যা ৬৯ শতাংশ। সংসারে নিদারুণ কষ্ট আর অভাব না থাকলে কোন মা-বাবা তার আদরের সন্তানকে, স্বামী তার স্ত্রীকে, সন্তান তার মাকে প্রবাসের অচেনা-অজানা স্থানে পাঠাতে চায় না। দেশে ভাতের কষ্ট, কাপড়ে কষ্ট, টাকার কষ্ট। সে কষ্টের কি আর শেষ আছে! এসব প্রবাসী নারীর পাশে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ শেখ হাসিনার সরকারকে দাঁড়াতে হবে। অসাধু ট্রাভেল এজেন্সি, লোভী, অসৎ ও অসাধু দালালদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে। পুরুষ শ্রমিকদের শ্রমবাজার পেতে নারী শ্রমিকদের যেন আমরা ব্যবহার না করি সে বিষয়ে তৎপর হতে হবে। বয়স বিবেচনা করে উপযুক্ত দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ এবং সঠিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দিতে হবে। উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা প্রবর্তন যা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে এবং ক্রমান্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিকাঠামো প্রণয়নে প্রশাসনকে উদ্যোগী হতে হবে। লেখক : শিক্ষার্থী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×