ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুজিবশতবর্ষেই তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরুর দাবি

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ১৫ অক্টোবর ২০২১

মুজিবশতবর্ষেই তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরুর দাবি

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর ॥ দেশের সবচেয়ে দরিদ্র বিভাগ রংপুর। আর সবচেয়ে গরিব জেলাগুলোর পাঁচটি রয়েছে সর্বনাশা তিস্তাজুড়ে। ‘পাগলা নদী’ খ্যাত তিস্তা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার নাম। এই পাঁচ জেলার বুকচিড়ে প্রায় ২৩৫ বছরের পুরনো তিস্তার প্রবাহ। প্রতিবছরই এ অঞ্চলে বন্যা ও খরায় মানুষের দীর্ঘশ্বাস ভারি হচ্ছে। নদীপাড়ের মানুষের বসত-ভিটে, ফসল-ফলাদি, সুখ-শান্তি কেড়ে নেয়া তিস্তা নিজেও ভাল নেই। শুকনো মৌসুমে তিস্তার চারদিকে দেখা যায় ধুধু বালুচর। আবার বর্ষাকালে প্রবল পানির তোড়ে ঝুঁকির মুখে পড়ে তিস্তা তীরবর্তী মানুষ। এদিকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি বাঁচানোসহ ৬ দফা দাবিতে আগামী ১৫ নবেম্বর লংমার্চ কর্মসূচী ঘোষণা করেছে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ ভারতের উজান থেকে ভাটির দেশ বাংলার নরম মাটিতে তিস্তা যেন অভিশপ্ত নদী। অভিশাপের এ অপবাদ থেকে মুক্তির বার্তা শোনা গেছে বহুবার। তবে বছর তিনেক আগে জানা যায়, তিস্তা নদীর বিস্তৃত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুজ্জীবনে একটি মহাপরিকল্পনার কথা। তিস্তার দুইপাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর। আর এজন্য ব্যয় হতে পারে আনুমানিক নয় হাজার কোটি টাকা। এ প্রজেক্টের নাম দেয়া হয় ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড রেস্টোরেশন’। এরপর থেকে দিন যায়, মাস যায়। বছর ঘুরে, বছর আসে। তবুও শুরু হয়নি বহুল আকাক্সক্ষার তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ। চলতি বছর মুজিব শতবর্ষ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা শুরুর দাবি জানিয়েছেন রংপুর অঞ্চলের বিশিষ্টজনসহ তিস্তাপাড়ের মানুষ। তাদের বিশ্বাস, এই শুভ সময়ে যদি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে সরকার, তা হবে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন হলে পানির জন্য ভারতের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। বরং বিজ্ঞানসম্মত সুরক্ষায় যেমন বাঁচবে তিস্তা নদী। তেমনি মরুভূমি হবার সম্ভাবনা থেকে বাঁচবে এ অঞ্চল। একই সঙ্গে তিস্তা নদী নির্ভরশীল প্রায় এক কোটি মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। সৃষ্টি হবে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। বদলে যাবে কৃষিনির্ভর নদীপাড়ের জীবনরেখা। মিলবে সুদিন, টেকসই মুক্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। তিস্তা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ এলাকায় পানি নেই। নদীতে অসংখ্য চর পড়েছে। কোথাও কোথাও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় নদী দুইভাগ, তিনভাগ হয়ে সরু নালার মতো প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ গত মাসের মধ্যভাগেও তিস্তার পেট ফুলেছিল বন্যার পানিতে। এখন সেই তিস্তায় অসংখ্য চর জেগেছে। শুকনো মৌসুমে ভারতের পানির ওপর নির্ভরতা থাকায় তিস্তা অববাহিকার পাঁচ জেলা নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় পানির জন্য হাহাকার দেখা দেয়। তখন এ অঞ্চলের মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে তিস্তার ধু-ধু বালুচর হয়ে উঠবে সবুজে সবুজময়। পানির জন্য কষ্ট হলেও কৃষিনির্ভর মানুষগুলো ব্যস্ত হবে নদী অববাহিকায় ফসল উৎপাদনে। তিস্তাবেষ্টিত নীলফামারী এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা বলেন, আমরা ত্রাণ চাই না। আমাদের নদী খনন করা হোক। বাঁধ দেয়া হোক। শুনেছি চীনের সঙ্গে সরকার চুক্তি করবে। তিস্তার পাড়ের