ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি ॥ ভুলিনি সেই বিভীষিকাময় রাত্রি

প্রকাশিত: ২১:২৪, ১৫ অক্টোবর ২০২১

জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি ॥ ভুলিনি সেই বিভীষিকাময় রাত্রি

১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস। ১৯৮৫ সালের এই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের অডিটরিয়াম ভবনের ছাদ ধসে ৩৯ ছাত্র নিহত এবং প্রায় তিন শতাধিক ছাত্র আহত হয়েছিলেন। বিশ্বের কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্ঘটনায় এত বিপুলসংখ্যক ছাত্রের হতাহতের ঘটনা এর আগে ঘটেছে কিনা আমাদের জানা নেই। আর যেন কখনই কোথাও না ঘটে, সেটাই আমাদের প্রার্থনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র হিসেবে অল্পের জন্য সেই দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা এত বছর পরেও বিস্মৃত হইনি। মনে হলে আজও শিউরে উঠি। সেদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্গাপূজার ছুটি শুরু হয়েছিল। পরদিন অধিকাংশ ছাত্রের বাড়ি যাবার কথা ছিল। রাতে টেলিভিশনে একটি জনপ্রিয় নাটক ‘শুকতারা’ প্রচারিত হচ্ছিল। ছাত্ররা সেই নাটক দেখার জন্য অডিটরিয়াম ভবনে সমবেত হয়। তখন ভবনের ছাদ মেরামতের কাজ চলছিল। আমি নিজেও এলাকার অগ্রজ অশোক সাহা এবং সহপাঠী গৌতম মল্লিকের সঙ্গে অডিটরিয়ামে টেলিভিশন সেটের কাছাকাছি বসেছিলাম। খবর শুরু হতেই ভাবলাম নাটক শেষে খাবার খেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। অশোকদা এবং বন্ধু গৌতমকে সিট রাখার কথা বলে খাবারের জন্য বেড়িয়ে যাই। আর এতেই রক্ষা পেয়ে যাই সেই দুর্ঘটনার হাত থেকে। পরে অশোকদাকে খুঁজে পাই হলের শহীদ মিনারের পাদদেশে রাখা লাশের সারিতে। বন্ধু গৌতমকে খুঁজে পেলাম আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যালের বিছানায়। এর দুদিন আগেই অশোকদার সঙ্গে পরিচয় । সদ্য সরকারী চাকরি পাওয়ায় খুব খুশি ছিলেন। আমাকে অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস নিয়োগপত্র হাতে আসার আগেই হয়ে গেলেন লাশ। সেসময় হলে প্রতিদ্ব›দ্বী ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছিল। আক্রমণ এবং পাল্টা আক্রমণ ছিল নিয়মিত ঘটনা। কয়েকদিন ধরেই সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠন নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের হল আক্রমণের গুজব চলছিল। আমরা ডাইনিং রুমে, খাবারের মাঝপথে। হঠাৎ দমকা বাতাসের সঙ্গে এক বিকট শব্দ। একই সঙ্গে কিছু মানুষের চিৎকার ও কান্নার আওয়াজ। আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ হল আক্রমণ করেছে। খাবার ফেলেই হলের পুকুরপারের কর্মচারীদের বাসার দিকে দৌড়াতে থাকি। কিছুদূর যেতেই ভুল ভাঙ্গল। কোন আক্রমণ নয়, অডিটরিয়ামের ছাদ ধসে পড়েছে। ছুটে এলাম অডিটরিয়ামের সামনে এবং শুনতে পেলাম ভেতর থেকে বাঁচাও বাঁচাও আর্তচিৎকার। অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে আমাদের পক্ষে সেখান থেকে আহতদের উদ্ধার করার উপায় ছিল না। শুধু দরজার সামনে দাঁড়ানো যেসব ছাত্র আঘাত পেয়েছে তাদের নিয়েই হাসপাতালে যেতে পেরেছিলাম। ভয়াবহ দুর্ঘটনায় এত বিপুল সংখ্যক আহত ছাত্রের সেবা দেয়ার জন্য হাসপাতালগুলোর জরুরী বিভাগ মোটেই প্রস্তুত ছিল না। প্রথম দিকে কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও ঘটে। ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে ডাক্তার-নার্সরা সর্বশক্তি নিয়োগ করে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার কাজে গতি পায় এবং শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে রাখা লাশের সারিও বাড়তে থাকে। মাঝ রাতের মধ্যেই পঁচিশজন ছাত্রের লাশ রাখা হয়। হঠাৎ লাশের সারি থেকে একজন ছাত্রের দেহ নড়েচড়ে ওঠে এবং বেঁচে থাকার আকুতি জানায়। মুহূর্তের মধ্যে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাকে বাঁচানো যায়নি। হাসপাতালে নেয়ার পথেই তার মৃত্যু হয। উদ্ধার কাজ শেষ হতে সকাল হয়ে যায়। তখন পর্যন্ত পঁয়ত্রিশ ছাত্রের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। পরে আরও কয়েকজন আহত ছাত্র হাসপাতালে মারা যান। ইতোমধ্যে এই দুর্ঘটনার খবর দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আহতদের সহযোগিতা এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সকল মহল থেকেই সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া হয়। দুর্ঘটনার পর জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এমনকি সমগ্র ঢাকা শহরে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। বাংলদেশ যে সত্যিকার অর্থেই একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ তাও প্রমাণিত হয়েছিল সেই দুর্ঘটনায়। যে রিক্সাওয়ালাদের সঙ্গে ছাত্রদের ভাড়া নিয়ে বাগ্বিতণ্ডা নিত্যদিনের ঘটনা সেই রিক্সাওয়ালারাও আগ্রহভরে বিনা ভাড়ায় আহত ছাত্রদের নিয়ে গেছে বিভিন্ন হাসপাতালে। বিপুলসংখ্যক ছাত্রজনতা রক্তদানের জন্য এগিয়ে এসেছিল। পরদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। প্রতিক‚ল আবহাওয়া উপেক্ষা করে বৃষ্টিতে ভিজে ধর্মবর্ণ দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ জগ্ননাথ হলের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছে শুধু নিহত ছাত্রদের এক পলক দেখার জন্য এবং শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। জগ্ননাথ হলের অনেক ছাত্র ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাসায় ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়াত। তাদের অভিভাবকরাও ছুটে এসেছিল খোঁজ নিতে। অনেকে সুচিকিৎসার জন্য আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন অকপটে। তখন মোবাইল ফোন ছিল না। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ছুটে আসা ঢাকা শহরের বাসিন্দারা হলে যাদের পেয়েছেন তাদের কাছেই ঠিকানা রেখে যে কোন প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করে যান। আমার কাছেও কয়েক অভিভাবক তাদের বাসার ঠিকানা রেখে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেছিলেন। আমার গ্রামের বাড়ির অবস্থা কি হতে পারে সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণাও ছিল না। গ্রামের এক অগ্রজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের ছাত্র আমজাদ ভাই দুপুরের দিকে হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজে পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। আমাকে জোরপূর্বক বাসে তুলে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। বাড়ি পৌঁছে দেখি সেখানে হৃদয়বিদারক দৃশ্য। আমার নামের একাধিক ছাত্র নিয়ত হয়েছিলেন। রেডিও টেলিভিশনে এইসব নাম শুনে গ্রামের মানুষ ধরেই নিয়েছিল যে আমিও এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছি। অসংখ্য মানুষ আমাদের বাড়িতে সমবেত হয়েছিল বাবা-মাকে সান্ত¡না দেয়ার জন্য। আমাকে পেয়ে বাড়ির লোকজন এবং গ্রামবাসী আমাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করল। শিক্ষা খাতে চরম অবহেলা এবং উদাসীনতার শিকার হয়েই এই ৩৯ মেধাবী ছাত্র অকালে প্রাণ হারিয়েছিল। দুর্ঘটনা পরবর্তী সকল স্তরের মানুষের সহমর্মিতা, সাহায্য সহযোগিতা এবং গৃহীত ব্যবস্থা অবশ্যই সান্ত¡না জুগিয়েছে। সেসময় জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ লোলিত মোহন নাথ, অন্যান্য হাউস টিউটর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে আহত ছাত্রদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করেছেন। ইংরেজীর অধাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে আহত ছাত্রদের সেবাশুশ্রƒষার ব্যবস্থা নিয়েছেন। রোকেয়া হলের ছাত্রী অর্চনা সাহার সেদিনের ভূমিকা সবাই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে। হিসাববিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র শান্তিপ্রিয় চাকমা। রাতের পর রাত জেগে বিভিন্ন হাসপাতালে আহত ছাত্রদের সেবাশুশ্রƒষা দিয়েছেন। এক পর্যায়ে তিনি এতটাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং ক্লান্তÍ হয়েছিলেন যে জগ্ননাথ হলের উত্তর ভবনের নিজ কক্ষে হার্ট এ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। দুর্ঘটনার মাস খানেক পর জগন্নাথ হলের মাঠে অনুষ্ঠিত হয় শোকসভা। সে সময়ের হাউস টিউটর কাশিনাথ বসাকের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত শোকসভায় আগত অনেক নিহত ছাত্রের মায়ের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল। আরও সেই দৃশ্যের কথা মনে হলে চোখের জল আটকে রাখতে পারি না। সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পঁয়ত্রিশ বছর অতিবাহিত হয়েছে। দুর্ঘটনায় যারা আহত হয়েও বেঁচে ছিলেন তাদের অনেকেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। যারা দুর্ঘটনা পরবর্তী পরিস্থিতি সামলে নিতে ভাল ভ‚মিকা রেখেছেন তাদের অনেকে গত হয়েছেন। চলে গেছেন সেই সময়ের প্রাধ্যক্ষ লোলিত মোহন নাথ এবং ইংরেজীর অধ্যাপক ও হাউস টিউটর কাশিনাথ বসাক। যার অনুপ্রেরণায় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলাম এবং আমি সুস্থ আছি কিনা সেই চিন্তায় যিনি উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, আমার সেই অগ্রজ আমজাদ ভাইও অকালে চলে গেছেন গত বছর। সেই ধ্বংসস্ত‚পের ওপর নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবন। তারই একটি কক্ষে থেকে নিজের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেছি। হলের ঝুঁকিপূর্ণ পূর্বভবন কোন দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার আগেই সরিয়ে ফেলে নতুন একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবছর এই দিনটি বিশ্ববিদ্যালয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে। হয়েছে অনেক কিছুই কিন্তু ফিরে পায়নি অকালে নিহত ছাত্রদের পিতা-মাতারা তাদের প্রিয় সন্তানদের। আমাদের স্মৃতি থেকেও হারিয়ে যায়নি সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা। আমরা নিহত ছাত্রদের আত্মার শান্তি কামনা করি। লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা [email protected]
×