দুইধারে খনন, বাঁধ, বড় বড় রাস্তা করবে। শহরের মতো এখানে বিদেশী ও পর্যটন হবে। তিস্তাপাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী। আমরা তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ দেখতে চাই। একই দাবি তিস্তা নদীর রংপুরের পীরগাছা, গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া উপজেলার, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, আদিতমারী উপজেলার, কুড়িগ্রামের উলিপুর, রাজারহাট, চিলমারী, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত হাজারো মানুষের। তিস্তা মহাপরিকল্পনায় যা থাকবে ॥ রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, এই প্রকল্পটিতে তিস্তার উপকূল ব্যবস্থাপনা বিষয়ক নানা অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং গ্রীষ্মকালে পানি সঙ্কট দূর করতে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেহেতু তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে দীর্ঘদিনের যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, তা কাটিয়ে শুকনো মৌসুমে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হবে। প্রকল্পটিতে এখনও পর্যন্ত যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে তার মধ্যে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে নদীগর্ভে ড্রেজিং করা, রিভেটমেন্ট বা পাড় সংস্কার ও বাঁধানো এবং ভূমি পুনরুদ্ধার। এছাড়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মেরামতেরও পরিকল্পনা রয়েছে। ‘তিস্তা রিভার কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড রেস্টোরেশন’ নামের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে তিস্তা নদীর ডান-বাম উভয় তীর ঘেঁষে ২২০ কিমি উঁচু গাইড বাঁধ, রিভার ড্রাইভ, হোটেল-মোটেল-রেস্তরাঁ, আধুনিক শহর ও পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠবে। সেই সঙ্গে তৈরি হবে ১৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুতকেন্দ্র, শিল্পকারখানা, ইপিজেড। এছাড়া কয়েক লাখ হেক্টর কৃষিজমি উদ্ধার, বনায়ন করা হবে। এ প্রকল্পের অধীনে তিস্তার মূলপ্রবাহ থাকবে দুই কিমি, যা নাব্য ধরে রাখবে সারাবছর এবং কয়েকটি ক্যানেল দ্বারা থাকবে সংযুক্ত। যার সুফল পাবেন তিস্তার দুই পাড়ের কোটি মানুষ। বলা চলে মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে চীনের হোয়াং হো নদী ও সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়কে আধুনিকভাবে গড়ে তোলা হবে। বাঁধের দুই পাশে থাকবে মেরিন ড্রাইভ। তৈরি হবে আধুনিক সেচ প্রকল্প ও যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ কৃষি খামার। একই সঙ্গে নদীর দুই পাড়ে গড়ে উঠবে স্যাটেলাইট শহর। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা এবং বিজ্ঞানসম্মতভাবে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতি বাঁচানোসহ ৬ দফা দাবিতে আগামী ১৫ নবেম্বর লংমার্চ কর্মসূচী ঘোষণা করেছে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ। এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ জরুরী ভিত্তিতে নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন নদী নিয়ে কাজ করে এ ধরনের একাধিক সংগঠনের নেতারা। নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ১৭৮৭ সালে ভয়াবহ বন্যার সময়ে তিস্তা নদীর প্রবাহের সৃষ্টি। ২৩৪ বছর আগে তৈরি হওয়া এ নদীর আজ অবধি কোন পরিচর্যা করা হয়নি। বৃটিশ আমল, পাকিস্তান পর্ব এবং বাংলাদেশ যুগের কোন সময়েই এ নদীর সঠিক পরিচর্যা হয়নি। বরং দফায় দফায় এ নদীর সর্বনাশ করার নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ফলে যে নদী হয়ে ওঠার কথা ছিল উত্তরের জীবনরেখা, সেটা হয়ে উঠেছে উত্তরের অভিশাপ। নদীকে যদি আমরা অভিশাপের হাত থেকে আশীর্বাদে পরিণত করতে চাই, তাহলে এই তিস্তা নদীর সুরক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, তিস্তা নদীতে বিজ্ঞানসম্মত খনন চাই। নদীর দুপাড়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে এর সুরক্ষা চাই। এই সুরক্ষা দিতে গিয়ে এটি মহাপরিকল্পনার নামে হবে, নাকি অন্য কোন পরিকল্পনায় হবে তা আমাদের অজানা। আমরা জানি না এর অর্থায়ন বিদেশ থেকে নিতে হবে, নাকি দেশ থেকে নিতে হবে। দেশের একটা বৃহৎ জীবনরেখাকে বাঁচাতে হলে এ নদীর পরিচর্যা করতেই হবে। এ অঞ্চলের অর্থনীতিসহ তিস্তা নদী ও নদীপাড়ের মানুষকে বাঁচাতে সুপরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত সুরক্ষার বিকল্প নেই। প্রথমত এটা নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা থাকা দরকার। ঐতিহাসিক মুজিব শতবর্ষে তিস্তার মহাপ্রকল্পে কাজের শুরু দেখতে এখন নদীপাড়ের মানুষ মুখিয়ে আছেন। তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, তিস্তা নদী এ অঞ্চলের মানুষের জীবনরেখা। তিস্তার অব্যাহত ভাঙ্গনে দুই পাড়ের মানুষের জীবন, সম্পদ এবং কৃষিজমি সব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই দুরবস্থা লাঘবে তিস্তা নদী বিজ্ঞানসম্মতভাবে সুরক্ষা জরুরী। দুই কিমি প্রস্থের নদী এখন ১০-১২ কিমিতে পরিণত হয়েছে। ভাঙ্গন, বন্যা ও খরার হাত থেকে এ অঞ্চলের মানুষকে রক্ষায় মুজিব শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এ বছরেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর দৃৃৃৃৃষ্টি আকর্ষণ করছি। চীনা প্রকৌশলীদের একটি প্রতিনিধি দল ডালিয়া ব্যারাজ ও তিস্তার নদীর বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছেন। বর্তমানে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে আটকে আছে। এই প্রকল্পে অর্থায়ন কে করবে বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়ায় ফাইল পরিকল্পনা কমিশনের লালফিতায় বন্দী হয়ে আছে। নাম না প্রকাশের শর্তে এসব তথ্য জানিয়েছেন রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা। সম্প্রতি একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলে ‘উত্তরের উন্নয়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা’ বিষয়ক বিশেষ টকশোতে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেন, তিস্তা নদী খনন করে পানির প্রবাহ সঠিক মানে রাখতে প্রধানমন্ত্রী চিন্তাভাবনা করেছেন। এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যখন চীন সফরে গিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্টকে এ নিয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন। এখন সেই মোতাবেক কাজ হচ্ছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত পেলে পরে কাজ শুরু করতে পারব। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে শুষ্ক মৌসুমে সৃষ্ট খরায় পানিশূন্যতা থেকে রেহাই মিলবে। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ বলেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়টি সরকারের ওপর মহলের। তবে চায়না পাওয়ার কোম্পানি নির্মিতব্য প্রকল্প বাস্তবায়নে নক্সা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে। ২০২২ সালের মধ্যে কাজ শুরু করা গেলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, দ্রুত এ প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। জানা যায়, তিস্তা ভারতের সোলামো লেক থেকে উৎপন্ন হওয়ার পর সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রংপুর অঞ্চলের ওপর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। পরে এটি কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীর কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। দীর্ঘবছর ধরে তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে একটি তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের দাবি উঠেছে। কিন্তু ভারতের কালক্ষেপণ আর নানান অজুহাতে আটকে আছে সেই চুক্তি। এ কারণে রংপুর অঞ্চলের মানুষ এখন তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন।
×